আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গুম হওয়া ৭ শিবির নেতার অভিযোগ
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের আরো সাত নেতাকে গুম করে নির্মম নির্যাতন এবং গুলি করে চিকিৎসা না দিয়ে ফেলে রেখে পঙ্গু করার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ৫৩ জনকে আসামি করা হয়েছে।
গতকাল রোববার ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন কার্যালয়ে এসে ভিকটিম ছাত্রশিবির নেতারা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চেয়ে এই অভিযোগ দায়ের করেন। এ সময় তাদের সাথে ছিলেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় আইন সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান ও সহকারী আইন সম্পাদক আমানুল্লাহ আদিব।
অভিযোগকারী শিবির নেতারা হলেন- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের কর্মী মো: জনি ইসলাম, চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানার শিবিরকর্মী মো: আবদুল করিম, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার শিবিরের কর্মী মো: সাইফুল ইসলাম, ঢাকার ভাটারা থানা শিবিরের তৎকালীন সভাপতি মো: নুরুল আমিন, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার একটি ইউনিয়নের তৎকালীন শিবির সভাপতি মো: কামারুজ্জামান। এ ছাড়া শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত বগুড়ার শেরপুর উপজেলার মো: আলমগীর হোসেন ও নোয়াখালীর মো: দেলোয়ার হোসেন।
অভিযোগ দায়ের করার পর আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, আজকে সাতটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে চারজন পঙ্গু হয়েছেন বা অঙ্গ হারিয়েছেন। একজন সাড়ে তিন বছর গুম থাকার পর এবং একজন সাড়ে তিন মাস গুম থাকার পর ফিরে এসেছেন। কামারুজ্জামান নামের একজন ২০১৭ সালে নিখোঁজ হয়েছেন, এখন পর্যন্ত তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তিনি আরো বলেন, আজকের সাতটি অভিযোগসহ ছাত্রশিবিরের সহযোগিতায় ট্রাইব্যুনালে এখন পর্যন্ত ১৭টি অভিযোগ করা হয়েছে। তার মধ্যে ১৬টি অভিযোগের ভুক্তভোগী ছাত্রশিবিরের কর্মী এবং একজন ভুক্তভোগী সাধারণ শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, জুলুম-নির্যাতনকারীরা যেন শাস্তির আওতায় আসে এবং নিখোঁজ ব্যক্তিরা যেন ফিরে আসেন, সেই দাবি জানাই।
অভিযোগ-১) ভিকটিম মো: জনি ইসলাম। তিনি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শাখার কর্মী হিসেবে কাজ করছিলেন। ২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে প্রশাসনের লোক, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ১৫-২০ জন তার বাড়িতে এসে তাকে পড়ার টেবিল থেকে উঠিয়ে হ্যান্ড কাফ পড়িয়ে বিনোদপুর বাজারে রাখা গাড়িতে উঠিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে। তাকে সেখান থেকে রাজপাড়া থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। থানায় নিয়ে আনুমানিক রাত ১২টার পর থেকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে চালানো হয় চরম বর্বরতা। তার হাতের কব্জি ও পায়ের তালুতে চাকু দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলা হয়। রাত দেড়টা থেকে ২টার পর তাকে থানা থেকে বের করে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় দাঁততলা নামক স্থানের একটি আমবাগানে। সেখানে নামিয়ে তার বাম পায়ে শটগান ঠেকিয়ে তিনটি গুলি করে। গুলির শব্দ শুনে এলাকাবাসী আসতে থাকলে, দ্রুত তাকে গাড়িতে উঠিয়ে ফেলে রাখে এবং আহত পায়ে পুলিশ উপর্যুপরি আঘাত করতে থাকে। এরপর নিয়ে যাওয়া হয় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে। সেখানে দীর্ঘ সময় পড়ে থাকলেও কোনো চিকিৎসা তারা নিতে দেয়নি। তৎকালীন রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডবলু সরকার এসে ডাক্তারদের আমার চিকিৎসা দিতে নিষেধ করে যান। এভাবে চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় চলতে থাকল তিন দিন। এরপর পুলিশ হেফাজতে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকার পঙ্গু হসপিটালে। সেখানেও পাঁচ দিন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসা দেয়া হয়নি। পাঁচ দিন পর পরীক্ষা করা হয় তার পায়ের। সপ্তম দিন তার পা থেকে দুর্গন্ধ বের হতে থাকে। এরপর ডাক্তারের পরামর্শে তার পা কেটে ফেলা হয়। সেখান থেকে তাকে বন্দুকযুদ্ধের নামে নাটক সাজিয়ে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এখন পর্যন্ত কাটা পা আর ২৫টি মামলা নিয়ে তিনি দিনাতিপাত করছেন।
অভিযোগ-২) ভিকটিম- মো: আব্দুল করিম। তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের বাঁশখালী থানার একজন কর্মী ছিলেন। ২০১৩ সালে ৩ মার্চ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায়ের প্রতিবাদে এবং মুক্তির দাবিতে সারা দেশের মতো শেখেরখীল রাস্তার মাথা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে শান্তিপূর্ণ একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা আকস্মিকভাবে হামলা ও গুলি চালায়। একপর্যায়ে একটি বুলেট এসে তার মেরুদণ্ডে এসে লাগে। প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়ার পর ডাক্তার তাকে চট্টগ্রাম সদর হাসপাতালে দ্রুত নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দেয়। কিন্তু প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের বাধার কারণে স্থলপথে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংগঠনের ভাইয়েরা বঙ্গোপসাগরের বিপদসঙ্কুল পথে ট্রলারে চট্টগ্রাম ন্যাশনাল হাসপাতালে পৌঁছে। কিন্তু চিকিৎসক অপারগতা প্রকাশ করে এবং ভিকটিমের মেরুদণ্ড অকার্যকর ঘোষণা করে। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার একটি বেসরকারি হসপিটালে নিয়ে আসা হয়। তিনি ১১ বছর যাবৎ একটি বেসরকারি হসপিটালে চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং সেটাই তার স্থায়ী নিবাস।
অভিযোগ-৩) ভিকটিম- মো: আলমগীর হোসেন। তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের জনশক্তি ছিলেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ সালে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের প্রতিবাদে শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে মির্জাপুর বাজার থেকে শন্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মিছিল শুরু হয়। ইতোমধ্যে পুলিশ, বিজিবি ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা উপর্যুপরি হামলা ও গুলি চালাতে থাকে। একটি বুলেট এসে তার ডান কানে এসে লাগে। আহত অবস্থায় পড়ে গেলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে গাড়িতে উঠানোর সময় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা এসে পুলিশের কাছ থেকে তাকে ছিনিয়ে যায় এবং তাদের হাতে থাকা হকিস্টিক, লাঠি ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আঘাত করতে থাকে। একপর্যায়ে তাদের হাতে থাকা রামদা দিয়ে দু’পায়ে কোপ দেয় এবং মাথায় হকিস্টিক দিয়ে আঘাত করলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তারা মৃত ভেবে ৩০ ফুট উঁচু ব্রিজ থেকে ফেলে দিলে তার মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। যখন তার জ্ঞান ফিরে আসে সে তখন একটি স্থানীয় হসপিটালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে আসা হয়। এরপর পঙ্গু হসপিটালে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে একটি বেসরকারি হসপিটালে ১১ বছর যাবৎ চিকিৎসা নিচ্ছেন। এখন হুইল চেয়ারই তার নিত্যদিনের সঙ্গী।
অভিযোগ-৪) ভিকটিম- মো: দেলোয়ার হোসেন মিশু। ২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ১০ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল হয়। এর ধারাবাহিকতায় নোয়াখালী শহরের মাইজদী পৌরবাজার থেকে শান্তিপূর্ণ মিছিল শুরু হলে পুলিশ হামলা চালায় এবং গুলি বর্ষণ করে। একটি রাবার বুলেট তার ডান চোখে আঘাত করে। স্থানীয় হসপিটালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেলে তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। পুলিশ কেস দেখে কোনো হসপিটাল চিকিৎসা দিতে রাজি হয়নি। পরে একটি হাসপাতালের একজন ডাক্তারের সুপারিশে চিকিৎসা দিতে রাজি হয় কর্তৃপক্ষ। চিকিৎসা নিলেও সে ওই চোখে আর দেখতে পান না। চিরদিনের জন্য তার এই চোখের আলো নিভে যায়।
অভিযোগ-৫) ভিকটিম মো: সাইফুল ইসলাম তারেক। তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানার কর্মী ছিলেন। ১৪ জুন ২০১৭ বেলা আনুমানিক আড়াইটার দিকে সাদা পোশাকে তার বাড়ির আঙ্গিনা থেকে এলাকাবাসী এবং তার পরিবারের সদস্যদের সামনে উঠিয়ে নিয়ে যায়। গাড়িতে তুলে চোখ বেঁধে ফেলে এবং তাকে পতেঙ্গা র্যাব-৭ এ নিয়ে যায়। দু’দিন পর তাকে নিয়ে বান্দরবান ক্যাসিংঘাটা যায়। যেখানে ৫৯ দিন একটি কবরের মতো রুমে বন্দী রাখা হয়। এর মধ্যে ৩৯ দিন তাকে কোনো গোসলের সুযোগ দেয়া হয়নি। পরে ৫৯ দিন পর তাকে চোখ বেঁধে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্মম নির্যাতন চালানো হয় প্রতিনিয়ত। সাইফুল ইসলাম তারেককে ২০২০ সালের ১৯ জুন ময়মনসিংহ র্যাব-১৫ তে নিয়ে যাওয়া হয়। ২০ জুন তাকে ফুলবাড়িয়া থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দিয়ে ময়মনসিংহ কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ১০ মাস কারাভোগের পর তিনি জামিনে মুক্তি পায়।
অভিযোগ-৬) ভিকটিম মো: নুরুল আমিন। তিনি তৎকালীন ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকার ভাটারা থানা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২৬ জুন ২০১৩ গুলশান আজাদ মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করে বের হলে সাদা পোশাকে র্যাবের একটি টিম প্রথমে আব্দুস সালাম এবং পরে নুরুল আমিনকে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নেয় এবং চোখ বেঁধে ফেলে। এক ঘণ্টা পথ চলার পর তাদের কোলে করে নিয়ে চারতলার একটি কক্ষে রেখে দেয়। জিজ্ঞাসাবাদের নামে নিয়মিত নির্যাতন করা হয়। তিন মাস ১৫ দিন পর হঠাৎ একদিন রাত ৩টার দিকে গাড়িতে করে চোখ বাঁধা অবস্থায় নূরুল আমিনকে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার ঘিওর নামকে স্থানে ফেলে রেখে যায় এবং আব্দুস সালাম ভাইকে সাভারের রাস্তায় ফেলে রেখে চলে যায়।
অভিযোগ-৭) ভিকটিম মো: কামারুজ্জামান। তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সদর উপজেলার একটি ইউনিয়ন সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ৪ মে ২০১৭ সে তার বন্ধুর বাসায় যান এবং সেখানেই রাত যাপন করেন। রাত ২টার দিকে সাদা পোশাকে ৮-১০ জন লোক এসে জোরপূর্বক কামারুজ্জামানকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। তাদের পরিচয় জানতে চাইলে প্রশাসনের লোক বলে পরিচয় দেয়। তাকে কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কারণ জানতে চাইলে তারা গালাগাল শুরু করে। পরে তাকে সাদা একটি মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়। এর পর থেকে তার কোনো খোঁজ মিলেনি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা