পাঠ্যবইকে দলীয় লিফলেটে পরিণত করেছিল আ’লীগ
শিক্ষা সংসদের প্রস্তাবনা বিষয়ে আলোচনা সভা- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৫৭
ব্যক্তির বন্দনা আর পারিবারিক ইতিহাসের নানা বর্ণনা অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বিগত ১৫ বছরে শিক্ষার্থীদের দেয়া বিনামূল্যের পাঠ্যবইকে দলীয় লিফলেটে পরিণত করেছিল আওয়ামী লীগ। মুজিববর্ষ উদযাপনের নামে গত কয়েক বছরে যেভাবে পাঠ্যপুস্তকসহ বিভিন্ন দলীয় প্রচারে কয়েক লাখ টন কাগজ ব্যবহার করে সরকারি টাকার অপচয় করা হয়েছে তা ছিল হিসাবের বাইরে। তবে গত জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান সব কিছু ছুড়ে ফেলে সবাইকে এক মঞ্চে দাঁড় করিয়েছে। এখন পাঠ্যপুস্তক নতুন করে রচনা করতে হবে। আর নতুনভাবে রচিত এই পাঠ্যবইয়ে জুলাই-আগস্টের ঘটনাও সন্নিবেশিত রাখতে হবে। গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েমে) মিলনায়তনে পাঠ্যপুস্তকে গণঅভ্যুত্থানের বীরত্বগাথার অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে শিক্ষা অধিকার সংসদ আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনা সভায় আলোচকরা এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষা অধিকার সংসদের আহ্বায়ক নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির প্রফেসরিয়াল ফেলো অধ্যাপক ড. এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ। প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজিম উদ্দিন খান। বিশেষ অতিথি ছিলেন শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক হোসনে আরা বেগম, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া। আরো বক্তব্য রাখেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দেলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, ইনকিলাব মঞ্চের শরিফ ওসমান হাদী, শিক্ষা গবেষক রাখাল রাহা, এডুকেশন রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ইরাব) সহ-সভাপতি শাহেদ মতিউর রহমান, ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে শহীদ আনাসের মা-বাবা, শহীদ সাজিদের বোন, আহত শিক্ষার্থী জসিম উদ্দিন প্রমুখ। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা গবেষক, শিক্ষক, এনজিওকর্মী ও সাংবাদিকরাও আলোচনায় অংশ নেন। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সংগঠনের সদস্যসচিব এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক শাহনেওয়াজ খান চন্দন। সভায় শিক্ষা অধিকার সংসদ পাঠ্যপুস্তকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বীরত্বগাথার অন্তর্ভুক্তি এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মানহীন বিষয়বস্তু বাদ দেয়ার বিষয়ে প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান বলেন, আওয়ামী আমলের ১৫ বছরে দেশপ্রেম শব্দটি নিছক একটি পণ্যে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। আর সেটা শুরু হয়েছিল তথাকথিত বিতর্কিত কারিকুলামের মাধ্যমে। কিন্তু এবারের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান সব মানুষকে সব শ্রেণী-পেশার ঊর্ধ্বে তুলে এক কাতারে নিয়ে এসেছে। সব শিক্ষার্থী ও সব পেশার মানুষকে একত্রিত করেছে। জীবন বাঁচানো ও পরিবর্তিত ভিন্ন একটি দেশ দেখার আশা জাগিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সেই আশা এখন ধীরে ধীরে ম্লান হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, এখন আবার ঐক্যের বদলে আমরা নানা কারণে বিভক্তিও দেখতে পাচ্ছি। তিনি ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, আমরা যখন ইতিহাস লিখবো, সঠিকভাবেই লিখতে হবে। শিশুদের জন্য লিখতে গেলে শিশুর মনস্তত্ব বুঝে তারপরই তাদের জন্য লিখতে হবে। আমাদের ইতিহাস কেন বায়ান্ন আর একাত্তরে পড়ে থাকবে? তার আগের ইতিহাসও পাঠ্যবইয়ে থাকা জরুরি। পূর্ববঙ্গের মানুষের সামাজিক বৈশিষ্ট্য আমরা একাত্ম, সেভাবে আমাদেরকে ভাবতে হবে। বিশ্বকে বুঝতে গেলে, মানচিত্র বুঝতে গেলে ইতিহাস সেভাবে চিন্তা করতে হবে। আমাদের অনন্যতা সামনে আনতে গেলে নতুন করে ভাবতে হবে। পতিত আওয়ামী লীগ কী করেছে, সেটা চিন্তা না করে বরং কোন আকাক্সক্ষায় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছে, সেটা বুঝতে হবে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় রাষ্ট্রের ব্যয় সবচেয়ে কম। এমনকি আমাদের শিক্ষা বাজেট আফগানিস্তানের চেয়েও কম। আমাদের এখানেও জোর দিতে হবে। নতুন বাংলাদেশ গঠনে জোর দিতে হবে। বৈচিত্র্যকে ধারণ করতে হবে। সেই ভাবনা থেকে শিক্ষা নিয়েও কাজ করতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমি ছাত্রনেতা নই, শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবেই আমরা আন্দোলন শুরু করি। এত দিন; বিশেষ করে গত ১৫ বছরে মিডিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় যে বন্দনা ছিল তার পরিবর্তন দরকার। শিক্ষার সূত্রেই আমি কারিকুলামসহ বিভিন্ন বিষয় পড়েছি। নিজেও শিক্ষাদানের জন্য যুক্ত আছি। আমার উপলব্ধি হলো বুদ্ধিজীবীদের সংঘবদ্ধ একটি গোষ্ঠী ইতিহাসকে ব্র্যাকেটবন্দি করেছেন। দীর্ঘ ১৫টি বছর আমরা দমবন্ধকর এক পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছি। আমি যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে তখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। অর্থাৎ তাদের ম্যানিপুলেটেড ইতিহাসই আমরা পড়েছি। ’২৪ এর গণঅভ্যুত্থানকে আংশিক ইতিহাস হিসেবে যেভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হচ্ছে, এটা বন্ধ করা দরকার। বরং একাত্তরের মতো ’২৪ আন্দোলনকে পুরো ইতিহাসের অংশ হিসেবে দেখতে হবে। কোটি কোটি টন কাগজ নষ্ট করা হয় বানানো ইতিহাসের জন্য। বিগত ১৫ বছর আমরা বুদ্ধিজীবীদের এক দৈন্যদশা দেখছি। শিক্ষার্থীদের অবদানকে কীভাবে পাঠ্যবইতে উপস্থাপন করা যায় সেটাও ভাবা জরুরি। আমরা যারা আপনাদের সন্তানতুল্য তারা রক্ত দিয়ে বিপ্লব করি আর এখন মুরুব্বিরা তাদের যে যার মতো পোস্ট ভাগাভাগি করে। এটা দুঃখজনক।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞ রাখাল রাহা বলেন, গত ১৫ বছরে শিক্ষায় যে অধঃপতন হয়েছে তা আগে কখনো হয়নি। প্রশ্ন ফাঁসের আন্দোলনে আমি গুম হই। পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত করার ক্ষেত্রে আবেগতাড়িত হওয়া যাবে না। পাঠ্যপুস্তকে ২০০৮ চরমভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইতিহাসের অতিকথন হয়েছে। ইতিহাস বিকৃতি করে পাঠ্যবইয়ে কোটালিপাড়াকে রাজধানী বলা হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করতে। আশা করছি, এটা সম্ভব হবে। ন্যাশনাল কারিকুলাম কো-অর্ডিনেশন কমিটির সদস্য অধ্যাপক সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া বলেন, গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বগাথা নিশ্চয়ই যুক্ত হবে। আগামী বছর মূল টার্গেট করতে হবে। আমাদের কারিকুলামে কী রাখা হবে তা এখনই চিন্তা করে রাখা দরকার।
শহীদ সাজিদের বড় বোন ফারজানা বলেন, আন্দোলনের শুরু থেকেই সাজিদ সক্রিয় ছিল। আমাদের পরিবার থেকে এক ধরনের নেতিবাচক কথা বললেও সাজিদ বলছিল এই আন্দোলনে আমরা না গেলে কে যাবে? পরে সাজিদ শহীদ হয়ে গেল। শহীদ আনাসের মা সানজিদা বলেন, আমি চাই আমার সন্তানের চিঠিটা, যেটি সে শহীদ হওয়ার আগে তার টেবিলে লিখে রেখে গিয়েছিল সেটি পাঠ্যপুস্তকে সংযুক্ত করা হোক।
আহত শিক্ষার্থী জসিম উদ্দিন, ১৮ জুলাই আমি আন্দোলনে আহত হই। চারটা হাসপাতালে আমার চারটা অপারেশন হয়। পাঠ্যপুস্তকে শেখ মুজিবকে যেভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে, তার ফলে দেখা যায়, দুই হাজার মানুষ নিহত হওয়ার পর যতটা বিক্ষুব্ধ হওয়া উচিত ছিল, তার চেয়ে কেউ কেউ শেখ মুজিবের ম্যুরাল ভাঙ্গায় বিক্ষুব্ধ হচ্ছে বেশি। স্কুল কলেজে যে ইতিহাস পড়া হয়, সেখানে নতুন ইতিহাস হিসেবে ২০২৪ কেও যুক্ত করতে হবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা