১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

চাকরির ১১ বছর পর জানা গেল ৭ শিক্ষকের সনদ জাল

-


মানিকগঞ্জের ঘিওরে চাকরির ১১ বছর পর জানা গেল সাতজন শিক্ষকের সনদ জাল। উপজেলার ফুলহারা আঞ্চলিক উচ্চবিদ্যালয়ে এই সাতজন শিক্ষকদের নামে শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর অভিযোগ হওয়ার পরে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) তদন্ত করে। তদন্তে ছয়জন সহকারী শিক্ষক ও একজন কম্পিউটার শিক্ষকের সনদ জাল বলে উল্লেখ করা হয়। পরে শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ওই শিক্ষকদের বেতন ভাতা স্থগিতসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্কুল ম্যানেজিং কমিটিকে নির্দেশ দিলেও এখনো বহাল তবিয়তে বেতনভাতা উত্তোলনসহ বিদ্যালয়ে পাঠদান করছেন শিক্ষকরা।
এ নিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা এবং প্রধান শিক্ষকের কক্ষে তালা ঝুলানোর ঘটনাও ঘটেছে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, জাল সনদ দিয়ে ও স্কুলের প্রাক্তন সভাপতির স্বাক্ষর জাল করে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সরজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিগত ২০১৩ সালের নিয়োগকে গোপন করে ২০০৪ সালের বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া নিয়োগপত্র বানিয়ে উচ্চ আদালতে শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের নির্দেশনার বিরুদ্ধে রিট পিটিশিন দাখিল করেন ওই জাল সনদধারী শিক্ষকরা। ফলে তাদের বেতনভাতা উত্তোলনসহ পাঠদানের পথটি সহজ হয়ে যায়। উচ্চ আদালতে রিট পিটিশিন করেই বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে বহাল রয়েছেন। সম্প্রতি অবৈধ সুপারিশ না করায় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে তালা ঝুলিয়েছেন তারা।

জাল সনদধারী শিক্ষকরা হলেন, সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি) শাহীনুর ইসলাম, সহকারী শিক্ষক (সামাজিক বিজ্ঞান) মর্জিনা আক্তার, সহকারী শিক্ষক (বাংলা) শামছুন নাহার, সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি) আয়শা আক্তার, সহকারী শিক্ষক (বাংলা) মো: আবুল কাশেম মোল্লা, সহকারী শিক্ষক (সমাজিক বিজ্ঞান) মো: বশির উদ্দিন এবং কম্পিউটার সনদ জালধারী কম্পিউটার শিক্ষক শাহানাজ আক্তার।
জানা গেছে, মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার ফুলহারা আঞ্চলিক উচ্চবিদ্যালয়ে বিগত ২০১৩ সালে শিক্ষাবিধি অনুযায়ী প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকসহ মোট ১০ জন শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এর মধ্যে সহকারী শিক্ষক পদে ছয়জন একং কম্পিউটার শিক্ষক ছিলেন একজন। নিয়োগের কিছুদিন পরে ছয়জন সহকারী শিক্ষকের শিক্ষক নিবন্ধন সনদ জাল ও একজন কম্পিউটার শিক্ষককে সনদ ছাড়াই নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করে শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দেন ওই স্কুলের দাতা সদস্য মো: নবুয়াত আলী।
এরপর সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) ওই ছয়জন শিক্ষকের নিবন্ধন সনদ জাল উল্লেখ্য করে শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর প্রতিবেদন প্রেরণ করে। পরে শিক্ষা অধিদফতর স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিকে ওই ছয়জন শিক্ষকের সনদ জাল হওয়ায় তাদের বেতনভাতা স্থগিত করাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।

এরপর চাকরি বহাল ও বেতনভাতা চালু রাখতে জাল সনদধারী ছয়জন শিক্ষক ২০১৩ সালে নিয়োগ গোপন করে বিগত ২০০৪ সালে ওই বিদ্যালয়ের সাবেক ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শাজাহান মজনুর স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া নিয়োগপত্র তৈরি করে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করেন। সেই রিটের বলে এখন পর্যন্ত বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে বহাল রয়েছেন এবং নিয়মিত বেতনভাতা উত্তোলন করে আসছেন।
সম্প্রতি ওই সাতজন শিক্ষক বেতনের সিনিয়র স্কেল পেতে আবেদন করার জন্য স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নিকট সুপারিশ চান। কিন্তু জাল সনদধারী এসব শিক্ষকদের সুপারিশ না করায় প্রধান শিক্ষকের ওপর ক্ষুব্ধ হন তারা। এরপর স্কুলের প্রধান শিক্ষককে নানাভাবে ভয়ভীতি, হুমকি-ধমকিসহ চাঁদা দাবি করার অভিযোগও ওঠে পরবর্তী সময়ে ওই শিক্ষক ও তাদের আত্মীয়স্বজনদের বিরুদ্ধে। সুপারিশ না করায় ওই শিক্ষকরার গত ১২ নভেম্বর বিকেলে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। এতে স্কুলের পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে বলে জানায় স্কুলের ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকেরা।
এ দিকে ওই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির প্রাক্তন সভাপতির স্বাক্ষর জাল করে ২০০৪ সালের ভুয়া নিয়োগপত্র বানানোর অভিযোগ এবং তদন্ত করে স্কুলের জাল সনদধারী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিতভাবে গত ৭ নভেম্বর আবেদন করেন ওই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির প্রাক্তন সভাপতি মো: শাজাহান মজনু।

নিয়োগ কমিটির সভাপতি মো: কবির খান বলেন, বিধি অনুযায়ী ২০১৩ সালে ওই শিক্ষকদের নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়েছিল, তবে তাদের সনদ যাচাই-বাছাই করার কোনো সুযোগ ছিল না আমাদের। কিন্তু তাদের সনদ জাল প্রমাণিত হওয়ায় ২০০৪ সালের ভুয়া নিয়োগপত্র বানিয়ে এখনো স্কুলে শিক্ষক হিসেবে আছে।
বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির প্রাক্তন সভাপতি মো: শাজাহান মজনু বলেন, শুনেছি আমার স্বাক্ষর জাল করে ২০১৩ সালের শিক্ষক নিয়োগ দেখানো হয়েছে ২০০৪ সালের। অথচ আমি ওই স্কুলের চারবারের নির্বাচিত সভাপতি ছিলাম। ২০০৯ সাল পর্যন্ত ম্যানেজিং কমিটির দায়িত্ব পালন করেছি। ওই সাতজন শিক্ষকের নিয়োগ আমার সময়ে হয়নি বরং শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে ২০১৩ সালে। তবে ২০০৫ সাল থেকে মাধ্যমিক শিক্ষকদের নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক হওয়ায় এবং তাদের সনদ জাল হওয়ায় কৌশলগত কারণে তার স্বাক্ষর জাল করে ওই শিক্ষকরা ২০০৪ সালের নিয়োগ দেখিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।
জাল সনদধারী ওই শিক্ষকদের সাথে এই প্রতিবেদক কথা বলার চেষ্টা করেন। তবে সাতজন শিক্ষকের মধ্যে বশির উদ্দিন নামে একজন শিক্ষক প্রতিবেদকের সাথে কথা বলতে রাজি হন। বাকিরা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বশির উদ্দিন বলেন, ফুলহারা আঞ্চলিক উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে ২০০৪ সালে নিয়োগ পেয়েছি। তবে নিয়োগের সময় তিনি কোনো শিক্ষক নিবন্ধন সনদ নিয়োগ কমিটির কাছে জমা দেননি। তিনিসহ বাকি শিক্ষকদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোনো ভুল নেই। স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ভুল তথ্য প্রচার করছেন।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, জাল সনদ দিয়ে ও স্কুলের প্রাক্তণ সভাপতির স্বাক্ষর জাল করে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। আমরা তদন্ত করব এবং তদন্তে ওই শিক্ষকদের নিবন্ধন সনদ জাল পাওয়া গেলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। মাধ্যমিক স্কুল পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারি বিধিবিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান।
ঘিওর উপজেলার ফুলহারা আঞ্চলিক উচ্চবিদ্যালয়ের এই সব জাল সনদধারী শিক্ষকদের দ্রুত অপসারণ করে বিধি অনুযায়ী নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ করার দাবি জানান স্কুলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা। যাতে স্কুলে পাঠদান কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলে ও শিক্ষার মান বৃদ্ধি পায়। এমটানই দাবি এলাকাবাসীর।

 


আরো সংবাদ



premium cement