দাম বেশি, খাওয়া হচ্ছে বীজ আলু : উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা
- কাওসার আজম
- ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:১৫, আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৫৬
দেশে গোল আলুর (খাবার আলু) বাজার ঊর্ধ্বমুখী। প্রকারভেদে আলুর দাম ৮০ টাকার উপরে। আমদানি করে বাজার সামলানোর চেষ্টা করছে সরকার। তবে, আমদানি অনুমতির (আইপি) চেয়ে দেশে আলু আসছে যৎসামান্যই। ফলে আলুর দাম ঊর্ধ্বমুখীই রয়ে গেছে। এ অবস্থায় নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে আলু মৌসুম। কৃষকের বীজ আলু প্রাপ্তিতে টান পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, দেশে প্রতি বছর এক কোটি টনের বেশি গোল আলুর উৎপাদন হয়। এই উৎপাদনের জন্য প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টন বীজ আলু দরকার। কিন্তু এ বছর বাজারে খাওয়ার আলুর দাম বেশি হওয়ায় বীজ আলু খাবার আলু হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ফলে চলমান আলু উৎপাদন মৌসুমে কৃষকের আলুবীজ প্রাপ্তি নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে আগামীতে আলুর উৎপাদনেও টান পড়বে বলে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা।
এ বিষয়ে কৃষি সচিব ড. মুহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়াকে ফোন করে এবং হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ দিলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের নাম না প্রকাশে অনিচ্ছিুক এক কর্মকর্তা জানান, দেশে আলু বীজ যা আছে ঘাটতি পড়ার কথা না। তবে, একটা চ্যালেঞ্জ আছে সামনে, সেটা হলো বীজ আলু খাবার আলু হিসেবে কোল্ড স্টোরেজ থেকে বিক্রি হয়ে যায় কি না। ওই কর্মকর্তা বলেন, সচিব-এর সভাপতিত্বে বৈঠক হয়েছে গত মঙ্গলবার। সেখানে করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বীজ আলু যাতে চাষির কাছে যথাযথভাবে যায় এবং কোনোভাবেই যাতে খাবার আলু হিসেবে বিক্রি না হয় সে বিষয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি দেয়া হচ্ছে। একইভাবে কোল্ড স্টোরেজ এসোসিয়েশন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও বিএডিসিকেও চিঠি দেয়া হচ্ছে, যাতে তাদের কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে তদারকি করে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারোর (বিবিএস) হিসেবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪ লাখ ৫৭ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ করা হয়। যেখানে উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৬ লাখ টন। কিন্তু বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ এসোসিয়েশনের দাবি- আলু উৎপাদন হয়েছে ৮০-৮৫ লাখ টন।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ এসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, একদিকে আলুর উৎপাদন কম হয়েছে। সে কারণে বাজারে দাম বেশি। এই দাম বেশি হওয়ার কারণে এবারে অনেক বীজ আলু খাবার আলু হিসেবে ব্যবহার হয়েছে, হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয় অবশ্য বীজ আলুর যাতে যথাযথ সরবরাহ সংরক্ষণ করা যায় সে জন্য আমাদেরকে নির্দেশনা প্রদান করেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, দেশে খাওয়ার আলুর চাহিদা ৯০ লাখ টনের কাছাকাছি। এর সঙ্গে সাড়ে ৭ লাখ টন বীজ আলুর চাহিদা রয়েছে। প্রতি বছর আলুর দাম উৎপাদন মৌসুমে ২০-৩০ টাকা এবং মৌসুম শেষে ৪৫-৫০ টাকায় উঠে। কিন্তু এ বছর উৎপাদন মৌসুম থেকেই আলুর দাম চড়া এবং এখন এটা ৭০-৭৫ টাকায় উঠেছে। এর মধ্যে সরকার আলু আমদানির উপর থেকে শুল্ক কমিয়ে আমদানি সহজ করেছে। কিন্তু আমদানি করেও সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
কৃষি বিভাগ বলছে, গত বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশ রফতানির পরিবর্তে নিয়মিত আমদানি করেও বাজার সামাল দিতে পারছে না। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর বাজার বিশ্লেষণের হিসাবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এই দাম ৩৫.৯২ শতাংশ বেশি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং-এর তথ্যানুযায়ী, এ বছর জানুয়ারি থেকে গত ১২ নভেম্বর পর্যন্ত আলু আমদানির অনুমতিপত্র প্রদান করা হয়েছে ৪.৫৫ লাখ মে টন। এর বিপরীতে আমদানি হয়েছে মাত্র ৪১ হাজার মে টন। সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আলু আমদানির অনুমতি নিলেও তার বেশির ভাগ আনছে না। ফলে আলুর বাজার ঊর্ধ্বগতিই রয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বীজ আলু খাবার আলু হিসেবে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
আলুর মজুদ নিয়ে গরমিল
কৃষি বিপণন অধিদফতরের ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত মজুদ তথ্যানুযায়ী দেশের ৩৬৬টি হিমাগারে (কোল্ড স্টোরেজ) ৩ লাখ ২০ হাজার ৭৪২ টন খাবার আলু এবং ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৮০ টন বীজ আলুর সংরক্ষণ রয়েছে। কোন হিমাগারে কী পরিমাণ বীজ ও খাবার আলু সংরক্ষণ আছে সে বিষয়ে কৃষি বিপণন অধিদফতর থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ে একটা হিসাবও দেয়া হয়। এতে দেখা যায়, মোট সংরক্ষণকৃত খাবার আলুর মধ্যে রাজশাহী বিভাগে প্রায় অর্ধেক আলু, ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩২২ টন সংরক্ষণ করা আছে। বাকি আলু সংরক্ষণ আছে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে। একইভাবে বীজ আলুও বেশি সংরক্ষণ আছে রাজশাহী বিভাগে, ২ লাখ ৩৩ হাজার ২৫৯ টন। ২ লাখ ১৮ হাজার ৫৮১ টন বীজ আলু সংরক্ষণ আছে রংপুর বিভাগে।
অন্য দিকে, বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ এসোসিয়েশনের তথ্যমতে, চলতি বছর ৩৩০টি হিমাগারে ১৮ লাখ ১২ হাজার ১৬৪ টন খাবার আলু এবং ৭ লাখ ১৫ হাজার ৫৩০ টন সংরক্ষণ ছিল। এর মধ্যে ১৩ লাখ ৭৩ হাজার ২২৭ টন খাবার আলু ও ৭৮২ টন বীজ আলু হিমাগার থেকে উত্তোলন (বিক্রি) করা হয়েছে। গত ২১ অক্টোবর পর্যন্ত সরবরাহকৃত তথ্যানুযায়ী দেশের বিভিন্ন কোল্ড স্টোরেজে খাবার আলু মজুদের পরিমাণ ৪ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৭ মেট্রিক টন; বীজ আলুর পরিমাণ ৭ লাখ ১৪ হাজার ৭৪৮ টন।
সরকারি-বেসরকারি দুটি প্রতিষ্ঠান/এসোসিয়েশনের ভিন্ন তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার কৃষি মন্ত্রণালয়ে সচিবের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় সরকারি-বেসরকারি খাতের সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে বীজ আলু ও খাবার আলুর তথ্য নিয়ে পর্যালোচনা হয়। এই মিটিংয়ে এখন প্রকৃতপক্ষে বীজ আলু কত আছে সেটার প্রকৃত তথ্য প্রদান এবং বীজ আলু যাতে কোনো ভাবেই খাবার আলু হিসেবে ব্যবহার না করা হয় সে বিষয়ে কৃষি বিভাগকে সতর্ক নজরদারি করতে নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
সভায় কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বীজ আলুর যথাযথ সংরক্ষণ ও সঠিক হিসাব দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রদানের নির্দেশনা প্রদান করেন। একই সঙ্গে যাতে বীজ আলু অন্য কোনো খাতে ব্যবহার না হয় সে বিষয়ে কৃষি বিভাগকে তদারকি জোরদারের নির্দেশ দেন।
এ বিষয়ে কৃষি বিপণন অধিদফতরের মহাপরিচালক মাসুদ করিম নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের হিসাব কৃষি মন্ত্রণালয়কে দিয়েছি। এ নিয়ে একটি বৈঠক হয়েছে। তথ্য পর্যালোচনা শেষে তারাই (মন্ত্রণালয়) করণীয় ঠিক করবেন।
বাংলাদেশ সিড এসোসিয়েশনের মহাসচিব কৃষিবিদ ড. আলী আফজাল বলেন, বাজারে খাবার আলু বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকার বেশি দামে। কিন্তু প্রকারভেদে বিভিন্ন কোম্পানি বীজ আলু বিক্রি করছে ৬৯-৭৮ টাকা কেজি দরে। ফলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বীজ আলু খাবার আলু হিসেবে ব্যবহার হওয়ার। এটা হলে বীজ আলুর ব্যাপক সঙ্কট তৈরি হবে। বীজ আলু যা আছে সেটা যাতে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয় সে বিষয়েও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সভায় গুরুত্বারোপ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
আলী আফজাল বলেন, চাষির কাছে অল্প কিছু বীজের জোগান থাকে। এর বাইরে বিএডিসি, বেসরকারি খাত বীজ আলুর জোগান দেয়। এর মধ্যে ২০-৩০ হাজার টন বীজ আমদানি হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমদানির বীজ ঠিক সময়ে দেশে না আসলে সমস্যায় পড়তে হবে। এ জন্য দ্রুত এলসির সমস্যা সমাধান চান এই উদ্যোক্তা।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, শুধু বীজ আলু নয়, খাবার আলুর সঙ্কটও প্রকট হয়েছে। দুই দফা বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে এবারে কৃষক আগাম আলু রোপণ করেছেন কম পরিমাণে। প্রতি বছর নভেম্বর মাসে আগাম নতুন আলু বাজারে আসলেও এ বছর এর পরিমাণ খুবই সামান্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোল্ড স্টোরেজগুলোতে বর্তমানে আলুর মজুদ রয়েছে ২ লাখ টনের কিছু বেশি, যা দিয়ে হয়তো ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চলবে। তবে আগাম আলু ডিসেম্বরের ১০ তারিখের মধ্যে বাজারে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা