হালদাকে ইউনেস্কো হ্যারিটেজে রূপান্তরে উৎসমুখ সংরক্ষণের উদ্যোগ
- নূরুল মোস্তফা কাজী চট্টগ্রাম ব্যুরো
- ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:১৩
চট্টগ্রামের মৎস্য হ্যারিটেজ হালদা নদী শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা বিশ্বে এক ইউনিক নদী। যেখানে রয়েছে জোয়ার-ভাটা, রুই জাতীয় মাছ ও ডলফিনের উপস্থিতি। নানা প্রজাতির ছোট মাছ তো আছেই। রুইজাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ উপযোগী প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র এই হালদা নদীকে ইউনেস্কো হেরিটেজে রূপান্তরের সুযোগ থাকলেও নানা সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তাই হালদাকে ইউনেস্কো হ্যারিটেজে রূপান্তরের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে হালদার উৎসমুখকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একই সাথে হালদা নদীর প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণে এর মালিকানা নির্ধারণও জরুরি বলে মনে করেন মৎস্য গবেষকরা। প্রায় ৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে চলমান হালদা নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (২য় পর্যায়) সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে এমন তথ্য মিলেছে।
হালদা নদী পার্বত্য খাগড়াছড়ির পাহাড় হতে উৎপন্ন হয়ে ফটিকছড়ির মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম জেলায় প্রবেশ করেছে। এটি এর পর দক্ষিণ-পশ্চিমে ও পরে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে ফটিকছড়ির বিবিরহাট, নাজিরহাট, সাত্তারঘাট ও অন্যান্য অংশ, হাটহাজারী, রাউজান এবং চট্টগ্রাম শহরের চান্দগাঁও-বাকলিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এটি কালুরঘাটের কাছে কর্ণফুলী নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। এটি পৃথিবীর একমাত্র নিষিক্ত ডিম আহরণ উপযোগী জোয়ার-ভাটার নদী যেখানে রুইজাতীয় মা মাছ ডিম ছাড়ে।
বর্তমানে হালদা নদী হতে কোনো প্রকার মাছ ও জলজ প্রাণী ধরা বা শিকার করা নিষিদ্ধ। হালদা নদীর সাথে সংযুক্ত ১৭টি খালে প্রজনন মৌসুমে ফেব্রুয়ারি হতে জুলাই পর্যন্ত ৬ মাস মাছ ধরা নিষেধ। এ ছাড়া হালদা নদীসংলগ্ন ৪টি নদী তথা কর্ণফুলী, শিকলবাহা, চাঁদখালী এবং সাঙ্গু নদীতে মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত ৫ মাস মাছ ধরা নিষেধ। মৎস্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইন, ১৯৫০ এর ৫ ধারা অনুযায়ী আইন ভঙ্গকারীর কমপক্ষে এক বছর হতে সর্বোচ্চ দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে আইন ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে। তবে হালদা নদীতে যত বিধিনিষেধ আছে তা কার্যকর করতে হলে আগে নদীর মালিকানা নির্ধারণ করা জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। হালদা নদীর মালিক হবে মূলত সেখানকার ডিম সংগ্রাহক এবং দুই পাড়ের বাসিন্দারা। কাজেই নদীর মালিকানা নির্ধারণ করতে হবে, যাতে নদীর বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় তারা নিজেরা উদ্যোগী হয়।
বর্তমানে মনুষ্যসৃষ্ট নানা কর্মকাণ্ডে অনন্য এই নদীতে রুইজাতীয় মা মাছের প্রজনন উপযোগিতা দিন দিন সঙ্কীর্ণ হয়েছে। বিশেষ করে উজানে গাছপালা বন উজাড় করা, ভূজপুর রাবার ড্যাম, শাখা খালগুলোর পরিবেশ দূষণ, যেসব বাঁকে (কুম) মা মাছেরা ডিম ছাড়ার জন্য অপেক্ষা করত অধিকাংশ বাঁক কেটে সোজা করে ফেলাসহ নানা কারণে হালদার ডিম আহরণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া চোরাগোপ্তা মা মাছ শিকার তো আছেই। এ দিকে হালদা নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রের সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা এবং রেণু উৎপাদন বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত চার বছর মেয়াদি এই প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৬ কোটি ৩৮ লাখ ৭২ হাজার টাকা। রেণু উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিদ্যমান ছয়টি হ্যাচারির উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে তিনটি হ্যাচারি হাটহাজারী উপজেলায় এবং তিনটি রাউজান উপজেলায়।
সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার রুইজাতীয় মাছের অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীর উৎপত্তিস্থল খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড় উপজেলার ২নং পাতাছড়া ইউনিয়নের হাসুকপাড়া। এটি বাংলাদেশের পানিসীমায় উৎপত্তি এবং এ দেশেরই পানিসীমায় (কর্ণফুলী নদীতে) পতিত হয়েছে। হালদা নদীর উৎস মুখের বর্তমান অবস্থা খুবই নাজুক। সেখানকার পাহাড়ের গাছগুলো কেটে সাবাড় করে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশের মৎস্যসম্পদ খাতে বিশেষত রুইজাতীয় মাছের পোনা উৎপাদনের পাশাপাশি হালদা নদীর দুই মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনবদ্য ভূমিকা রেখে চললেও হালদা নদীর মৎস্যসম্পদ ও উৎপত্তিস্থলের সুরক্ষা ও সংরক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণে ইতোমধ্যে মানিকছড়িতে হালদা নদীর সংশ্লিষ্ট সুফলভোগীদের সাথে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নদীটির পূর্বের ও বর্তমান অবস্থার সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। পূর্বে নদীটির নাব্যতা (উৎসমুখ হতে রামগড় অংশের বেলছড়ি পর্যন্ত) বেশি থাকলে বর্তমানে তা একেবারেই কমে এসেছে এবং শুষ্ক মৌসুমে হালদা নদীর পানি সেচকাজে ব্যবহারের ফলে নাব্যতা হ্রাসের কারণ হিসেবে উঠে আসে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, হারদা নদীর উৎপত্তিস্থল এলাকায় পাহাড় কাটারোধ, বৃক্ষনিধন, জনবসতি স্থাপনসহ অন্যান্য ক্ষতিকর কার্যক্রম রোধে এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হলে নদীটির উৎপত্তিস্থলের পূর্বের পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সহজ হবে।
প্রকল্প পরিচালক মুহাম্মদ মিজানুর রহমান নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, এই নদীকে নিয়ে চাহিদাভিত্তিক গবেষণা আমরা করব। ৪০ জন পাহারাদার নিয়োগ দেয়া হবে পুরো অভয়াশ্রম এলাকায় নজরদারির জন্য। তাদেরকে সুনির্দিষ্ট এরিয়ার দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেয়া হবে এবং জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে। বিদ্যমান ৬টি মৎস্য হ্যাচারি আধুনিকায়নের পাশাপাশি সম্প্রসারণ করা হবে বলেও তিনি জানান। তিনি বলেন, হালদা এক ইউনিক নদী যেখানে জোয়ার-ভাটা আছে, রুইজাতীয় মাছ আছে, আবার ডলফিনও আছে, যা গোটা বিশ্বের মধ্যে এই নদীকে এক অনন্য বৈশিষ্ট্য সমৃদ্ধ করেছে। এই নদীর উৎপত্তি হয়েছে বাংলাদেশে, আবার শেষও হয়েছে বাংলাদেশে। নদীর উৎসমুখকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করার জন্য ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আছে একটা নদীর উৎসমুখ দেখার। সরকার ইতোমধ্যে হালদা নদীকে মৎস্য হ্যারিটেজ ঘোষণা করেছে। এই নদীকে ইউনেস্কো হ্যারিটেজে নেয়া সম্ভব বলেও তিনি মন্তব্য করেন। ভূজপুর রাবার ড্যামের মাধ্যমে কার্যত এই নদীকে খুন করার মতো একটি ঘটনা বলেও তিনি জানান। প্রকল্প মেয়াদে নদী ব্যবস্থাপনার একটি সমৃদ্ধ গাইড লাইন তৈরি করা হবে এবং এই গাইডলাইন সারা দেশের নদীগুলোর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করবে বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রামের পওর বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, হালদার প্রজনন ক্ষেত্রে রেনু আহরণ কমে যাওয়ার পেছনে শুধু যে ভূজপুর রাবার ড্যাম দায়ী তা নয়। বরং হালদার ৫-৬টি বাঁক তথা কুমগুলো কেটে সোজা করে ফেলাতে প্রজননস্থল ধ্বংস হয়েছে। তা ছাড়া হালদা নদীর সংযোগ খালগুলোতে মা মাছের প্রজনন উপযোগী পরিবেশ না থাকা এবং হালদার উজানে ব্যাপকহারে পাহাড় কাটার ফলে বর্ষায় ব্যাপক হারে পলিমিশ্রিত পানি হালদায় এসে পড়ে। ফলে এ ধরনের পলি মিশ্রিত পানিতেও মা মাছেরা ডিম ছাড়ার পরিবেশকে বিঘিœত করছে বলে তার ধারণা
হালদা নদীর মৎস্য সম্পদের ওপর পিএইচডি করা সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আরশাদ উল আলম নয়া দিগন্তকে বলেন, ইউনেস্কো হ্যারিটেজ করতে নদীর প্রাকৃতিক পরিবেশকে অক্ষত রাখতে হবে। হ্যারিটেজ হওয়ার ক্ষেত্রে ভূজপুর রাবার ড্যাম সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তার মতে যদিও রাবার ড্যামের কারণে শুধু বড় মাছের মাইগ্রেশন ব্যাহত হওয়া ছাড়া বড় ধরনের ক্ষতি দেখছেন না তিনি।