অঙ্কুরেই নিভে গেল রোহানের স্বপ্ন
- বাসস
- ১২ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১০
এইচএসসি পরীক্ষার্থী মো: রোহান আহমেদ খানের স্বপ্ন ছিল সেনা কর্মকর্তা হওয়ার; কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয় তখন ১৯ জুলাই পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছে সে।
বাবা-মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা এবং পারিবারিক বন্ধনকে উপেক্ষা করে রোহানের মতো অনেক কিশোর-কিশোরীই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। তাদের এই প্রতিবাদ একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার যৌথ আন্দোলনে রূপ নেয়। যার মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার ১৬ বছরের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটে।
গত ১৯ জুলাই বেলা আড়াইটার দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানা এলাকার কাজলায় আন্দোলনকারীদের মধ্যে পানির বোতল বিতরণ করছিল রোহান। এ সময়ে বুকে গুলি লাগলে গুরুতর আহত হয় সে। হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। শৈশব থেকেই রোহান প্রবল উচ্চাকাক্সক্ষী এবং পরোপকারী ছিল। সদাচরণ দিয়ে প্রতিবেশী, বন্ধু, শিক্ষক এবং সতীর্থদের মন জয় করেছিল। এ কারণেই রোহানের মৃত্যুর সংবাদে তার ঢাকার এবং চাঁদপুরের প্রতিবেশীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে।
রোহানের বাবা মো: সুলতান খান যাত্রাবাড়ীর দনিয়ার গোয়ালবাড়ি মোড় এলাকায় বাসার পাশে একটি মুদি দোকান চালান। তিনি বলেন, যখন রোহানের লাশ বাসার পাশে বায়তুস সালাম মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন সর্বস্তরের মানুষ সেখানে ভিড় জমায় এবং তার প্রতি নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করে। আমরা প্রতিবেশীদের শেষবারের মতো দেখানোর জন্যই রোহানের লাশ মসজিদে নিয়েছিলাম; কিন্তু রোহানের সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব এবং শিক্ষকসহ হাজার হাজার মানুষ তাকে শেষবারের মতো দেখার জন্য মসজিদে ভিড় করে এবং সেখানে তার প্রথম নামাজে জানাজায় অংশ নেয়।
রোহান ২০২২ সালে এ কে স্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর দনিয়া কলেজে ভর্তি হয়। এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সাতটি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল; কিন্তু অসুস্থতার কারণে একটি পরীক্ষা ভালো হয়নি। ফলে এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয় সে। তবে যেসব পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল তার ভিত্তিতে দেখা যায়, বিজ্ঞান বিভাগের তিনটি বিষয়ে জিপিএ ৫ পেয়েছে এবং বাকি তিনটিতে জিপিএ ৪ পেয়েছে।
মা মনিরা বেগম একজন অনানুষ্ঠানিক আরবি শিক্ষক। তিনি জানান, রোহান শুরু থেকেই আন্দোলনে অংশ নিতো; কিন্তু তারা জানতেন না। নিজের এক ছাত্রের মায়ের মাধ্যমে প্রথম রোহানের আন্দোলনে যাওয়ার কথা জানতে পারেন।
তিনি বলেন, ‘প্রথম যে দিন রোহান আন্দোলনে যায় সে দিন সে আমাকে বলেছিল সে কলেজের একটি অনুষ্ঠানে যাচ্ছে; কিন্তু ১৬ জুলাই আমার এক ছাত্রের মায়ের কাছে জানতে পারি, তাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিতে দেখা গেছে। বিষয়টি তাকে জিজ্ঞেস করলে প্রথমে সে অস্বীকার করে।
অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমি তাকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করলে সে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। বলে, যখন আমার অনেক ভাই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে, তখন তো আমি আর ঘরে বসে থাকতে পারি না।
গত ১৭ জুলাই রোহান আন্দোলনে অংশ নিলে সে দিন তার পায়ে ইটের আঘাত লাগে। এতে আহত হলে মায়ের কাছে আন্দোলনে যোগ দেয়ার কথা স্বীকার করে এবং পায়ের একটা এক্সরে করার কথা বলেছিল।
আবু সাঈদ ও মীর মুগ্ধর মৃত্যুতে রোহান অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিল উল্লেখ করে মনিরা বেগম বলেন, ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় সে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল- আবু সাঈদ আর মুগ্ধ ভাইকে দেখো। তাদের হত্যা করা হয়েছে। আমরা সবাই যদি ঘরে বসে থাকি এবং একে অপরকে আন্দোলনে যোগ দিতে বাধা দিই, তাহলে আমরা কিভাবে স্বাধীনতা অর্জন করব? আমাকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে একপর্যায়ে জিজ্ঞেস করছিল, ‘তুমি কি রাজাকার?’ এটা শুনে আমি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলি।
তিনি জানান, ১৯ জুলাই শুক্রবার রোহান জুমার নামাজের আজানের আগ পর্যন্ত ঘরের কাজ শেষ করতে তাকে সাহায্য করেছিল।
তিনি কান্না সংবরণ করতে করতে বলেন, আমি ছেলের মৃত্যুর আগে তার প্রিয় খাবার খাওয়াতে পারিনি, এই কষ্ট কী করে ভুলব?
মনিরা বেগম জানান, এরপর রোহান জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে যায় এবং বাড়ি ফিরে আসে। বাড়িতে আসার পর পাঞ্জাবি খুলে কলেজের আইডি কার্ড, মানিব্যাগ, পকেট টিস্যু ও গেটের চাবি নিয়ে দুইটার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। বেলা আড়াইটার দিকে একজন অচেনা লোক আমাকে ফোনে জানায় যে, রোহান গুরুতর আহত এবং আমাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে যেতে বলে। এ খবর পাওয়ার পর তিনি হতবিহ্বল হয়ে পড়েন এবং কোনোমতে স্বামীকে বিষয়টি জানান।
রোহানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার টেবিলে স্কাউটের ইউনিফর্মসহ একটি ছবি এবং বাংলাদেশ স্কাউটসের সম্মাননা স্মারকসহ সব বই এবং জিনিসপত্র একইভাবে রাখা আছে। তার টেবিলেই একটি কুরআন শরীফ রাখা। যা সে পাঠ করত। কুরআন শরীফে রোহানের দেয়া চিহ্নটি দেখিয়ে তার মা বলেন, ‘এখন আমি এই কুরআন তিলাওয়াত করি; কিন্তু আমি আমার ছেলের দেয়া চিহ্ন সরাইনি। এটা আমার ছেলের স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছি।’
রোহানের বাবা মো: সুলতান জানান, তার দুই সন্তানের মধ্যে রোহান ছোট ছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার বিষয়ে রোহান অত্যন্ত আশাবাদী ছিল। তার বিশ্বাস ছিল, স্কাউটসের সাথে সম্পৃক্ততা তাকে একজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেতে সাহায্য করবে।