কন্ট্র্যাক্ট ট্রেসিং করতে না পারায় নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডেঙ্গু
- হামিম উল কবির
- ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৩
চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তদের সংখ্যা তুলনামূলক কম হলেও ভয়াবহতা কম নয়। রোববার পর্যন্ত নভেম্বরের এক-তৃতীয়াংশ সময় চলে গেলেও ডেঙ্গুর প্রকোপ মোটেও কমেনি। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, যিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন তার বসবাসকৃত এলাকায় যারা বসবাস করেন তাদের বাড়িঘর চিহ্নিত করে (কন্ট্র্যাক্ট ট্রেসিং) মশা দমনে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেয়া হচ্ছে না বলে ডেঙ্গু জীবাণু বহনকারী এডিস মশা সঠিকভাবে দমন করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে মানুষ ডেঙ্গু থেকেও মুক্তি পাচ্ছে না। নির্বিচারে শুধু ফগিং, লার্ভিসাইডিং করলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নিতে হবে। উল্লেখ্য, ৯ নভেম্বর পর্যন্ত চলতি বছর সারা দেশে সাড়ে ৩০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে এবং আক্রান্তদের মধ্যে ৭১ হাজার ৫৬ জন তালিকাভুক্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। ২০২৩ সালের চেয়ে সংখ্যার দিক থেকে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা কম হলেও ভয়াবহতার দিক থেকে কম নয় বলে জানান জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ও অধ্যাপক ড. মো: গোলাম ছারোয়ার। তিনি বলেন, ‘গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা অন্যান্য বছরের চেয়ে মোটেও কম ছিল না। তবে মে থেকে জুন মাস পর্যন্ত মোটামুটি স্বস্তির সময় থাকলেও আবার জুলাই থেকে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। প্রচলিত যে পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে এভাবে ডেঙ্গু তথা মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এভাবে মশা দমন করতে পারছি, এটা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। কারণ স্বাস্থ্য অধিদফতর মশার জরিপ করে সিটি করপোরেশনকে দিলেও সিটি করপোরেশন সেভাবে এলাকা চিহ্নিত করে কীটনাশক প্রয়োগ করে না।’
অধ্যাপক ড. মো: গোলাম ছারোয়ার বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে কন্ট্র্র্যাক্ট ট্রেসিং করে আক্রান্ত ব্যক্তির বাড়ি ও আশপাশের এলাকায় সম্পূর্ণরূপে মশা মারতে ফগিং, পানিতে থাকা লার্ভা ধ্বংস করতে লার্ভিসাইডিং করতে হবে এবং একই সাথে এলাকার মানুষকে সাথে নিয়ে মশা জন্মানোর পরিবেশ ধ্বংস করে দিতে হবে। তাহলে সেই এলাকায় ডেঙ্গু জীবাণুবাহী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব; কিন্তু এখন যেভাবে ডেঙ্গু তথা মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হচ্ছে সেটি বৈজ্ঞানিকভাবে করা হচ্ছে না বলে মনে করেন কীটতত্ত্ব¡বিদরা।’
শুধু ডেঙ্গু আক্রান্তদের বাড়িঘরের চার পাশে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নিলেই চলবে না, যেসব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয় সেসব হাসপাতালের আশপাশে মশা নিয়ন্ত্রণে সবধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। অপর দিকে মশা ধ্বংসে যেসব কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে কিছুদিন পরপর সেগুলোর কার্যকারিতা (এফিকেসি) পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এ প্রসঙ্গে কীটতত্ত্ব¡বিদ ড. গোলাম ছারোয়ার বলেন, একটা কীটনাশক দীর্ঘ দিন ব্যবহার করা হলে মশা ওই কীটনাশকের বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিরোধী ব্যবস্থা গড়ে তোলে। বাংলাদেশে যেসব কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলো মশা ধ্বংসে অকার্যকর হয়ে গেলো কি না তা কিছুদিন পরপর পরীক্ষা করতে হবে। এমনও হতে পারে সরবরাহকারী কীটনাশক কোম্পানি অকার্যকর কীটনাশক দিতে পারে। অন্য দিকে মশার মধ্যে ওই কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে কি না সেটিও দেখতে হয়।
উল্লেখ্য, চলতি বছর ডেঙ্গুর সেরোটাই-২ দ্বারা মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। সেরোটাইপ-২ এডিস এলবুপিকটাস ও এডিস এজিপ্টাই প্রজাতি বহন করে। একজন মানুষ একবার একটি সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত হলে তার মধ্যে ওই একই সেরোটাইপ দ্বিতীয়বার প্রবেশ করতে পারে না। কারণ আক্রান্তের দেহে ওই সেরোটাইপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে; কিন্তু অন্য কোনো সেরোটাইপ দিয়ে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। দ্বিতীয় ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে তার অবস্থা মারাত্মক হয়ে থাকে। সে কারণে কীটতত্ত্বদিরা পরামর্শ দিয়েছেন, ডেঙ্গু থেকে বেঁচে থাকতে সবসময় সতর্ক থাকতে। মশারি টানানো ছাড়া কখনো ঘুমানো যাবে না।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত শুক্রবার সকাল থেকে গতকাল শনিবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে আটজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ১৩৪ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৪৯ জন, ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন আরো ৪৮৫ জন। চলতি বছর আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ৩৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে তাদের মধ্যে ৪৮.৬ শতাংশ পুরুষ এবং ৫১.৪ শতাংশ নারী।