ঝরে পড়া মেধা লালনে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্বপ্নবাজ আব্দুর রশিদের
- ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৩
‘মেধা ঝরতে দেবো না, অর্থের অভাব হবে না’ এ স্লোগানকে সামনে রেখে ঝরেপড়া মেধাবী শিক্ষার্থীদের তুলে এনে লেখাপড়া শিখিয়ে নীরবে, নিভৃতে মেধা লালনের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন প্রচারবিমুখ ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার কৃতী সন্তান আলহাজ মো: আব্দুর রশিদ। তার হাতেগড়া আসপাডা পরিবেশ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ক্ষুদ্রঋণ, দারিদ্র্য দূরীকরণ, পরিবেশ ও প্রান্তিক মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, কৃষিভিত্তিক কর্মসংস্থান এবং শিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে সমাজ বিনির্মাণে ৩০ বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তিনি আসপাডার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী পরিচালক। তিনি একজন কবি, মানবিক সমাজকর্মী ও বিদ্যোৎসাহী শিক্ষানুরাগী। ১৯৫৬ সালের ১৭ অক্টোবর ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার জামির দিয়া গ্রামের মাষ্টারবাড়ীর সম্ভ্রান্ত মাষ্টার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৯৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘আসপাডা পরিবেশ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন’।
মাত্র ৬২০ টাকা নিয়ে শুরু করা প্রতিষ্ঠানের বর্তমান তহবিল ৬২০ কোটি টাকা। প্রতি বছর ৪০০ মেধাবী শিক্ষার্থীর লেখাপড়া ও পরিবারের খরচ বহনে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করছে কোটি টাকার বেশি। বৃত্তিপ্রাপ্ত ১৭০ জন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী বিসিএস ক্যাডারে চাকরি করছেন। স্বামী পরিত্যক্তা ও বিধবাসহ ৪৫০ জন নারী প্রশিক্ষণের গার্মেন্টে চাকরি করছেন। ৯৫০ জন নারী সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আসপাডার সহায়তায় ২৮ জন ভিক্ষুক নারী-পুরুষ ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে ব্যবসায়ী হয়ে সচ্ছল জীবন যাপন করছেন। ৪০ জন রাজমিস্ত্রী ও ৩০০ কৃষক আর্থিকভাবে সচ্ছলতা অর্জন করেছেন। ৩০ লাখের অধিক গাছ রোপণ করা হয়েছে। ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করতে ১১ বছর ৩০০ স্কুল পরিচালনা এবং ভালুকার ভন্ডাবো গ্রামে ‘সারা মানবিক বৃদ্ধ আশ্রম’ এবং ‘মা আমেনা খাতুন এতিমখানা ও মহিলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সহোদর হাজী রফিক ও বাদশার সহযোগিতায় এক একর জমিতে দাদার নামে প্রতিষ্ঠিত আব্দুল গণি মাস্টার স্কুল অ্যান্ড কলেজে এখন ৯০০ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। বিনামূলে চোখের ছানি অপারেশন করে এক হাজার মানুষের চোখে আলো দেখিয়েছেন।
বিশ্বব্যাংক ও পিকেএসএফ’র সহযোগিতায় আসপাডার মাধ্যমে পাঁচ হাজার হতদরিদ্র পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে। তিন হাজার নারীকে কলা, পেঁপে, সবজি চাষ করে দুই বছরের ব্যবধানে দরিদ্রতা দূর করেছেন। এ ছাড়াও আসপাডা স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করছে এবং দেশের বাইরে নরওয়ের জাতীয় সংসদের তত্ত্বাবধানে ও আর্থিক সহায়তায় নেপাল, ইন্ডিয়া ও কম্বোডিয়ায় এক্সপেরিয়েন্স শেয়ারিংয়ের কার্যক্রম চলছে। ব্যক্তিগতভাবে প্রতি মাসেই ব্যক্তি, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান এক/দুই লাখ টাকা দান-অনুদান ও সহায়তা যাচ্ছে।
তিনি মনে করেন, অন্যের মুখে হাসি দেখে নিজের মুখে হাসি আসবেই। আর এটাই মুনের সুখ এবং আনন্দ। ভবিষ্যতে উন্নত চিকিৎসাসেবার লক্ষ্যে নেপালের ‘সহমতি কমিউনিটি হাসপাতালের আদলে শেয়ারভিত্তিক একটি আধুনিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছেন এই স্বপ্নবাজ দুরদর্শী দৃষ্টিসম্পন্ন মানবদরদী আব্দুর রশিদ। ইতোমধ্যে তিনি ২৩ কোটি টাকা তহবিল সংগ্রহ করেছেন। তার মতো গুণীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আজও মূল্যায়ন করা হয়নি। তার সাথে একান্ত আলাপচারিতার কথাগুলো তুলে ধরেছেন নয়া দিগন্ত’র ময়মনসিংহ অফিসের স্টাফ রিপোর্টার সাইফুল মাহমুদ।
নয়া দিগন্ত : আসপাডা প্রতিষ্ঠার পেছনের গল্পটা কী এবং কীভাবে পথচলা শুরু হলো?
আব্দুর রশিদ : বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. লুৎফর রহমান, প্রফেসর ড. শাহ-ই-আলম, প্রফেসর ড. তারেক এবং আমার দুই বন্ধু আড্ডায় ছিলাম। কথায় কথায় আমি বললাম, গ্রামাঞ্চলে জৈব সার ‘গোবর’ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমরা যদি নার্সারি করে কৃষকদের মাঝে গাছের চারা বিক্রি করি তবে কৃষকের লাভ হবে তিনটি। ১০-১৫ বছর পর গাছ বিক্রি করে টাকা পাবে। গাছের পাতা ও ডালপালা জ্বালানির অভাব মিটাবে এবং পরিবেশ ভালো থাকবে। এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ১৯৯৩ সালে গঠন করা হলো- ‘এগ্রোফরেস্ট্রি সিড প্রোডাকশন অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (অঝচঅউঅ)। বাংলায় নামকরণ করা হয়, ‘আসপাডা পরিবেশ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন’। তাৎক্ষনিক মাত্র ৬২০ টাকা নিয়ে আসপাডার যাত্রা শুরু হয়। বিগত ৩০ বছরে এখন আসপাডার তহবিল হয়েছে ৬২০ কোটি টাকা। এই অর্জন আসপাডা সহকর্মীদের নিরলস পরিশ্রমের ফসল।
নয়া দিগন্ত : আসপাডার এমন বিশাল অর্জনের পেছনেও কী গল্প আছে?
আব্দুর রশিদ : পৃথিবীর সব সৃষ্টির পেছনে একটা গল্প থাকেই। জাকাতের ৬০ হাজার টাকা ছিল মূলধন। আমি বললাম, ‘এই টাকা গরিবদের ঋণ দেবো বিনালাভে। ওই টাকায় ছাগল, গরু ক্রয় করে লালন-পালন করবে। এক বছর পর আসল টাকা ফেরত দিবে।’ বাকৃবি’র পার্শ্ববর্তী ছালাকান্দি ও বয়রাকান্দি গ্রামের ১০০ জনকে বাছাই করে এক হাজার টাকা করে ঋণ দেয়া হলো। বলা হলো, গরু ও ছাগলের বাচ্চা কিনে লালন-পালন করে এক বছর পর বিক্রি করে টাকা ফেরত দিতে হবে। বছর শেষে মাত্র ২২ জন টাকা ফেরত দিয়েছেন। অন্যরা গরু-ছাগল বিক্রি করে খেয়ে ফেলেছে। তারা বলল, একসাথে এক হাজার টাকা ফেরত দিতে পারবে না। কিস্তি করে দেয়ায় ১০ মাসে সবাই টাকা পরিশোধ করে দিলো।
এরপর এক লাখ ৮৭ হাজার টাকা নিয়ে ঋণ কার্যক্রম শুরু করি। প্রথম ঋণদান শেষে যখন দ্বিতীয় ঋণ দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না তখন আমি আসপাডাকে পাঁচ লাখ টাকা পাঁচ বছরের জন্য বিনা লাভে ঋণ দেই। ঋণের অনাদায়ে ভর্তুকি দিয়েছি কিন্তু সংস্থার বকেয়া দেখানো হয়নি। প্রথম বছর ভর্তুকি দিলাম ৬০ হাজার টাকা এবং সয়াবিন চাষে ও বীজ ধানে চার লাখ টাকা। এরপর আর বকেয়াও পড়েনি, লোকসানও হয়নি। ১৯৯৭ সালে পিকেএসএফ’র সহযোগী সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর বিশ্বব্যাংক ও পিকেএসএফের সহযোগিতায় পাঁচ হাজার হতদরিদ্র পরিবারকে স্বাবলম্বী করেছি। স্বামী পরিত্যক্তা ও বিধবাসহ ৪৫০ জন নারীকে মাসব্যাপী গার্মেন্ট প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রত্যেককে নতুন জামা পরিয়ে বাসে করে বিভিন্ন গার্মেন্ট নিয়ে চাকরি দেয়া হয়েছে। আজকে ২০ জনের চাকরি হয়েছে অন্যদের আরেকদিন অন্য গার্মেন্টে চাকরির জন্য ছুটতে হয়েছে। এভাবে চার মাসে ৪৫০ জনের চাকরি দেয়া হয়।
৯৫০ জনকে এক মাস সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে ব্যবসার জন্য ঋণ সহায়তাসহ একটি করে সেলাই মেশিন দেয়া হয়। এরাও এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখেই দিনাতিপাত করছেন। তিন হাজার মহিলাকে কৃষি বিষয়ক কলা, পেঁপে, সবজি চাষে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। দুই বছরের ব্যবধানে এরাও আর হতদরিদ্র থাকেনি। ৭০ জন ভিক্ষুককে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষার বদলে পণ্য বিক্রি করে আয় করার জন্য অর্থ দেয়া হয়। এরা ভিক্ষার বদলে খাঁচা বা ঝাঁকাভর্তি পণ্য মাথায় নিয়ে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করে ভিক্ষার চেয়ে দ্বিগুণ আয় করে। এভাবে ২৮ জন ভিক্ষুক নারী-পুরুষ ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে ব্যবসায়ী হয়ে সচ্ছল জীবনযাপন করছেন।
নয়া দিগন্ত : পরিবেশ, স্যানিটেশন ও কৃষিভিত্তিক কার্যক্রমের সফলতা কেমন ছিল।
আব্দুর রশিদ : পরিবেশ নিয়েই তো আমাদের যাত্রা শুরু। নার্সারি স্থাপনের মাধ্যমে ও বনবিভাগের সাথে যুক্ত থেকে ৩০ লাখের অধিক গাছ রোপণ করেছি। বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। ২০০১ সালে আমার এক কর্মী আতিকুলের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে প্রকৃতির ডাকে বাথরুমে যেতে চাইলাম। সে আমাকে একটি জঙ্গল দেখিয়ে দিলো। সেই জঙ্গলের এখানে সেখানে মল ছড়িয়ে রয়েছে। একটু আড়ালে যেতেই দেখি, এক মহিলা বসে আছে। অন্যদিকের ঝোঁপে এক পুরুষ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছেন। আমি আর বাথরুম করতে পারলাম না। ভাবলাম, কি করতে পারি? বাড়ি বাড়ি স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন দরকার। কিভাবে সম্ভব? ৪০টি গ্রাম থেকে ৪০ জন রাজমিস্ত্রি বাছাই করলাম। তাদের স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ল্যাট্রিন তৈরির জন্য একমাস প্রশিক্ষণ দিলাম। প্রতিদিন প্রত্যেককেই তিন বেলা খাবার ও নগদ ৫০ টাকা করে দেয়া হয়। ল্যাট্রিনের চাক ও স্ল্যাব তৈরির জন্য ঋণসহায়তা দেয়া হয়। আসপাডার সদস্যদের জানিয়ে দেয়া হয়, ঋণ পেতে হলে ১৬০ টাকায় ল্যাট্রিন কিনতে হবে। এভাবে ‘রথ দেখা আর কলা বেচা’র ব্যবস্থা করা হলো। বাড়ি বাড়ি স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন স্থাপন করা হলো এবং ৪০ জন রাজমিস্ত্রির ব্যবসা করে সফল হলেন।
নয়া দিগন্ত : কৃষি নিয়ে আসপাডা কি ধরনের কাজ করছে?
আব্দুর রশিদ : পরিবেশবান্ধব কৃষির জন্য আমরা অর্গানিক খাবার তৈরি করছি। ‘বাংলাদেশের কৃষি পরিবারের যুবক-যুবতীরা এসো লড়ি, চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করে কৃষি উৎপাদনে বাণিজ্য গড়ি’ এ স্লোগানকে ধারণ করে ৪০ জন কৃষক নিয়ে একটি করে ‘কৃষক দল’ গঠন করেছি। প্রতিটি দলের জন্য দু’টি ট্রাক্টর, একটি রাইসপ্লান্টার, একটি হারভেস্টর দেয়া হয়েছে। স্বল্প খরচে কৃষি কাজ সম্পন্ন এবং প্রতিটি যন্ত্রের জন্য একজন লেবারের কর্মসংস্থান হয়েছে। কৃষক-কৃষানীরা দুই বা আড়াই একর জমিতে ধানচাষের পাশাপাশি কলা, পেঁপে, সবজি চাষ ও গাভী পালন করে বছরে ৪-৫ লাখ টাকা আয় করছেন। বর্তমানে ৩০০ কৃষক ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা ঋণ সুবিধা নিয়ে গাভী পালন করছেন। গরুর গোবর পচিয়ে জৈব সারের মাধ্যমে অর্গানিক খাবার ও বেশি ফসল উৎপাদন করতে পারছেন। গরুর খাবারের জন্য ঘাস চাষ ও ধানের খড়ের ব্যবস্থাও করে দেয়া হয়েছে।
নয়া দিগন্ত : আসপাডা সবচেয়ে আলোচিত ‘শিক্ষাবৃত্তি’র গল্পটাও জানতে চাই। শিক্ষাবৃত্তির কী প্রভাব পড়েছে ?
আব্দুর রশিদ : শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রথমে ঝরেপড়া শিশুদের স্কুলমুখী করার জন্য ব্র্যাকের সহযোগিতায় ৩০০ স্কুল করেছি। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাসের পড়া ক্লাসেই শেষ করার ব্যবস্থা করেছি। ১১ বছর সেই স্কুল চালু ছিল। ২০০৮ সালে আমার বাড়ি ‘ওয়াটার হাউজ’ তৈরির সময় হঠাৎ চোখে পড়ল এক রাজযোগালী দ্রুত কাজ করছে। আমি কন্ট্রাকটর তরিকুলকে বললাম, ‘তুই যদি ওই ছেলের মতো কাজ করার লোক তৈরি করতে পারিস তবে বেশি লাভবান হবে।’ উত্তরে তরিকুল বলে, ‘স্যার ওই ছেলেটি ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছিল, ক্লাস সেভেনে উঠতেই তার বাবা মারা যায়, তার মা-বোনকে খাওয়ানোর জন্য পড়ালেখা বাদ দিয়ে আমার সাথে রাজযোগালীর কাজ করছে ছয় মাস ধরে।’ আমি ছেলেটির কাছে গিয়ে জানতে চাই, ‘মামুন তুমি কি পড়তে চাও?’ উত্তরে মামুন বলল, ‘স্যার আমি পড়ালেখা করলে মা-বোনকে খাওয়াবে কে? আপনি যদি আমাকে মাসে ২৫০০ টাকা দেন তাহলে আমি মাকে ১৫০০ টাকা দিবো আর আমি এক হাজার টাকা দিয়ে পড়ালেখার খরচ চালাব।’ ওর কথা থেকেই আমার মাথায় শিক্ষাবৃত্তির ধারণা আসে।
‘মেধা ঝরতে দেবো না, অর্থের অভাব হবে না’ এই মনোভাব নিয়ে ২০০৮ সাল থেকে ৪০০ ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার খরচ চালিয়ে যাচ্ছি। যখনই মেধাবী ছাত্রের পড়া বন্ধ হয়ে গেছে, তাকে মাসিক শিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে লেখাপড়ার শেষ পর্যন্ত খরচ বহনের ব্যবস্থা করেছি। যাকে বৃত্তি দিবো তার লেখাপড়া শেষ করতে ৪/৫ লাখ টাকা লাগলেও দিবো। আমি মামুনকে ২৫০০ টাকা দিয়ে বললাম, ‘কাল থেকেই স্কুলে যাবে।’ সেই মামুন লেখাপড়া শেষ করে এখন উপজেলা কৃষি অফিসার।
আমার দাদার নামে প্রতিষ্ঠিত আব্দুল গণি মাস্টার উচচ বিদ্যালয়ে গেলাম। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এবং সভাপতি হিসেবে ছাত্রদের পড়ালেখার খোঁজখবর নিতে ক্লাস সেভেনের কক্ষে ঢুকি। দেখি ‘ফাস্ট বয়’ আশরাফ ও ‘সেকেন্ড বয়’ হাবিব ক্লাসে নেই। প্রধান শিক্ষক আফজাল সাহেবকে বললাম কেন আপনার ছাত্র ক্লাসে আসেনি তার খবর নিয়েছেন? তিনি বললেন, ‘স্যার ওদের বাবা মারা যাওয়ায় ওরা এখন পরিবারের ঘানি টানতে অন্যের বাড়িতে মাসিক ‘কামলা’ দিচ্ছে।’ আমি বললাম, ‘আপনি আমাকে জানালেন না কেন? এক্ষুনি ওদের খুঁঁজে নিয়ে আসুন, আমি স্কুলেই আছি।’ প্রধান শিক্ষক দফতরিকে সাথে নিয়ে গিয়ে আশরাফ ও হাবীবকে নিয়ে আসেন। আমি তাদের পরিবারের খরচসহ শিক্ষার খরচ বহনের কথা বলায় ওরা আবার স্কুলে পড়ালেখা শুরু করল। সেই আশরাফ এখন বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডারে অফিসার হয়েছে। আর সেই হাবীব এখন এমবিবিএস ডাক্তার।
কয়দিন পর উথুরা গ্রামের রবিউল ইসলাম রবি ও শারফিন আহমেদ নামে দুই ছেলে আমার বাসায় এসে বলে ‘স্যার আমরা পড়তে চাই।’ বললাম সমস্যা কী? বলল, ‘স্যার সকালে না খেয়ে স্কুলে যাই। বিকেলে বাড়ি এসে দেখি খাবার নাই। বাবা বলে অন্যের বাড়ি কাজ করতে। আমি অন্যের বাড়িতে কাজ করতে চাই না, আমি পড়তে চাই।’ তাদের আকুতি ও প্রতিভা বুঝে দু’জনকে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা দিলাম খাবারের জন্য। বললাম এখন থেকেই তোমরা প্রতি মাসে ২৫০০ টাকা করে পাবে পড়ালেখা ও খাবার বাবদ। সেই শারফিন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্ব¡ বিভাগে ‘ফাস্ট ক্লাস থার্ড’ হয়ে স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় পড়ালেখার পাশাপাশি চাকরি করছে। এভাবে ঝরেপড়া ৪০০ ছেলেমেয়ের জন্য বছরে এক কোটি টাকার বেশি বৃত্তি বাবদ দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১৩ জন ডাক্তার হয়েছেন। অনেকেই ডাক্তারি পড়ছেন। বুয়েট, রুয়েট, চুয়েট থেকে পাস করে চাকরিও করছেন অনেকে। বিসিএস অফিসার হয়েছেন সাতজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট’ হয়ে লেকচারার হয়েছেন একজন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট’ হয়ে একজন লেকচারার হয়েছেন।
বর্তমানে ১৭০ জন পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করছে ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বাকি ২৩০ জন লেখাপড়া করছেন ক্যাডেট কলেজসহ বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষাবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের কাছে আমাদের কোনো দাবি নেই, দাবি একটাই তারা যেন চাকরিজীবনে একজন গরিব মেধাবী ছাত্রের পড়ালেখার দায়িত্ব নিয়ে খরচ বহন করে।
নয়া দিগন্ত : আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য নয়া দিগন্ত’র পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
আব্দুর রশিদ : আপনাকেসহ নয়া দিগন্ত’র পাঠক, কলা-কুশলী, বিজ্ঞাপনদাতা ও শুভানুধ্যায়ীকে আসপাডা ও আমার পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।