উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ভরসা এনসিডি কর্নারে ওষুধের ঘাটতি
আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা নিচ্ছে মাত্র ৩৮ শতাংশ-ডব্লিউএইচও- হামিদ সরকার বরিশাল থেকে ফিরে
- ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১৫
দেশের বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্থাপিত অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (এনসিডি) কর্নারের পাশাপাশি ইতোমধ্যে বেশ কিছু কমিউনিটি ক্লিনিক থেকেও বিনা মূল্যে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ দেয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু ওষুধ সরবরাহে ছন্দপতনের কারণে সেবা দিতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো। সময়মতো ওষুধ না পাওয়ায় রোগীরাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। এনসিডি কর্নারগুলোতে ওষুধ সরবরাহ ঠিক থাকলে উচ্চ রক্তচাপসহ অসংক্রামক রোগগুলো থেকে দেশের মানুষকে বের করে আনা সম্ভব সংশ্লিষ্টরা জানালেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের (৩০-৭৯ বছর বয়সী) অর্ধেকই জানে না যে তাদের এ সমস্যা রয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে চিকিৎসা সেবা গ্রহণের হার খুবই কম, মাত্র ৩৮ শতাংশ (৩৪ শতাংশ পুরুষ, ৪২ শতাংশ নারী)।
সরেজমিনে বরিশালের উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেখা যায়, ২০২২ সালের ১৭ জুলাই সেখানে এনসিডি কর্নার চালু করা হয়। তখন থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন এমন এক হাজার ৩২৯ জন রোগী নিবন্ধন করে বই নিয়েছেন। উপজেলার কাজিরা গ্রামের শাহনাজ বেগম (৫০) দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ ডায়াবেটিক ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। শুরুর দিকে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেও এখন নিয়মিত আসছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তিনি জানান, গত বছর থেকে এনসিডি কর্নারে চিকিৎসকের পরামর্শ ও বিনা মূল্যে ওষুধ নেন তিনি। কিন্তু গত ৩ মাসে এনসিডি কর্নার থেকে ওষুধ পাননি। কিছু দিন ফার্মেসি থেকে কিনে খাওয়ার পর আর্থিক সঙ্কটে বন্ধ হয়ে যায় তার চিকিৎসা। কারণ সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম দোকান কর্মচারী ছেলের পক্ষে কর্মহীন অসুস্থ বাবা ও মায়ের ওষুধ কেনা সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে টানা ২০ দিনের মতো ওষুধ না খেয়েই থাকতে হয়েছে তাকে।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা: রাখাল বিশ্বাস বলেন, চলতি বছরে ৩ মাস ওষুধ সরবরাহ না থাকায় রোগীদের দেয়া সম্ভব হয়নি। যার ফলে অনেকেই আর আসেননি। আবার বিনা পয়সায় ওষুধ পাওয়ার প্রত্যাশায় অন্য উপজেলা থেকে একবার এসে আর এখানে আসেন না এমনও হতে পারে। কেউ কেউ আবার দূরত্ব বেশি হওয়ায় রিকশা বা অটো ভাড়া দিয়ে উপজেলা কমপ্লেক্স পর্যন্ত আসতে আগ্রহী হন না। তিনি বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে কার্যকরী এবং ব্যয়-সাশ্রয়ী পদক্ষেপ হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে মাত্র ১৫ শতাংশ (১৪ শতাংশ পুরুষ, ১৫ শতাংশ নারী) অর্থাৎ প্রতি ৭ জনে ১ জন। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ২ লাখ ৭৩ হাজার মানুষ হৃদরোগজনিত অসুস্থতায় মৃত্যুবরণ করেছে, যার ৫৪ শতাংশের (৫১ শতাংশ পুরুষ, ৫৮ শতাংশ নারী) জন্য দায়ী উচ্চ রক্তচাপ। চিকিৎসার পথে এই রোগের ওষুধ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অধিকাংশ রোগীর ভালো ধারণা না থাকলেও এতে যে কোনো সময় প্রাণহানির ঝুঁকি অনেকাংশেই বেড়ে যায় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ না করার এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগজনিত অকাল মৃত্যু এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ লক্ষ্যে উচ্চ রক্তচাপ মোকাবিলায় সরকার সম্প্রতি কমিউনিটি ক্লিনিকের তালিকায় উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তবে উচ্চ রক্তচাপ ও উচ্চ রক্তচাপজনিত বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের ক্রমবর্ধমান প্রকোপ ও মৃত্যু নিয়ন্ত্রণ করতে এই সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে বাস্তবায়নের পাশাপাশি কমিউনিটি ক্লিনিক ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিরবচ্ছিন্ন ওষুধ সরবরাহ এবং এ খাতে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা: সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে দেশে অকাল মৃত্যুও কমে আসবে। কারণ অকাল মৃত্যুর প্রধান তিন কারণের অন্যতম উচ্চ রক্তচাপ। অকাল মৃত্যু কমাতে হলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হবে। সরকারের তো একটা টার্গেট আছে অকাল মৃত্যু এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা। এ জন্য নিরবচ্ছিন্ন ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। কারণ ওষুধ খাওয়ার পর বন্ধ করলে স্ট্রোক, হার্টঅ্যাটাকের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এতে যে কোনো সময় মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রান্তিক পর্যায়ে ওষুধ কিনে খেতে না পারলে ওষুধ সরবরাহ করা সরকারের দায়িত্ব।
কিছু রোগী অনিয়মিত হয়ে যাচ্ছে তাদের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে জানতে চাইলে ডা: সোহেল রেজা বলেন, এটা একটা চ্যালেঞ্জ। তবে ওষুধ শেষ হলে এখন তাদের মোবাইলে মেসেজ দেয়া হচ্ছে। এতে বেশ সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিকে উচ্চ রক্তচাপ ডায়াগনোসিস করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। পাশাপাশি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে টেলি মেডিসিনের ব্যবস্থা রাখা সম্ভব হলে রোগীদের ভোগান্তি অনেকটাই লাঘব হবে বলে আশা করি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (এনসিডিসি) ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ২০১৮ সাল থেকে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। যার উদ্দেশ্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত করা, চিকিৎসা প্রদান এবং ফলোআপ কার্যক্রম শক্তিশালী করা। ২৩ জেলার ১৮২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ৪টি সদর হাসপাতালের এনসিডি কর্নারে কার্যক্রমটি পরিচালিত হচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে তৃণমূল পর্যায়ে প্রকল্পটি আরো সফল করতে পরীক্ষামূলকভাবে সিলেট জেলার ৪টি উপজেলার (গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিশ্বনাথ এবং বিয়ানীবাজার) ৮৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে সরকারিভাবে বিনামূল্যে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ দেয়া শুরু হয়। উচ্চ রক্তচাপের ক্রমবর্ধমান প্রকোপ মোকাবেলায় কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের (সিসিএইচএসটি) কমিউনিটি ক্লিনিকে ব্যবহৃত ওষুধের তালিকা উচ্চ রক্তচাপের জন্য এমলোডিপিন ৫ মি: গ্রা: ও ডায়াবেটিসের জন্য মেটফরমিন ৫০০ মি: গ্রা: সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইতোমধ্যে দেশের দুই-তৃতীয়াংশ উপজেলার কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে বরিশাল বিভাগের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো থেকে রোগীদের ওষুধ দেয়া এখনো শুরু হয়নি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এনসিডি কর্নার থেকে ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা