সেমিনারের টাকায় হাওরে পিডির প্রমোদ ভ্রমণ!
- কাওসার আজম
- ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪৬
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (বিএফএসএ) একটি প্রকল্পের সেমিনারের টাকায় প্রমোদ ভ্রমণের অভিযোগ উঠেছে। বিএফএসএর ‘স্ট্রেনদেনিং দি ইন্সপেকশন রেগুলেটরি অ্যান্ড কো-অর্ডিনেশন ফাংশন অব দ্য বাংলাদেশ ফুড সেইফটি অথোরিটি (এসটিআইআরসি)’ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো: আখতার মামুনের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ। এই কর্মকর্তা আবার বিএফএএ-এর সচিবের দায়িত্বেও রয়েছেন। এর আগে তিনি আইসিটি বিভাগের লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের পিডি থাকাকালে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গুরুদণ্ড হিসেবে তিন বছরের বেতন গ্রেড অবনমনের সাজা দেয় সরকার।
জানা যায়, এসটিআইআরসি প্রকল্পের উদ্যোগে সুনামগঞ্জের ব্যবসায়ীদের নিয়ে আগামীকাল রোববার সেমিনার হওয়ার কথা। গত ১৬ অক্টোবর সেমিনারের সম্ভাব্য তারিখ ও বাজেট উত্থাপন করে এ সংক্রান্ত নথি অনুমোদন করে নেন পিডি মো: আখতার মামুন। সুনামগঞ্জের বিভিন্ন খাদ্য ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে নিরাপদ খাদ্যবিষয়ক অবহিতকরণ কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা হবে ৫০ জন। এজন্য বাজেট রাখা হয় আড়াই লাখ টাকা। প্রকল্প পরিচালক মো: আখতার মামুনের সভাপতিত্বে সেমিনার হওয়ার কথা। তবে, নির্দিষ্ট দিনের অনেক আগেই এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে উল্লেখ করে সুনামগঞ্জ জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনকে দিয়ে প্রায় দুই লাখ (১ লাখ ৯৯ হাজার ৫০০) টাকার বিল জমা দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, গত ৯ আগস্ট পিডি মো: আখতার মামুন ও সিলেট বিভাগের আরো কিছু কর্মকর্তা দেশের টালমাটাল অবস্থায়ও সুনামগঞ্জ ঘুরতে গিয়েছিলেন। বিএফএসএ সচিব ও এসটিআইআরসি প্রকল্পের পিডি মামুনকে সন্তুষ্ট করতে সুনামগঞ্জ জেলার নিরাপদ খাদ্য অফিসার একদিন ও এক রাতের একটি প্রমোদ ভ্রমণের আয়োজন করেন। এই প্রমোদ ভ্রমণকে সেমিনার দেখিয়ে প্রায় দুই লাখ টাকার বিল জমা দেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষে। এটিকে জায়েজ করতেই আগামী রোববার সুনামগঞ্জে সেমিনার করার ফাইল অনুমোদন করিয়ে নেন পিডি। এই টাকা খরচ করা হয়েছে সুনামগঞ্জের নিরাপদ খাদ্য অফিসার শরীফ উদ্দিনের মাধ্যমে।
তিনি এখন প্রকল্পের কাছ থেকে অগ্রিম সেমিনার হয়েছে দাবি করে টাকা চেয়েছেন। বিলের কপি এই প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে। এ বিষয়ে শরীফের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, গত ৯ আগস্ট টাঙ্গুয়ার হাওরে নৌকার মাধ্যমে খাদ্য প্রস্তুত ও সরবরাহকারীদের নিয়ে একটি সেমিনার আয়োজন করি। সেখানে পর্যটন বিকাশে নিরাপদ খাদ্যের ভূমিকা নিয়ে একটি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। সেমিনারটি হয়েছেও বিকেলে। তবে সেমিনারের ছবিসহ অন্যান্য প্রমাণ চাইলে তা তিনি তা সরবারবহ করতে পারেননি।
শরীফ উদ্দিন সেমিনারে খরচের যে খাত দেখিয়েছেন তাতে নৌকা ভাড়া বাবদ এক লাখ ৪০ হাজার টাকা, খাবার বাবদ ৪০ হাজার টাকা, গাড়ি ভাড়ায় ১৬ হাজার ৫০০ টাকা, ব্যানারে এক হাজার ৫০০ টাকা এবং বিবিধ খরচ হিসেবে আরো এক হাজার ৫০০ টাকা উল্লেখ করেছেন। শরীফ দাবি করছেন টাঙ্গুয়ার হাওরে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত নৌকায় যারা খাবার তৈরি ও পরিবেশন করেন তাদের প্রশিক্ষণ দিতেই সেমিনারটি করা হয়েছে। অথচ অভিযোগ উঠেছে তিনি নৌকায় নারী ও মদ নিয়ে রীতিমতো আসর বসিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সচিব মো: আখতার মামুন বিসিএস ২২তম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। এর আগে তিনি আইসিটি বিভাগের লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) থাকাকালে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে গুরুদণ্ড হিসেবে তিন বছরের জন্য বেতন গ্রেড অবনমনের সাজা দিয়ে ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অর্থাৎ পঞ্চম গ্রেড থেকে তাকে ষষ্ঠ গ্রেডে নামিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু প্রজ্ঞাপনের পাঁচ মাসের মাথায় রাষ্ট্রপতির কাছে তিনি শাস্তি মওকুফের আবেদন করলে তার পূর্বের শাস্তি বাতিল করা হয়।
গত বছরের ২ আগস্ট অতিরিক্ত পরিচালক হিসেবে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষে তার পদায়ন হয়।
তিনজন জ্যেষ্ঠ পরিচালক থাকার পরও তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পিএস কাজী শাহজাহানের তদবিরে তিনি কর্তৃপক্ষের সচিব পদে নিয়োগ লাভ করেন এবং গত ২১ মার্চ তিনি যোগদান করেন। বিনিময়ে কাজী শাহজাহানের লেখা কবিতার বই ‘শব্দঘরে বন্দি জীবন’ কর্তৃপক্ষের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কিনতে বাধ্য করা হয় বলে জানা যায়।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সচিব হওয়ার পরপরই নিরাপদ মো: আখতার মামুন তৎকালীন খাদ্যসচিব ইসমাইল হোসেনের পৃষ্ঠপোষকতায় ও একই মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখার যুগ্মসচিব হারুন অর রশিদের দাপটে এসটিআইআরসি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হিসেবে দায়িত্ব পান। পিডি হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রাপ্ত গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঠ ১২-০২৯৭) ব্যবহার করতে দেয়া হয় তার বন্ধু হারুনকে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ে প্রভাবশালী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত হারুন বর্তমানে রাজউকের সদস্য হিসেবে কর্মরত। রাজউকে যোগদানের পর অবশ্য গাড়ি প্রকল্পে ফেরত নেয়া হয়েছে।
পিডি হওয়ার পরপরই শুরু করেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট নিয়োগবাণিজ্য। প্রকল্পের আগের দক্ষ কর্মচারীদের বাদ দিয়ে তার পছন্দের লোক নিয়োগ শুরু হয়। জহিরুল ইসলাম অপু নামের দক্ষ কম্পিউটার অপারেটরকে চাকরিতে ইস্তফা দিতে বাধ্য করে এবং তার পরিবর্তে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে নিলুফার নামে একজনকে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পের নামে বরাদ্দকৃত গাড়ির আগের ড্রাইভারকে (রফিকুল) বাদ দিয়ে দেড় লাখ টাকা নিয়ে নতুন ড্রাইভার নিয়োগের অভিযোগ রয়েছে। কর্তৃপক্ষের সচিব দফতরের অফিস সহায়ক জাহিদের নিয়োগের পেছনে চার লাখ টাকার লেনদেনেরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
প্রকল্প পরিচালক হওয়ার জন্য অর্থ বিভাগের প্রকল্প সংক্রান্ত জনবল কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এসটিআইআরসি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালককে তৃতীয় বা চতুর্থ গ্রেডের কর্মকর্তা হতে হবে। কিন্তু এসবের তোয়াক্কা না করে যুগ্মসচিব হারুণের ক্ষমতা অপব্যবহার করে পিডি হিসেবে নিয়োগ পেয়ে বেপরোয়া হতে শুরু করেন মামুন। কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন কর্মকর্তার অভিযোগ, পিডি হওয়ার পর এই প্রকল্পের দৃশ্যমান তেমন কোনো কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়নি।
সচিব হিসেবে নিয়োগ লাভের আগে তিনি কর্তৃপক্ষের পরিচালকের (এনফোর্সমেন্ট) অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ের খাদ্যস্থাপনা মনিটরিংয়ের নামে সন্ধ্যায় বিভিন্ন নামীদামি রেস্টুরেন্টে গিয়ে ফ্রি খাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রায় ছুটির দিনেই বিভিন্ন জেলার কর্মকর্তাদের নিয়ে তিনি ভ্রমণ করতেন বিভিন্ন জায়গায়। সেখানে তারা বডি ম্যাসাজ, নারী ও মদ নিয়ে ফুর্তি করতেন। এসব খরচ বহন করতেন স্থানীয় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা। বিনিময়ে তারা বরাদ্দ পেতেন বিভিন্ন সেমিনার বা কর্মশালা, উপহার হিসেবে পেতেন ভালো জেলায় পদায়ন।
ঢাকার বাইরের এক নারী কর্মকর্তা জানান, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষে সচিব তাকে বলেন, ‘তোমার কি পোস্টিং-প্রমোশন লাগবে না? তুমি কি উপরে উঠতে চাও না? কিছুই কি বুঝো না? বোকা মেয়ে! নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষর প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত নাম না প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী কর্মকর্তা বলেন, সচিব স্যারের কথাবার্তা অসংলগ্ন। তিনি বিনা কারণেই নারী কর্মকর্তাদের তার সামনে বসিয়ে রাখেন। শুধু এই দুই নারী কর্মকর্তাই নন, মো: আখতার মামুনের বিরুদ্ধে এরকম অনেক নারী সহকর্মীর সাথে অশালীন কথাবার্তা বলে হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আখতার মামুনকে একাধিকবার ফোন দিলেও রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) জাকারিয়া বলেন, অভিযোগগুলো যাচাই বাছাই শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা