ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এক অগ্নিকন্যা খাদিজা
- হুমায়ুন কবীর হিমু
- ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩৯
কত আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বৈরাচারী পতন হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। নারীরাও এ আন্দোলনে পিছিয়ে ছিলেন না। ছেলেদের সাথে তারাও সামনের কাতারে থেকে যুদ্ধ করেছেন। শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন। কারো কারো আজো গায়ের লোম খাঁড়া হয় এমন ঘটনায়। এমন এক লৌহ মানবী খাদিজা। বয়স ৩৪ বছর। ছোট একটা চাকরি করেন সাভারে। স্বামী ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেন। থাকেন মিরপুরে ভাড়া বাসায়। বাসাওয়ালী আওয়ামী লীগের নেত্রী।
কেন এ আন্দোলনে জড়ালেন জানতে চাইলে তিনি জানালেন, ছোটবেলা থেকে প্রতিবাদী ছিলাম। অন্যায় দেখলে সহ্য করতে পারতাম না। কোটা পদ্ধতি আমার কাছে খুব বৈষম্য মনে হতো। ছাত্ররা যখন আন্দোলন শুরু করল তখনই সিদ্ধান্ত নেই একে সমর্থন দিবো। সরকার যখন ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিয়ে নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের আহত করল, রক্তাক্ত করল তখন নিজেকে বাসায় রাখতে পারলাম না। প্রথম দিকে শাহবাগে আন্দোলনে যেতাম। কারণ বাসা থেকে দূরে কেউ দেখবে না। ১৭ জুলাই শাহবাগে আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগ আক্রমণ করে। লাঠির আঘাতে বাম কাঁধ মারাত্মক জখম হয়। ফুলে ঢোল হয়ে যায়। রক্ত জমাট বেঁধে কালশিটে পড়ে যায়। বাসায় স্বামী দেখে খুব কষ্ট পান। স্বামী ওয়াদা নেন আর আন্দোলনে যাবে না। কিন্তু স্বামীর নিষেধাজ্ঞা তাকে দমাতে পারেনি। প্রতিদিন অফিস শেষ করে সাভার থেকে মতিঝিলে চলে যেতেন। স্বামী বাসায় আসার আগেই বাসায় চলে আসতেন। এভাবে একদিন পরিচিত এক লোকের কাছে ধরা খেয়ে যান। তখন সিদ্ধান্ত নেন শাহবাগ ব্যস্ত এলাকায় আর না। খুঁজে পেলেন মিরপুর -১০। পরে এখানেই প্রতিদিন যুক্ত হন তিনি। প্রতিদিন অফিস শেষ করে ছাত্রদের জন্য খাবার নিয়ে চলে যেতেন মিরপুর-১০ এ। হোমিওপ্যাথিতে পাস করায় আহত ছাত্রদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার দ্বায়িত্ব ছিল তার।
আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। ফ্যাসিবাদের দোসররা নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। কারফিউ জারি হয়। খাদিজার স্বামী অফিসেই থাকা শুরু করেন। ফলে আন্দোলনে পুরোপুরি জড়াতে কোনো বাধা থাকলো না।
প্রতিদিন সহযোদ্ধাদের মৃত্যু, আহত হওয়া মেনে নিতে পারলেন না। তিনি পণ করেন ফ্যাসিস্টকে না সরানো পর্যন্ত আন্দোলন থেকে থামবেন না।
আন্দোলনে যোগদান করতে হতো খুব সাবধানে কারণ বাসাওয়ালী আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর। তার বাসায় আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের মিটিং হতো। তারা যদি জানতে পারে তিনি আন্দোলনে যাচ্ছেন তাহলে কী করবে আল্লাহ ভালো জানেন।
এ দিকে স্বামী তাকে নিয়ে খুব চিন্তিত। আসলে তিনি আন্দোলনে যাচ্ছেন কি না? স্বামীকে অনবরত মিথ্যা বলেই যাচ্ছেন।
২ আগস্ট তার মনে হলো আমি মারা যেতে পারি। সে দিন সারা দিন কান্না করলেন। নিজের ব্যাংক চেক, ক্রেডিট কার্ডের পাসওয়ার্ড খামে ভরে বালিশের কভারের মধ্যে লুকিয়ে রেখে স্বামীকে ফোন দিলেন। জানালেন, আমার কিছু হলে বালিশের কভারের মধ্যে দেখো একটা খাম আছে।
৪ আগস্ট। আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। আন্দোলন থামাতে ফ্যাসিস্ট হাসিনা তার অঙ্গ সংগঠনের সন্ত্রাসীদের অস্ত্রশস্ত্রসহ মাঠে নামিয়ে দেয়। তাদের সে দিনের অত্যাচার পশুত্বকে হার মানায়। নিরীহ ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলি করতে থাকে। অনেকে ছাত্র-জনতা শহীদ হন। মিরপুর-১০ এ সে দিন ছাত্র-জনতাকে প্রতিহতো করতে মাঠে নামে সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ। এলোপাতাড়ি গুলি চালায় তারা। সে দিনও সকাল থেকে মিরপুর-১০ এ ছিলেন খাদিজা। আহত ছাত্রদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। দেখেন রক্তে তার পা ভিজে যাচ্ছে। বুঝতে বাকি থাকলো না তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। গুলি তার বাম উরু ভেদ করে চলে গেছে। দু’জন ছাত্র তাকে কাঁধে তুলে নিলেন। মিরপুরের কোনো হাসপাতালে নিলে তার চিকিৎসা সম্ভব না। কারণ সন্ত্রাসীরা হাসপাতালে চেকপোস্ট বসিয়েছে। আহত কাউকে পেলেই মারধর করে ফেরত দিচ্ছে। ছাত্রদের বললেন, আমাকে বাসায় নিয়ে যাও। আমি প্রাথমিক চিকিৎসা নিজেই করব। এর পর সাভারে পরিচিত এক হাসপাতালে চিকিৎসা নিবো।
কিছু দূর যাওয়ার পর দেখলেন ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা রাস্তা বন্ধ করে পাহারা বসিয়েছে। তাদের দেখেই তেড়ে আসে তারা। ছাত্র দু’জন ভয়ে তাকে ফেলে পালিয়ে যায়। উপায় না দেখে তিনিও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে একটা গলির মধ্যে ঢুঁকে পড়েন। সেখানে একজন ছাত্রকে দেখতে পান। পরে তার সহায়তায় ঘুরে ঘুরে নিজ বাসায় চলে আসেন। বাসায় কেউ নেই। নিজেই প্রাথমিক চিকিৎসার বক্স নিলেন। জামা খুলে যা দেখলেন তাতে খুব কষ্ট পেলেন। কিন্তু সাহস হারালেন না। দেখলেন গুলি তার ঊরুর মাংস ভেদ করে চলে গেছে। ঊরুতে পুরো ছিদ্র। ভাগ্য ভালো কোনো হাড় বা রক্তনালী ভেদ করে নাই। ক্ষতস্থান ভালো করে ওয়াশ করে ড্রেসিং করলেন নিজেই। পরে তার এক বন্ধুকে ফোন করেন। তাকে সাভার নিতে বলেন। স্বামী অফিসেই থাকতেন। তাকে জানাতে চাইলেন না। কারণ তিনি খুব দুর্বল মানসিকতার। আর অফিস থেকে আসা সম্ভবও না। ননদের স্বামীকে ফোন করে ঘটনা জানালেন। চিকিৎসার জন্য তাকে যেতে হয় সাভারে। তার কর্মস্থলের পাশের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন তিনি।
বাসায় আসার পর দেখাশোনার দায়িত্ব নেন আন্দোলনরত ছাত্ররা। তাকে তিনবেলা খাবার দিয়ে যেতো তারা। তার কী লাগবে তার খোঁজখবর রাখতেন। সে সময় তার পাশে ছিলেন শাহ আলী থানার জামায়াতের আমির।
দেশ দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কিন্তু টাকার অভাবে এখনো সুচিকিৎসা নিতে পারেননি তিনি। টাকার অভাবে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারেননি। এখনো তিনি হাঁটতে পারেন না ঠিকমতো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটাচলা করেন তিনি। বাম কাঁধে প্রচণ্ড ব্যথা। বাম হাত দিয়ে কোনো কাজ করতে পারেন না। এখনো তার ঘুম হয় না। ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে লাফিয়ে ওঠেন। সংসার চালাতে অসুস্থ শরীর নিয়ে প্রতিদিন যেতে হয় সাভারে। তার চিকিৎসার জন্য পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর শাহ আলী থানা। ইবনে সিনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে তারা।
দেশের স্বাধীনতা অর্জনে জীবন বিপন্ন করে আন্দোলন করা এ অগ্নিকন্যার জন্য আমাদের কি কিছুই করার নেই? তাদের পাশে না থাকতে পারি, একটা খেতাব তো দিতে পারি?
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা