সরকারকে বিব্রত করতে পোশাক শিল্পে অস্থিরতা
- শাহ আলম
- ০১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩০
- মিরপুরের ঘটনায় আ’লীগ নেতা কচির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ
- ঘোষণা ছাড়া বন্ধ করে দেয়া হয় গার্মেন্ট কারখানা
দেশের গার্মেন্ট খাত আবার অস্থির করার ষড়যন্ত্র শুরু করেছে পতিত সরকারের সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীরা। এক দিকে গার্মেন্ট খাতে স্থিতিশীলতা আনতে সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। অপর দিকে এ খাতে অস্থিরতা তৈরির জন্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মিরা অব্যাহতভাবে অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গার্মেন্ট খাতে অস্থিরতা সৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ সমর্থক কারখানা মালিকেরাও ভূমিকা রাখছেন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এর অংশ হিসেবে গতকাল মিরপুরের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করছেন।
গার্মেন্ট খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে গার্মেন্ট খাতে চলমান অস্থিরতার মূল ভূমিকায় রয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থক কারখানা মালিক এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। তারা বলছেন, সাম্প্রতিক অযৌক্তিক অস্থিরতার কারণে দেড় শতাধিক পোশাক কারখানা এবং অন্তত চার লাখ শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অস্থিরতার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা কিভাবে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করবে এ বিষয়ে কপালে দেখা দিয়েছে চিন্তার ভাঁজ।
গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা জানান ছাত্র-জনতার বিপ্লব ব্যর্থ করে দিতে পতিত সরকারের সুবিধাভোগী শিল্প মালিকরাই পরিকল্পিতভাবে গার্মেন্ট সেক্টরে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। পোশাক শিল্পে অস্থিরতা সৃষ্টি পতিত স্বৈরাচারের সুবিধাভোগী মালিকদের পরিকল্পিত চক্রান্ত। তারা বলেন, আমরা তো আলামত দেখছি, সাম্প্রতিক সময় অব্যাহতভাবে গণ্ডগোল হয়েছে গার্মেন্টে। আসলে এসব অস্থিরতা ঘটানো হচ্ছে। গার্মেন্টের মালিক যারা শেখ হাসিনার অত্যন্ত সুবিধাভোগী, তাদের গার্মেন্টের লোকেরা এসে যেসব গার্মেন্ট নিরপেক্ষ অথবা বিএনপির সমর্থিত লোকজনের প্রতিষ্ঠান সেখানে হামলা করেছে।
এ দিকে সরকারকে বিব্রত করতে কোনো নোটিশ ছাড়া গতকাল হঠাৎ কারখানা বন্ধ করে দেয়ায় রাজধানীর মিরপুর ১৪-এর কচুক্ষেত সড়কে বিক্ষোভ করে শ্রমিকরা। তারা বিক্ষোভ করে রাস্তা অবরোধের চেষ্টা করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ ও সেনাবাহিনী এলে তাদের গাড়ি ভাঙচুর ও আগুন ধরিয়ে দেয় শ্রমিকরা। বিক্ষোভে কচুক্ষেত এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ সময় ওই এলাকায় যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। এ ছাড়া পোশাক শ্রমিকদের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষের ঘটনায় আল আমিন ও রুমা বেগম নামে দুই শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
সেনটেক্স ফ্যাশন লিমিটেডের অপারেটর কবির হোসেন বলেন কচুক্ষেত এলাকার মৌসুমী নামে একটি গার্মেন্টের কর্তৃপক্ষ বুধবার রাতে হঠাৎ করে কারখানা বন্ধ করে দেয়। সেজন্য গতকাল সকালে কর্মচারীরা কারখানার সামনে অবস্থান নেন। একপর্যায়ে আশপাশের সব কারখানাও ছুটি দিয়ে দেয়। তখন সবাই একসাথে রাস্তায় অবস্থান নিলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে ধাওয়া-পালটা ধাওয়া ঘটে।
গার্মেন্ট শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বলছেন, পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা আব্দুল মান্নান কচির লোকেরা মিরপুর-১৪ এবং কচুক্ষেত এলাকায় অস্থিরতা সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করে। ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি। তার লোকেরা বিভিন্ন ইস্যুকে সামনে রেখে মিরপুর অঞ্চলে গার্মেন্ট খাতকে অস্থির করে তুলছে।
এ দিকে দেশে চলমান শ্রমিক অসন্তোষে চরম বিপাকে দেশের অন্যতম রফতানি খাত তৈরী পোশাক শিল্প। চলমান অস্থিরতায় এক দিকে যেমন আর্থিক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে, পাশাপাশি দেশী-বিদেশী ক্রেতা হারাচ্ছেন শিল্পমালিকরা। পোশাক শিল্পে চলমান এই অস্থিরতার জন্য তিনটি কারণ দায়ী বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
সম্প্রতি সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মো: মঈন খান বলেন পোশাক শিল্পে চলমান এ অস্থিরতার জন্য মূলত তিনটি কারণ দায়ী। এগুলো হলো বহিরাগতদের আক্রমণ, শ্রমিকদের যৌক্তিক ও অযৌক্তিক দাবির সমন্বয়ে অস্থিরতা ধরে রাখা এবং ঝুট ব্যবসার আধিপত্য।
এ দিকে শিল্প পুলিশ জানিয়েছে, বর্তমান সরকারকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ঠেলে দিতেই একটি চক্র শিল্প কারখানায় অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। এখন বেক্সিমকো গ্রুপের শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে উপদেষ্টাদের বিশেষভাবে নজর দেয়া জরুরি।
পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) তথ্যানুসারে গার্মেন্ট খাতে অস্থিরতার কারণে আনুমানিক ৩০০-৪০০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন এখনো অস্থিরতার কারণে গার্মেন্ট খাতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, সেটি নিরূপণসংক্রান্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে আমাদের কাছে আসা প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী ৩০০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, যা আরো বাড়তে পারে।
অস্থিরতার কারণে দেশের শিল্প ভালো নেই। বিশ্বে পোশাক আমদানি কমে আসছে। চলতি বছরের জানুয়ারি-আগস্ট সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক আমদানি পরিমাণের দিক থেকে বেড়েছে ১ দশমিক ৫ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশ থেকে কমে গেছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু চীন থেকে রফতানি বেড়েছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। একইভাবে ভিয়েতনাম থেকে বেড়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ, ভারত থেকে বেড়েছে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ এবং কম্বোডিয়া থেকে বেড়েছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ।
ইউরোপে জানুয়ারি-জুলাই সময়ে মোট আমদানি বেড়েছে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশ থেকে বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু চীন থেকে বেড়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ, ভারত থেকে বেড়েছে ৫ দশমিক ১৮ শতাংশ, কম্বোডিয়া থেকে বেড়েছে ১৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ভিয়েতনাম থেকে বেড়েছে ১২ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং পাকিস্তান থেকে বেড়েছে ১৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। আর তুলনামূলক রফতানি প্রবৃদ্ধির বিচারে চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বাংলাদেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ। আর ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং ভারতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ এই বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় প্রবৃদ্ধিতে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছি। যেটি এসব দেশে রফতানি আদেশ শিফট হয়ে যাওয়াকে ইঙ্গিত করে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন সাম্প্রতিক সময়ে নির্দিষ্ট কিছু শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতার কারণে শুধু সেপ্টেম্বর মাসে আমাদের প্রায় ২৫০-৩০০ মিলিয়ন ডলারের রফতানি ও উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এলডিসি উত্তরণের কথা বলে পোশাক শিল্পের নগদ সহায়তার হার কমিয়ে আনা হয়েছে। এটি শিল্পে অনাকাক্সিক্ষত ঝুঁকি ও বিপর্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে বলে তারা মনে করছেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা