নিজের চিকিৎসা, বাবার অসুস্থতা, ঋণ শোধ, কী করবে এখন গুলিবিদ্ধ ওমর?
- বাসস
- ২০ অক্টোবর ২০২৪, ০১:৩৮
ভ্যানগাড়ি চালক ওমর ফারুক বুলেটবিদ্ধ হয়ে বিছানায়। অসুস্থ বাবা। এগারো সদস্যের সংসারের খরচ। আহত ওমর এখন বড় অসহায়। কী করবে তার পরিবার?
অথচ তিন মাস আগেও ওমর পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী হিসেবে কঠোর পরিশ্রম করছিলেন। এখন তিনি চরম আর্থিক সঙ্কটের কবলে।
ওমর বলেন, ‘বিগত ১৮ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশের একটি গুলি আমার নাভির নিচ দিয়ে ঢুকে পেছনের দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। একইসাথে ভেঙে চুরমার হয়ে যায় আমার জীবনের সব স্বপ্ন।’
ঘটনার দিনই রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (আরপিএমসিএইচ) ওমরের শরীরে জটিল অস্ত্রোপচার করা হয়। মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে তিনি ফিরে আসেন।
রংপুর সিটি করপোরেশনের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের শেখপাড়া গ্রামের চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে দ্বিতীয় ওমর ফারুক (৩৫) একই গ্রামে তার শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রী-সন্তানসহ বসবাস করেন।
এই ভয়ঙ্কর ট্র্যাজেডি তার জীবনে আঘাত হানার আগে, ওমর তার ভ্যানগাড়িতে করে প্রতিদিন গ্রামাঞ্চল থেকে রংপুর শহরে এনে নেপিয়ার ঘাস বিক্রি করে তার পরিবারের ১১ জনের ভরণ পোষণ চালিয়ে আসছিলেন।
তার বাড়িতে সম্প্রতি বাসসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারের সময় ওমর হতাশা, বেদনা ও দুঃখের সাথে সেদিন তার সাথে কী ঘটেছিল এবং পরবর্তীকালে তার জীবনে নেমে আসা দুর্দশা বর্ণনা করেছিলেন। ওমর এখন বিছানায় কঠিন দিন পার করছেন। কারণ জটিল অস্ত্রোপচার এবং পরবর্তী অস্ত্রোপচার না হওয়া পর্যন্ত কৃত্রিমভাবে মলত্যাগ করার জন্য তার শরীরে একটি কোলোস্টোমি ব্যাগ বাহ্যিকভাবে সংযুক্ত রয়েছে। ওমরের শরীরে এখন প্রচণ্ড ব্যথা। সুস্থতার জন্য চার মাস পরে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার শরীরে আরেকটি বড় অস্ত্রোপচার করা হবে। সুস্থ হলে ওমর আবারো পরিবার বাঁচাতে জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বেন এই আশা।
ওমর তার বাবা খলিলুর রহমান (৬০), স্ত্রী জোহরা বেগম (২৭), ছেলে জুনায়েদ হাসান (সাড়ে সাত বছর) এবং মেয়ে ফাহমিদাকে (আড়াই বছর) সাথে নিয়ে তার শ্বশুরবাড়িতে থাকেন।
দিনমজুর শ্বশুর জয়দুল ইসলাম (৫৫) তার ছেলে রাসেল (২২) ও মেয়ে পারভিন বেগম (৩৬) ও পারভিনের দুই সন্তান মিলে এই যৌথ পরিবার।
ওমর বলেন, ‘আগে আমার দিনমজুর বাবা ১১ জনের এই সংসার চালাতে কিছুটা সহযোগিতা করতে পারতেন। কিন্তু বয়স বাড়ায়, কঠোর শারীরিক পরিশ্রম এবং পায়ের হাড় ক্ষয়ের কারণে আমার বাবা আর হাঁটতে ও কাজ করতে পারেন না।’
বাবাকে ওমর অনেক ভালোবাসেন। বাবার যথাযথ চিকিৎসার জন্য সামান্য করে অর্থ সঞ্চয় শুরু করেছিলেন।
কিন্তু বিধি বাম। ওমরের আকাক্সক্ষা মুখ থুবড়ে পড়েছে। অশ্রুভেজা কণ্ঠে ওমর বলেন, ‘জীবনের এই ট্র্যাজেডি আমার আকাক্সক্ষাকে ভেঙে দিয়েছে। বাবার চিকিৎসা কী করব, পরিবারের খরচ চালানোই এখন দায়।’
ওমর আরো বলেন, ‘আমার দিনমজুর শ্বশুরও এখন কর্মহীন। ফসলের মাঠে কোনো কাজ না থাকায় তিনি উপার্জন করতে পারছেন না।’
এ অবস্থায় কী করে সবার মুখে খাবার জুটবে এ চিন্তায় দিশেহারা ওমর। এর ওপর রয়েছে অস্ত্রোপচারের খরচ। কী হবে, কী করবে এখন ওমর?
ওমর বলেন, গত ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চরমে পৌঁছায়। তবু পেটের দায়ে ১৮ জুলাই প্রতিদিনের মতো ভ্যানগাড়ি নিয়ে আমি বের হই।
তিনি বলেন, বিকেলে নগরীর মডার্ন মোড় এলাকা সংলগ্ন ফাতেমা কোল্ড স্টোরেজের কাছে মেরামতের দোকানে ভ্যানগাড়ি সারাতে যাই। এ সময়ে আমি পুলিশের গুলিতে আহত হই।
গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ওমর অজ্ঞান হয়ে পড়েন। চেতনা ফিরে পাওয়ার পর তিনি নিজেকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে দেখতে পান।
এসময় ওমর আরো অনেক আহত ব্যক্তিকে দেখেন, যারা পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘পরে, আমি জানতে পারি যে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা: মো: আব্দুল বাছেত, অন্যান্য ডাক্তার, ছাত্র, নার্স এবং কর্মচারীরা আমার জীবন বাঁচানোর জন্য জটিল অস্ত্রোপচার করেছেন।’
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ১০ আগস্ট রংপুর হাসপাতাল পরিদর্শনে গেলে ওমরের সাথে কথা বলেন। সে সাক্ষাতের মধুর মুহূর্ত স্মরণ করে ওমর বলেন, তার এখনো মনে আছে যখন তিনি ওই হাসপাতালে এসে তার সাথে দেখা ও কথা বলেন। ডা: মো: আব্দুল বাছেতের সাথে কথা বলে তার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর করেন।
ওমর বলেন, ‘অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নেয়ার সময় ডা: মো: আব্দুল বাছেত আমার সার্বিক অবস্থার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন।’
তবু ওমর তেমন কোনো সাহায্য সহযোগিতা এখনো পাননি। তিনি দুঃখের সাথে বলেন, তার চিকিৎসার জন্য তাকে তার জায়গা জমি সবকিছু বিক্রি করতে হয়েছে এবং অনেকের কাছে তার স্ত্রীকে অর্থ ধার করতে হয়েছে। ট্র্যাজেডির তিন মাস পেরিয়ে গেলেও তিনি এখনো কোনো সরকারি সাহায্য পাননি। অন্যান্য সাহায্য যেটুকু পেয়েছেন তা প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য।
বাসসের সাথে আলাপকালে, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা: মো: আব্দুল বাছেত ওমরের স্বাস্থ্যের অবস্থা এবং পরবর্তী অস্ত্রোপচার সম্পর্কে বর্ণনা করেন।
এদিকে ওমরের চিন্তার কোনো শেষ নেই। কেবল আর্থিক দুশ্চিন্তাই নয়, আবারো অস্ত্রোপচারের পর তিনি কতটুকু স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন, সংসারের হাল ধরতে পারবেন তা নিয়ে তার উদ্বেগ যেন ফুরোয় না। কেবল নিজের নয়, বাবার চিকিৎসা নিয়েও অপেক্ষায় দিন গুনছেন ওমর।
এ জন্য দরকার পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো। সরকারি ও বেসরকারি সব ধরনের সহায়তাই পারে ওমরের জীবন ও পরিবারের শান্তি ফিরিয়ে আনতে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা