১৫ অক্টোবর ২০২৪, ৩০ আশ্বিন ১৪৩১, ১১ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

নারিকেলের মালা থেকে তৈরি হস্তশিল্প রফতানি হচ্ছে বিদেশে

নারিকেলের মালাই দিয়ে আকর্ষণীয় পণ্য তৈরি করছেন এক কারিগর : নয়া দিগন্ত -


পানি এবং শাঁস সংগ্রহের পর সাধারণত ফেলে দেয়া হয় নারিকেলের মালা। এই পরিত্যক্ত মালা যে আকর্ষণীয় হস্তশিল্প তৈরির উপকরণ হতে পারে তা হয়তো অনেকের চিন্তায় আসবে না। কিন্তু সেই পরিত্যক্ত নারিকেলের মালা দিয়েই চুয়াডাঙ্গায় তৈরি হচ্ছে আকর্ষণীয় হস্তশিল্প। বর্তমানে অনেকের কাছে আয়ের মাধ্যম হয়ে উঠছে এটি। ফেলে দেয়া নারিকেলের মালা দিয়ে হস্তশিল্পের পরিকল্পনা নেন চুয়াডাঙ্গার তরুণ উদ্যোক্তা খালিদ বিন ওয়ালিদ। এসব মালা দিয়ে তৈরি হচ্ছে পাখির মনোমুগ্ধকর বাসা, সাবানদানি, ল্যাম্প শেড, লবণ রাখার পাত্র, শোপিস, গহনা, তৈজসপত্র, ফুলদানি, নৌকা, কলমদানি, হারিকেন, কেটলি, চামচ, কাপসহ প্রায় ২০০ রকমের কারুপণ্য। দেশের বাজারে চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রফতানিও হচ্ছে পণ্যগুলো। এতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে বেশ কিছু বেকারের।
চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার সাতগাড়ি পাড়ার বাসিন্দা খালিদ বিন ওয়ালিদ পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই পরিবেশ রসায়ন নামের কোর্সটি ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। তখন থেকেই তিনি ভাবতে থাকেন পরিবেশবান্ধব কিছু একটা করার। শুরু করেন পরিবেশবান্ধব পণ্য নিয়ে গবেষণা। সেই সাথে চলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে চলা, তথ্য সংগ্রহ করে সংরক্ষণ ও পর্যালোচনা। পরিত্যক্ত নারিকেলের মালা দিয়ে পণ্য তৈরির ইচ্ছা থেকে সাতগাড়ি এলাকায় তৈরি করেন ‘রোদো হ্যান্ডিক্র্যাফটস’ নামের একটি কারখানা।
খালিদ বিন ওয়ালিদ কারখানায় হস্তশিল্পের পণ্য তৈরির জন্য চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার শঙ্করচন্দ্র গ্রামের কাঠমিস্ত্রি আলামিন হোসেনকে প্রস্তাব দেন। হস্তশিল্পের কাজে আগে থেকেই দক্ষ কারিগর আলামিনকে প্রশিক্ষণের জন্য নেয়া হয় বরিশাল বিভাগের কয়েকটি জেলায়। সেখান থেকে কাজের প্রাথমিক ধারণা নেন তিনি। এরপর অল্প পরিসরে কারখানায় কাজ শুরু হয়। পরে ইউটিউবে দেখে বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্পের কাজও শেখেন তিনি।

২০১৮ সালে খালিদ বিন ওয়ালিদ বাণিজ্যিকভাবে ‘রোদো হ্যান্ডিক্র্যাফটস’ নামের কারখানায় হস্তশিল্পজাত পণ্য তৈরির কাজ শুরু করেন। প্রথমে যশোর ও খুলনা থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে নারিকেলের মালা কিনেন কাজের জন্য। এরপর সেগুলো হাতে ও মেশিনে প্রস্তুত করেন কারিগর। মালা ও অন্য উপকরণ দিয়ে পণ্য তৈরির পর সেগুলো বার্নিশ করা হয়। এরপরই পণ্যগুলোর সৌন্দর্য ফুটে ওঠে।
প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কারখানায় পণ্য প্রস্তুত করেন ১০ থেকে ১২ জন কারিগর ও তার সহকারীরা। একজন কারিগর প্রতিদিন ৪টি পণ্য তৈরি করতে পারেন। মালা দিয়ে পণ্য তৈরি করতে লাগে কাঠ, বাঁশ, সুতা, আঠা, বিভিন্ন রঙের বার্নিশসহ আরো কিছু প্রয়োজনীয় উপকরণ।
দেশের বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে নারিকেলের মালা দিয়ে তৈরি পণ্যের। কারণ এগুলো দেখতে সুন্দর ও গুণগত মান যে কোনো পণ্যের চেয়ে ভালো। পণ্যগুলো সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব। পণ্যের আকার ও মান ভেদে প্রত্যেকটি বিক্রি হয় ১০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা দরে। দেশের বাজারে চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে বিদেশেও রফতানি শুরু হয়েছে খালিদের কারখানার তৈরি পণ্য। প্রতি মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হচ্ছে ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে।
কারখানার ব্যবস্থাপক সবুজ সাবিদ বলেন, বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা আমাদের কারখানায় এসে পণ্য কিনে নিয়ে যান। অনেকে অনলাইনের মাধ্যমেও অর্ডার দেন।

কারিগর আলামিন হোসেন জানান, এ কাজ চোখে দেখে রপ্ত করি। মালিক সাথে করে নিয়ে যান বরিশালে। সেখানকার কারিগরদের কাজ দেখে আসি। ইউটিউব দেখে জিনিস বানাই। এখান থেকে মাসে ১৫ হাজার টাকা বেতন পাই। তা দিয়ে ভালোভাবেই সংসার চলছে।
রোদো হ্যান্ডিক্র্যাফটসের পরিচালক খালিদ বিন ওয়ালিদ বলেন, পরিবেশ রক্ষা করতেই এ উদ্যোগ। নারিকেলের মালা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পণ্য এখন দেশে ও বিদেশে বিক্রি হচ্ছে। চাহিদাও বেশি। এই উদ্যোগের মাধ্যমে অনেকেরই কর্মসংস্থান হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা পরিবেশ আন্দোলনের সভাপতি সাবেক অধ্যক্ষ সিদ্দিকুর রহমান বলেন, পরিবেশ রক্ষায় তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে খালিদ ভালো কাজ শুরু করেছেন। নারিকেলের মালায় মশার বসবাস। মালা ব্যবহারের কারণে পরিবেশ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে। চুয়াডাঙ্গায় কুটির শিল্পের পণ্য তৈরি হচ্ছে। অন্য তরুণরাও যদি তার দেখাদেখি এ পেশায় সম্পৃক্ত হয় তবে বেকারত্ব অনেক কমে যাবে।
চুয়াডাঙ্গা বিসিকের উপব্যবস্থাপক এ বি এম আনিসুজ্জামান বলেন, আমি কারখানাটি ঘুরে দেখেছি। এটি ভালো একটি উদ্যোগ। মালা দিয়ে কুটির শিল্পের বিভিন্ন উপকরণ তৈরি হচ্ছে। রোদো হ্যান্ডিক্র্যাফটসকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। এখানে যে পণ্যগুলো উৎপাদন করা হয় সেগুলো বাজারজাত করতে ব্যবস্থা নেয়া হবে।


আরো সংবাদ



premium cement