নিম্নমধ্যবিত্ত এলাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি
চলতি বছর ভর্তি ৪৩৬৫৬, মৃত্যু ২১৫- হামিম উল কবির
- ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১:০৪
ঢাকায় নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ বাস করেন এমন এলাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি। এসব এলাকার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা জানিয়েছেন, তাদের এলাকায় মশা যেমন বেশি তেমনি মশক নিধনে কোনো ব্যবস্থা তেমন একটা চোখে পড়ে না। কোথাও কোথাও কীটনাশক ছিটানো হলেও কীটনাশকের ঝাঁঝ কম। নিচতলায় কীটনাশক ছিটালেও দোতলা থেকে গন্ধ পাওয়া যায় না। মশক নিধনে অবহেলায় ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার প্রাদুর্ভাব বেড়েছে বলে ঢাকার নাগরিকরা মনে করেন।
রাজধানীর মুগদা হাসপাতালের উপপরিচালক ডা: সত্য সাহাজিত জানিয়েছেন, মুগদা হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের বেশির ভাগই শক সিনড্রোমের রোগী। সাধারণ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি না করে হাসপাতালে ফিভার ক্লিনিকে চিকিৎসা দিয়ে বাসায় অবস্থানের পরামর্শ দেয়া হয়। মুগদা হাসপাতালে গতকাল সোমবার সকাল পর্যন্ত ৯২ জন রোগী ভর্তি ছিল। ডা: সত্যজিত সাহা জানান, মুগদা হাসপাতালে সাধারণত ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, সুবজবাগ, খিলগাঁও, রামপুরা থানা এলাকার মানুষ চিকিৎসা নিতে আসে। অধিকাংশ রোগীই উল্লেখিত থানা এলাকার নিম্নমধ্যবিত্ত এলাকার মানুষ। তিনি জানান, রোগীদের জিজ্ঞাসা করলে তারা জানান, বাসায় মশারি টানিয়ে রাতে ঘুমান। হয়তো বা দিনের বেলায় বাসায় থাকলে অথবা যেখানে কাজ করেন সেখানে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসক রাইয়ান ইসলাম বলেন, ঢাকা মেডিক্যালেও বেশির ভাগ নিম্নবিত্ত এলাকার মানুষ বেশি এসেছে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে।
মুগদা হাসপাতালে ডেঙ্গুর রোগীদের লিফটের ১০-এ ওয়ার্ড করা হয়েছে। ওই ওয়ার্ডের ইউনিট-৩ এর ৪৯ নম্বর বেডে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন কলেজ ছাত্র সিয়াম আহমেদ। সিয়ামকে দেখলে সুস্থ মনে হলেও গতকাল সকালে সিয়ামের প্লাটিলেট ১২ হাজারে নেমে আসে। সে স্বাভাবিকভাবেই খাবার খাচ্ছিল এবং ভাইয়ের সাথে কথা বলছিল। সিয়াম জানিয়েছে, ডাক্তার যে পরামর্শ দেয় তা মেনে চললে কোনো সমস্যা হবে না। প্লাটিলেট ১০ হাজারের নিচে নেমে এলে রক্ত দিতে হবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। সিয়ামের ভাই জানান, তিনি ডোনার রেডি করে রেখেছেন, ডাক্তার বললেই যেন ভাইকে রক্ত দিতে পারেন। তাদের বাসা গোড়ানে। সেখানে এ বছর কখন যে মশক নিধনে কীটনাশক ছিটিয়েছে তা বলতে পারবেন না। মোয়াজ্জেম খান (৫৮) থাকেন সিপাহীভাগের ভূঁইয়া পাড়ায়। তিনি মুগদা হাসপাতালের ৪৬ নম্বর বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্লাটিলেট কত নেমেছে তা তিনি বলতে পারেননি, পেশায় স্কুল ভ্যানচালক মোয়াজ্জেমের প্লাটিলেট সম্বন্ধে ধারণা নেই, তার স্ত্রী পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো করে থাকেন। মোয়াজ্জেম খানের স্ত্রী জানান, তাদের এলাকায় কখন মশার ওষুধ দিয়েছে তা তিনি বলতে পারবেন না।
এ বছর বর্ষা মৌসুমে মশক নিধনে অবহেলা থাকলেও গত বছরের চেয়ে এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলক কম বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, ২০২৩ সালে দেশে সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় ও মৃত্যু হয়। ২০২৩ সালের অক্টোবরের ১৪ দিনে দেশে ৩৩ হাজার ৮৪৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় এবং ওই ১৪ দিনে ১৬৯ জনের মৃত্যু হয়। সে তুলনায় চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে ৪৩ হাজার ৬৫৬ জন মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট বলছে, গত বছর যে সেরোটাইপ দ্বারা মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে, চলতি বছরও একই সেরোটাইপের ডেঙ্গু রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। আইইডিসিআরের গবেষকরা বলছেন, ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশার একই রকম সেরোটাইপ যখন পর পর দুই বছর থাকে তখন পরের বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ কমে যায়। আইইডিসিআর চলতি বছরের গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩ মাসে ৫০ জন নিশ্চিত ডেঙ্গু রোগীর নমুনা বিশ্লেষণ করে। তাতে এ বছর ডেঙ্গুর সেরোটাইপ ‘ডেন-২’ দিয়েই মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়েছে বলে বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। এই ৫০ নমুনার মধ্যে ৭০ শতাংশই (৬৯.২০ শতাংশ) ডেন-২ সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত হয়েছে। ২০২৩ সালে একই ডেন-২ সেরোটাইপ দিয়ে মানুষ আক্রান্ত হওয়ায় ডেঙ্গুর ভয়াবহতা কিছুটা কম বলে মনে করছেন গবেষকরা।
২০২৩ সালে মোট ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী এসেছিল স্বাস্থ্য অধিদফতরের তালিকাভুক্ত হাসপাতালগুলোতে এবং ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে এক হাজার ৭০৫ জন। ২০২২ সালে আইইডিসিআরের ডা: মো: আব্দুল্লাহ ওমর নাসিফ, ডা: রুমানা আখতার পারভীন, ডা: ফারিহা মুস্ফিকা মালেক, ডা: আহমেদ নওশের আলম সম্মিলিতভাবে একটি গবেষণা করেন। বাংলাদেশে ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপই এ পর্যন্ত শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০২ সাল পর্যন্ত ডেন-৩ ছিল প্রধান সেরোটাইপ। পরবর্তীতে ২০১৩ থেকে ২০১৬ সময়কালে প্রধান সেরোটাইপ ছিল ডেন- ২ এবং কিছু ডেন-১ সেরোটাইপও তখন পাওয়া যায়। ২০১৭ সালে ডেন-৩ এর পুনরাবির্ভাব ঘটে এবং ২০১৯ এবং ২০২২ সালের প্রাদুর্ভাবেও ডেন-৩ প্রধান সেরোটাইপ ছিল। এর পাশাপাশি ডেন-৪ সেরোটাইপের আবার আবির্ভাব ঘটে যেটি শেষ শনাক্ত হয়েছিল ২০০২ সালে। ২০২৩ সালে ডেন-২ আবার প্রধান সেরোটাইপ (৭০.২ শতাংশ পর্যন্ত) হিসেবে আবির্ভূত হয়। একবার একটি সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত হওয়ার পর ভিন্ন সেরোটাইপের ডেঙ্গু দিয়ে আবারো আক্রান্ত হলে রোগী গুরুতর ঝুঁকিতে পড়ে। ২০২৩ সালের ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের তীব্রতা আংশিকভাবে এই সেরোটাইপ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়, কারণ ২০২৩ সালে অনেক বেশি মানুষ আক্রান্ত হয় ও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা