০৮ অক্টোবর ২০২৪, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১, ৪ রবিউস সানি ১৪৪৬
`
বিআইআইটির সংবাদ সম্মেলন

শিক্ষাসংস্কারে কমিশন গঠন ও উন্নয়ন রূপরেখা উপস্থাপন

‘গণমাধ্যম যোগাযোগে ইসলামী মডেল’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন
-

শিক্ষা সংস্কারের নামে চাপিয়ে দেয়া কোনো চিন্তা চেতনা কখনোই মেনে নেবে না এ দেশের জনগণ। বরং মানুষের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলও শিক্ষা কাঠামোতে সমপৃক্ত থাকতে হবে। অতীতের শিক্ষা নীতিতে দেশের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, ও দর্শনকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এর ফলে পাঠ্যক্রমে খেয়ালখুশি মতো পরিবর্তন, রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় এবং অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় ধ্বংসের পথে দাঁড়িয়েছে। গতকাল সোমবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে চিন্তা ও জ্ঞান সংস্কারে নিবেদিত থিংক ট্যাঙ্ক বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট (বিআইআইটি) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি উপস্থাপন করা হয়েছে। সেখানে শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনসহ শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নের রূপরেখাও উপস্থাপন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং শিক্ষা উদ্যোক্তা ড. এম আবদুল আজিজ। উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির ভিসি অধ্যাপক ড. ইউসুফ এম ইসলাম, সেন্টার ফর ইসলামিক থট অ্যান্ড স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক শায়খ মুসা আল হাফিজ, একাডেমিক গবেষক এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ড. আফরোজা বুলবুল, মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি) এর অধ্যাপক ড. সেলিন রহমান, সঞ্চালক ড. সৈয়দ শহীদ আহমাদ এবং লেখক ও গবেষক আনিসুর রহমান এরশাদ।

এ দিকে সংবাদ সম্মেলন শেষে অনুবাদ গ্রন্থ ‘গণমাধ্যম যোগাযোগে ইসলামী মডেল’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিরা। সাংবাদিক হাসান শরীফ অনুদিত বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিতি ছিলেন দৈনিক নয়া দিগন্তের নির্বাহী সম্পাদক মাসুমুর রহমান খলিলী, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সিনিয়র সহকারী মহাসচিব বাছির জামাল, শিক্ষাবিদ জসিম উদ্দিন, শাহ আবদুল হালিম প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে ড. এম আবদুল আজিজ বলেন, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে বহু শিক্ষানীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলেও, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা ছিল শাসকগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনাকে সাধারণ জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রয়াস। গত ৫ আগস্ট তরুণ নেতৃত্বের গণজাগরণে স্বৈরাচারী শক্তির পতন ঘটার পর নতুন সম্ভাবনা ও পরিবর্তনের দ্বার উন্মোচিত হয়। এই নতুন অধ্যায়কে ‘বাংলাদেশ ২.০’ নামে অভিহিত করা হচ্ছে- যেখানে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ও পুনর্গঠন অন্যতম অগ্রাধিকার পাচ্ছে। জাতি গঠনের প্রধান নিয়ামক হিসেবে এ প্রজন্মের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ভবিষ্যতের জন্য একটি শক্তিশালী ও কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দীর্ঘ দিনের গবেষণা এবং পর্যালোচনার ভিত্তিতে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও থিংক ট্যাঙ্ক বিআইআইটি শিক্ষা সংস্কারের লক্ষ্যে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে শিক্ষাদর্শন, ভিশন, মিশন এবং উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। বিশেষ করে দেশীয় সত্তা ও মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিয়ে, কল্যাণমুখী রাষ্ট্র বিনির্মাণে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন, দক্ষ এবং ভালো মানুষ গড়ে তোলাই শিক্ষানীতিতে প্রধান্য পাওয়া উচিত। একই সাথে শিক্ষায় যেকোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শহর-গ্রামীণ ভেদাভেদ দূর করে ভারসাম্যপূর্ণ (রহপষঁংরাব) উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠী এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা বিশেষভাবে বিবেচনায় নিয়ে তাদের জন্য শিক্ষা বাজেটে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
অন্য দিকে দেশের শ্রমবাজার এবং বিশ্বশ্রমবাজারে জনশক্তি রফতানির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে ডিপ্লোমা চালু করা উচিত যাতে করে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা যায়। এ ছাড়া কারিগরি ধারায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করার জন্য কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সম্প্রসারণ, গবেষণা কার্যক্রম এবং শিক্ষার মানোন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ লক্ষ্যে জেলা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে কারিগরি শিক্ষার বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা যেতে পারে।
বিআইআইটির পাঠ্যক্রম সংক্রান্ত প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে সব ধারার শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু সাধারণ বিষয় বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যা ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম, আলিয়া মাদরাসা বা কওমি মাদরাসার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। এসব বিষয়ের মধ্যে থাকবে: বাংলাদেশ পরিচিতি, ইতিহাস ও সভ্যতা, সামাজিক বিজ্ঞান এবং ধর্মশিক্ষা। পাশাপাশি, ভাষাগত দক্ষতা ও কম্পিউটার দক্ষতা অর্জনকেও বাধ্যতামূলক করতে হবে।

জাতীয় শিক্ষাক্রমে অবশ্যই বাংলা, ইংরেজি এবং আরবিসহ তিনটি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে (আরবি পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষা, একই সাথে দেশের একটি বিশাল জনশক্তি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মরত)। সব স্তরের পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচিতে জীবনমুখী দক্ষ্যতা এবং বিষয়ভিত্তিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের যথাযথ সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় সব স্তরে ফান্ডামেন্টালস অব রিলিজিয়ন (মুসলিমদের জন্য ফান্ডামেন্টালস অব ইসলাম) বিষয় বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রতিটি বিষয়ের সাথে ‘প্রাসঙ্গিক ধর্মীয় কোর্স’ বাধ্যতামূলক করতে হবে। যেমন, অর্থনীতিতে ইসলামী অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ইসলামী রাষ্ট্রচিন্তা, আইনে ইসলামিক লিগ্যাল থিওরি ইত্যাদি।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত বিষয়ে বলা হয়েছে সব স্তরের শিক্ষকদের জন্য ‘ Pedagogy Skills (Art of Teaching)-এর পাশাপাশি বিষয়ভিত্তিক শিক্ষণ প্রশিক্ষণ (Subject based Teaching Method) বাধ্যতামূলক করতে হবে। মূল্যায়ন সংক্রান্ত বিষয়ে বলা হয়েছে সব লেভেলের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতিতে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান, ব্যবহারিক দক্ষতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হবে (বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ৫০%, বিশেষায়িত জ্ঞান ২০%, জীবনমুখী দক্ষতা ১০%, নীতিনৈতিকতা ও মূল্যবোধ ১০%, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মাঝে স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ ১০%)। সব লেভেলের শিক্ষক মূল্যায়নেও অনুরূপ/কাছাকাছি ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেভেলের শিক্ষকদের টিচিং ও গবেষণায় যথাক্রমে নূন্যতম ৬০% ও ৪০% হারে মূল্যায়ন ব্যবস্থা থাকা দরকার।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো Affiliating University মান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং-এর ব্যবস্থা করা যাতে যত্রতত্র কলেজ-মাদরাসা গড়ে উঠতে না পারে এবং দক্ষ গ্র্যাজুয়েট বের হতে পারে। জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় সঙ্কট মোকাবেলায় দ্রুত শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন, পরবর্তীতে শিক্ষা কমিশন গঠন অথবা জাতীয় করতে হবে। যেখানে শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যক্রম ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্ব, দেশের শিল্প এবং শ্রমবাজারের সাথে পরিচিত ব্যক্তিত্ব এবং ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement