০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ২ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

বিচারক নিয়োগের পরই শুরু হবে ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার ৫৫ অভিযোগ
-


সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের এ পর্যন্ত ৫৫টি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সংঘটিত সব গুমের অভিযোগ তদন্ত চেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আবেদন করা হয়েছে।
অপর দিকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ছাত্র আন্দোলনের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের জন্য ভিক্টিমের পরিবারের পক্ষে দুই শতাধিক মামলা করা হয়েছে। এসব মামলাও একটি প্রজ্ঞাপন জারি করার মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর হবে। কারণ এসব মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা সাধারণ আদালতে বিচার্য নয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেই এসব মামলার বিচার হতে পারে বলে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ঢাকাসহ সারা দেশে ছাত্র আন্দোলনের সময়ের হত্যাকাণ্ডের জন্য ভিক্টিমের পরিবারের পক্ষে দায়ের করা মামলাগুলো বাংলাদেশের প্রচলিত দণ্ডবিধি ও ফৌজদারী কার্যবিধি আইনে বিচার করা সম্ভব নয়। এটা শুধু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারযোগ্য। অত্র আদালতের এটার বিচার করার ক্ষমতা নেই এবং পুলিশেরও তদন্ত করার ক্ষমতা নেই। সে কারণে আমরা একটি সার্কুলার দিয়ে এসব মামলা ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেবো। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা এই মামলার তদন্ত করবে। প্রসিকিউশন আদালতে এসব মামলা উপস্থাপন করবে এবং এই ট্রাইব্যুনালেই এসব মামলার বিচার হবে।

ট্রাইব্যুনালে এতো বিপুলসংখ্যক অভিযোগ যেখানে জমা পড়ছে সেখানে জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচারের জন্য এখনো ট্রাইব্যুনালে বিচারক নিয়োগ করা হয়নি। হয়নি পুরনো ট্রাইব্যুনালের প্রয়োজনীয় সংস্কার। শুধু প্রসিকিউশন টিমে মাত্র চারজন প্রসিকিউটর নিয়োগ করা হয়েছে। আর তদন্ত সংস্থায় ১০ জন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, যেহেতু বিচারটা আন্তর্জাতিক মানের করতে হবে। ট্রাইব্যুনালে এখানে যে ধরনের ব্যবস্থা বর্তমান রয়েছে তা অপর্যাপ্ত এবং যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা নেই। আন্তর্জাতিক মানের একটা বিচার করার জন্য এ ধরনের একটা অবকাঠামোগত যে অবস্থান তা আমার কাছে যথার্থ বলে মনে হয় না। তবে সংস্কার করে বিচার উপযোগী করা একটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে বিচারকাজ থেমে থাকা উচিত নয়। এ জন্য আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টার সাথে গত ২ অক্টোবর দেখা করেছি এবং জানিয়েছি যে, আগে যে ভবনে বিচার কার্যক্রম চলছিল সেটিই উপযুক্ত। সেটিকে ব্যবহার উপযোগী করতে হবে। তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান প্রকৌশলীকে নিয়ে আমরা ট্রাইব্যুনালের পুরো ভবনগুলো দেখিয়েছি। এগুলোর কী কী সংস্কার করা দরকার তা তারা দেখে গেছেন। এ সবকিছু তারা সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। এই সংস্কার করতে সবমিলিয়ে তাদের তিন থেকে চার মাস সময় লাগবে। তবে এর আগে বিদ্যমান যে ভবন আছে এখানেই বিচাররের প্রথমিক পর্ব চলবে। সংস্কার হওয়ার পর বিচারের মূল পর্যায়ে সেখানে করা যায় সেটির জন্য তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন।
তিনি বলেন, আমরা যেটা সরকারকে সাজেশন দিচ্ছি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, এই জায়গাটা যেটি আছে সেখানে প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত করা দরকার। আর যে ভবনটা সংস্কারের জন্য ছাড়া হয়েছে সেটিকে দ্রুত সংস্কার করে যদি ওই ভবনে এজলাস বসানো যায় তা হলে কাজটা ভালো হবে। তখন স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেন করা সম্ভব হবে।

তাজুল ইসলাম আরো বলেন, বিচারক নিয়োগের কথাটা আমরা বারবার বলছি। এটা দ্রুত হবে আমরা আশা করছি। তিনি আরো বলেন, বিচারকাজ দ্রুত শুরু হওয়া দরকার এটা জাতির আকাক্সক্ষা। এই গণহত্যার দ্রুত বিচার হওয়া উচিত। সেই কাজ শুরু হওয়া দরকার। বিচারক নিয়োগের মাধ্যমে।
আ’লীগসহ ১৪ দলের শরিকদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ : গণহত্যার সরাসরি হুকুমদাতা হিসাবে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের শরিকদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে বিচার চাওয়া হয়েছে। গত ২ অক্টোবর জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর বরাবর অভিযোগ জমা দেন। অভিযোগে বলা হয়েছে যে, ১৯ জুলাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় কারফিউ জারি করার। এমনকি আন্দোলনকারীদের দেখামাত্র গুলি করার সিদ্ধান্ত হয় ১৪ দলের বৈঠকে। তাদের বৈঠকের সিদ্ধান্তের পরই গুলি চালিয়ে গণহত্যা চালানো হয়। এ সিদ্ধান্ত নিয়ে দল হিসেবে গণহত্যার সরাসরি হুকুমদাতা হিসাবে আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলের শরিক রাজনৈতিক দল-সাম্যবাদী দল, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, জাসদ (ইনু), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (মেনন), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল, তরিকত ফেডারেশন, গণতন্ত্রী পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), গণআজাদী লীগ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, বাসদ ও জাতীয় পার্টি-জেপির বিরুদ্ধে দল হিসেবে গণহত্যার অভিযোগ গঠন করে তদন্তপূর্বক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের ব্যবস্থা করা হোক।

ভিকটিম পরিবারকে আইনি সহায়তা দিবে জাতীয় নাগরিক কমিটি : লক্ষ্মীপুর ও যাত্রীবাড়ীতে দুই শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনায় গত ৩ অক্টোবর জাতীয় নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে গণহত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করা হয়।
অভিযোগ দাখিলের বিষয়ে কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন জানান, গত ৮ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গণ-অভ্যুত্থানের এক দফা তথা ‘ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ৫৫ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় নাগরিক কমিটি আত্মপ্রকাশ করেছিল। জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রাথমিক কাজ হিসেবে ঘোষিত আট দফা কর্মসূচির দ্বিতীয় দফা তথা ‘ছাত্র-জনতার ওপর সংঘটিত নির্মম হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি গ্রহণ করা। জাতীয় নাগরিক কমিটি ছাত্র-নাগরিকের অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারকে বিনামূল্যে আইনি সহায়তা প্রদান শুরু করেছে। ছাত্র-নাগরিকের অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের শিকার দুজন শহীদের পরিবার গতকাল জাতীয় নাগরিক কমিটির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করেছেন। আমরা শহীদ পরিবারদ্বয়কে মামলা দায়ের প্রক্রিয়ায় আইনি সহায়তা দিয়েছি। আখতার হোসেন আরও জানান, যেসব শহীদের পরিবার এখনো আইনি লড়াইয়ে যুক্ত হয়নি কিংবা বিভিন্ন কারণে মামলা দায়ের করতে পারেনি, তাদের ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করতে জাতীয় নাগরিক কমিটি আহ্বান জানায়। আমরা মামলার তদন্তের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করব এবং বিচার শুরু হওয়ার পর আইনিকাঠামোর মধ্যে থেকে শহীদ পরিবারকে আইনিপ্রক্রিয়ায় সহযোগিতা অব্যাহত রাখব। এ ছাড়াও এই অভ্যুত্থানে আহতদের পক্ষে মামলা দায়ের, পরিচালনা ও বিচার প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকার মাধ্যমে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করবে জাতীয় নাগরিক কমিটি।

ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন : আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩’ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ইতিমধ্যেই এই আইনের আটটি খসড়া সংশোধনী প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। খসড়া সংশোধনীতে এ আইনের ৪এ, ১৩এ ও ২০এ নামে ৩টি নতুন ধারা এবং ৩(৩) ও ১২(২) নামে ২টি নতুন উপধারা যুক্ত করা হয়। এ ছাড়া ধারা ৩(২)(এ), ৪(২) ও ১৯ ধারায় সংশোধন আনার প্রস্তাব করা হয়। খসড়া সংশোধনীতে গণহত্যায় নেতৃত্বের অপরাধে রাজনৈতিক দলকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করার মতো বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনে ৮ প্রস্তাব : ১ম সংশোধনটি ধারা-৩ সংক্রান্ত। এ সংশোধনীর মাধ্যমে মানবতা বিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় একটি ব্যাপক ও সিস্টেমেটিক আক্রমণের অংশ হিসেবে গুম, লিঙ্গভিত্তিক সহিসংতা, যৌন দাসত্ব, জোরপূর্বক যৌনকর্ম, জোরপূর্বক গর্ভধারণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীর কারণে জেন্ডার ও কালচারাল গ্রাউন্ডেও যদি কোনো সিভিলিয়ানের ওপর ব্যাপক ও সিস্টেমেটিক আক্রমণ করা হয় তাহলে তা মানবতা বিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, যা আগের আইনে ছিল না।
২য় সংশোধনী ধারা- ৩(৩) সংক্রান্ত। এ সংশোধনীর ফলে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদি অপরাধের দায় বা লায়াবিলিটি নির্ধারণ করতে ট্রাইব্যুনাল রোম স্ট্যাটিউটের ধারা ৯ অনুযায়ী গৃহীত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) এলিমেনটস অব ক্রাইম বিবেচনা করার সুযোগ পাবে।
৩য় সংশোধনী ধারা-৪ (২) সংক্রান্ত। এ সংশোধনীর ফলে এ আইনের অধীনে অপরাধ হতে পারে এটি জানা সত্ত্বেও যদি কোনো সংস্থা, সংগঠন, দল, সঙ্ঘবদ্ধ চক্র বা সত্তার নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় তাকেও বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হবে, যা বর্তমান বিধান অনুসারে সম্ভব নয়।
৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যের ভিডিও স্ট্রিমিং বা ওডিও-ভিজ্যুয়াল রেকর্ডিংয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে। এ সংশোধনীর বুনিয়াদে বিচার কার্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে ট্রাইব্যুনাল চাইলে শুনানি সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবে।
৫ম সংশোধনী প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে অভিযুক্ত চাইলে তার পক্ষে বিদেশী আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবে।

৬ষ্ঠ সংশোধনী- বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতাকে ত্বরান্বিত করবে। এ সংশোধনীর অধীনে ট্রাইব্যুনালের অনুমতিসাপেক্ষে দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষক আদালতের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন।
৭ম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রায় সব রকম ডিজিটাল সাক্ষ্যকে এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে সাক্ষ্যগ্রহণ পক্রিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক দল যদি এ আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করে তাহলে সে দলকে ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার বিধান রাখা হয়েছে।
আইন সংস্কারের বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের বিষয়ে গত ২৩ সেপ্টেম্বর আইনমন্ত্রণালয়ের মতবিনিময়ের পর বিভিন্ন মহল থেকে পরামর্শ এসেছে। আশা করি খুব দ্রুত এই সংশোধনের কার্যক্রম সম্পন্ন হবে। এছাড়া ট্রাইব্যুনালে বিচার নিয়োগ প্রক্রিয়াও চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে, স্বল্প সময়ের মধ্যে হয়ে যাবে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন,বিচার নিয়োগ করা হলেই ট্রইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হতে পরে।

 


আরো সংবাদ



premium cement