০৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১,
`

৬০০ টাকার কর্মচারী থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক আলী আজগার টসর

-

- ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় দুঃখ কাটেনি সাধারণ মানুষের
- ভারতে যেত সোনা, বদলে আসত ফেনসিডিল

আওয়ামী স্বৈরাচার শাসকের আমলে সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য হাজী আলী আজগার টগর মুসলিম লীগ পরিবারের সন্তান। তার পিতার নাম আব্দুল ওহাব ওস্তাগার। চাচার নাম ফকির ডাক্তার, যে ফকির ডাক্তার মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী বিশাল ভূমিকা রাখেন এবং চুয়াডাঙ্গা জেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। যিনি মাত্র ৬০০ টাকার কর্মচারী থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।
আজগারের উত্থান : চুয়াডাঙ্গা-২ নির্বাচনী এলাকার সাধারণ মানুষ বলছে, এমপি হওয়ার আগে আলী আজগার টগর ইসলাম গ্রুপে ৬০০ টাকা বেতনের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। ওই সময় তিনি হাতিয়ে নেন বেশ কয়েক কোটি টাকা। তৈরি হয় তার সাম্রাজ্যের ভিত-উত্থান। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক প্রভাবশালী নেতার সহায়তায় তিনি চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের নমিনেশন বাগিয়ে নেন। তখন থেকেই একের পর এক সব জাতীয় পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে আলী আজগার টগরকে নিয়ে নানা কাহিনী। ২০০৯ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি আমার দেশ পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় শিরোনাম হয়, ‘আলী আজগার টগর ও তার দুই ভাইয়ের রাজত্বে দামুড়হুদা ও জীবননগর দুই উপজেলার মানুষ অতিষ্ঠ। টগরের এক ভাইয়ের নাম আলী মুনসুর বাবু তাকে তিনি পরিচিত গোল্ড বাবু নামে। তিনি দামুড়হুদা উপজেলা সীমান্তবর্তী এলাকায় গোল্ড ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। তিনি গোল্ড চোরাকারবারীর মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। আরেক ভাইয়ের নাম আরিফ তিনি জীবননগর কন্ট্রোল করেন। তাদের মূল ব্যবসা ‘সোনা যাবে ইন্ডিয়া- আসবে ফেনসিডিল’। এই ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা টগর পরিবার রোজগার করেছেন।
টাকা ও ক্ষমতার দাপটে ভোটার বিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে আলী আজগার টগর তার ভাই গোল্ড বাবুকে উপজেলা চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। ওই সময় মাদক চোরাকারবারি হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় ঢাকায় ক্রসফায়ারের তালিকায় নাম আসায় দুই ভাই আলী মুনসুর ওরফেগোল্ড বাবু ও আরিফ পালিয়ে যান ইন্ডিয়ায়। পরে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে ক্রসফায়ার থেকে নাম বাদ দেয়া হয়।

স্থানীয়দের অভিযোগে আরো জানা যায়, আলী আজগর টগর এমপি এমন কোনো অপরাধ নেই যা তিনি করেন নাই। জমি দখল, হাট বাণিজ্য, ঘাটবাণিজ্য, রাস্তাবাণিজ্য, খালবাণিজ্য, চাকরিবাণিজ্য, সবকিছুর নায়ক আলী আজগর টগর।
শুধু চোরাকারবারি, চাঁদাবাজি করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। জীবননগর উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে সৌর বিদ্যুতের নামে ১৮০ একর জমি দখলের মূল হোতা আলী আজগার টগর। সহযোগী ছিলেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য জাহাঙ্গীর আলম। যদিও ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে জাহাঙ্গীরের সাথে তার বিভেদ সৃষ্টি হয়। সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি কোম্পানির কাছে কয়েক শ’ কোটি টাকা নিয়ে ১৮০ একর তিন ফসলি জমি, সাইক্লেস্ট এনার্জি পিপিআই লিমিটেড, সিঙ্গাপুরের কাছে হস্তান্তর করেন। জমি দখল করতে গিয়েই গণ্ডগোল শুরু হয়। ওই সময় এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রতিদিনে ফলাও করে খবর ছাপা হয়। বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ বিভিন্ন মিডিয় ছাপা হয়েছিল প্রতিদিন এভারেজ ৬০ কেজি সোনা ভারতে যাচ্ছে-বদলে আসছে ফেনসিডিল। দর্শনা পার কৃষ্ণপুরের শরীয়ত আলী অভিযোগ করে বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর গায়ের জোরে এমপি টগর ও তার লোকজনের সুরত আলীরা পারকৃষ্ণপুর ইউনিয়নে বাজারের জমি তারা জোর পূর্বক দখলে নিয়ে বর্তমানে পাকা বিল্ডিং করে রেখেছেন। তিনি জানালেন, এ অবস্থায় আমি এবং প্রতিপক্ষ সুরত আলী একই জমি নিয়ে কোর্টে মামলা করলে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে ২০২২ সালে দর্শনা থানা পুলিশ ওই জমিতে লাল ফ্লাগ তুলে দিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করেন এবং জমিতে কোনো পক্ষ না যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। কিন্ত ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা সুরত আলী সেটা না মেনে আলী আজগর টগর, তার ছোট ভাই দামুড়হুদা উপজেলা চেয়ারম্যান আলী মুনসুর বাবু ও মদনা-পারকৃষ্ণপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি জিয়াবুল হকের সহযোগিতায় ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে আইনের তোয়াক্কা না করে বাজারের সেই আমার জমিতে পাকা বিল্ডিং তুলে দেন, যা বর্তমানেও রয়েছে।

২০২২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের দামুড়হুদাতে দুইটি বড় সোনার চালান ধরা পড়ে যার মূল্য প্রায় ১৪ কোটি টাকা। জানা যায়, এই চালানের মালিক ছিলেন আলী আজগার টগর এবং সহযোগী ছিলেন তৎকালীন চুয়াডাঙ্গা জেলা পুলিশের এসপি। আলী আজগার টগর সম্প্রতিক ৪০ লাখ ডলার পাচারের ঘটনায় জড়িত রয়েছেন, যার তদন্ত চলমান রয়েছে। আলী আজগার টগরের সহযোগী দর্শনার মানি এক্সচেঞ্জের মালিক আরিফের মাধ্যমে এই ৪০ লাখ ডলার ভারতে পাচার করেছেন। টগর ওই টাকা দিয়ে তার দুই ভাইয়ের নামে কলকাতার সল্ট লেকে দু’টি বিলাস বহুল ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন।
এ ছাড়াও টগর নিজে এবং নিজস্ব লোকের মাধ্যমে সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে মাসে কোটি কোটি টাকা চাঁদা তুলতেন যা বছরে প্রায় ২০ কোটি টাকা সমতুল্য। এভাবে তিনি গত ১৫ বছরে ২০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এ ছাড়া আলী আজগার টগর তার ভাইদের নিয়ে ২০০৯ থেকে ২০১০ এবং ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর বিভিন্ন হাট-বাজার, বিশেষ করে জীবননগর ও দর্শনা পরশুর হাট থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। এ বিষয়ে আলী আজগার টগরের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।


আরো সংবাদ



premium cement