০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, empty
`

টাকা ছাড়া কাজ হয় না কাস্টমস বন্ড অফিসে

-

- বন্ড লাইসেন্স নবায়নে দীর্ঘসূত্রতা ক্ষতিগ্রস্ত রফতানিমুখী শিল্প
- প্রতিটি লাইসেন্স নবায়নের স্পিড মানি ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা
- প্রতিটি ইউপি ফাইলের জন্য ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা

টাকা ছাড়া কাজ হয় না কাস্টমস বন্ড অফিসে। কাস্টমস বন্ড সংক্রান্ত কার্যক্রম সম্পাদনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে রফতানি। দুর্নীতিগ্রস্ত আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও থেমে নেই কাস্টমস বন্ড অফিসে গ্রাহকদের হয়রানি। তাদের দোসররাও এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই-আগস্টে যে অবিস্মরণীয় বিজয় সংগ্রামী ছাত্র-জনতা অর্জন করেছে তাকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে হলে অবশ্যই সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় বিরাজমান ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় কাক্সিক্ষত সফলতা আমরা লাভ করতে ব্যর্থ হবো। বিশেষ করে দেশের রফতানি খাতকে সহযোগিতা প্রদানের জন্য যে শুল্কবিহীন বন্ড সুবিধা প্রদান করা হয়েছে তা গ্রহণকারী রফতানি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন পর্যায়ে সীমাহীন ঘুষ-দুর্নীতির আশ্রয় নিতে গ্রহণ করতে বাধ্য করছে সরকারি কর্মকর্তারা। বিষয়টি বন্ধ করার জন্য এনবিআর কর্তৃপক্ষকে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
দেশের বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঢাকায় দু’টি কাস্টম বন্ড (উত্তর ও দক্ষিণ) অঞ্চল রয়েছে। বন্ডের ইউটিলিটি পারমিশন সার্টিফিকেট (ইউপি) সুবিধা পাওয়ার জন্য মোটা অঙ্কের ঘুষ না দিলে ইউপি অনুমোদন হয় না। এজন্য প্রতিটি ইউপির জন্য ন্যূনতম ৫০০০ থেকে ১০,০০০ টাকা খরচ করতে হয়। প্রতিটি ইউপির জন্য সংশ্লিষ্ট এআরও ১০০০ টাকা গ্রহণ করে থাকে। ডিসি ৩০০০ থেকে ৫০০০ টাকা নিয়ে থাকে। এ ছাড়া বন্ডের লাইসেন্স শাখার সংশ্লিষ্ট এআরও, আরও, ডিসি, জেসি ও এডিসিসহ প্রত্যেকে বিভিন্ন কাজের জন্য বিভিন্ন রেটে ঘুষ আদায় করেন। বিভিন্ন শাখার সহকারীরা তো আরো একধাপ ওপরে। তারা এখানে সেবা নিতে আসা গ্রাহকদের ঠিক করে দেন কাকে কত টাকা দিতে হবে। মোটা অঙ্কের উৎকোচ আদায়ের এলাকা হিসেবে এক সময় বন্ড (এশিয়া ও ইউরোপ) নামে দুই ভাগে ডাকা হতো। ইউরোপে ফ্যাক্টরি বেশি, তাই আয় বেশি। অন্য দিকে এশিয়াতে আয় কম। এ দিকে বিভিন্ন কাজের জন্য সঠিক পরিমাণে ঘুষ প্রদান না করলে বিভিন্ন রকমের হয়রানিমূলক অমূলক তথ্য চেয়ে অডিট বিলম্বিত করে অনুমোদন প্রক্রিয়া বিলম্বিত করা হচ্ছে। এতে রফতানিকারকগণ বৈষম্যের শিকার হন। চাপে পড়ে রফতানিকারকদের অনেকে টাকা দিয়ে কাস্টম বন্ড কর্মকর্তাদের খুশি করতে বাধ্য হন।
সম্প্রতি বিজিএমইএ এর এক সভায় গার্মেন্ট মালিকরা বলেছেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে তৈরী পোশাক খাত। এ ক্ষেত্রে কাস্টমস ও বন্ড সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম সহজ ও আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে গতিশীলতার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু কাস্টমস বন্ডে পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম সম্পাদনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে রফতানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রফতানির প্রবৃদ্ধির অব্যাহত রাখার স্বার্থে বন্ডে বিদ্যমান সমস্যাগুলো সহজ করতে জরুরি উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে এসব উদ্যোক্তা মনে করছেন।
বিজিএমইএর সহ-সভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, সরকার রফতানি খাতকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন ধরনের ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে নেতিবাচক মানসিকতার কারণে সরকারের সদিচ্ছা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও রফতানি খাতকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে বিজিএমই এর বিভিন্ন সদস্য প্রতিষ্ঠানের যৌক্তিক সমস্যাগুলো সমাধান করা এখন সময়ের দাবি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছর বন্ড লাইসেন্স ও ইউপি সার্টিফিকেট নবায়নের বাধ্যবাধকতা থাকায় মেয়াদ শেষ হওয়ার পর একটি নির্দিষ্ট সময়ে হয়রানির শিকার হতে হয় লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রায় ১৩ হাজার প্রতিষ্ঠানকে। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুসারে বন্ড লাইসেন্সের প্রাপ্যতা নবায়নে সাত কার্যদিবস সময় নেয়ার কথা থাকলেও কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের ভয়াবহ সিন্ডিকেট এটি নবায়নে তিন থেকে পাঁচ মাস সময় নিয়ে নেয়। এতে এক বছরের প্রাপ্যতা নবায়নের বেশির ভাগ সময়টাই ব্যবসায়ীদের ঘুরতে হয় বিভিন্ন ঘাটে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক বলেন, তার প্রতিষ্ঠান বছরে ৫০০ কোটি টাকার বেশি পোশাক রফতানি করে। প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে তাদের ইউটিলিটি পারমিশন সার্টিফিকেট (ইউপি) নবায়নের আবেদন করে, যা বন্ড সুবিধা পেতে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স দরকার হয়। আবেদনের পরও পোশাক রফতানিকারক কোম্পানিটির ইউপি অনুমোদন পেতে ঘুরতে হয়েছে কয়েক মাস। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময় তাদের টেক্সটাইল কোম্পানিটির আমদানি করা এবং পোশাক তৈরীতে ব্যবহৃত প্রায় ২ হাজার মেট্রিক টন রাসায়নিক এসে পৌঁছায় চট্টগ্রাম বন্দরে। তবে প্রতিষ্ঠানটির আমদানি পণ্যে ইউপি সুবিধা (ইউটিলিটি পারমিশন বা কাঁচামালের প্রাপ্যতার অনুমোদন) সনদের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় তা আটকে দেয় চট্টগ্রাম কাস্টমস।
নবায়নের আবেদনে সাড়া না পাওয়ায় অস্থায়ী সনদের জন্যও আবেদন করেছিল কম্পোজিট টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু এই সনদ পেতেও তাদের অনেক সময় লাগে। এতে বন্দর থেকে কাঁচামাল খালাস করতে না পেরে উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে তাদের প্রতিষ্ঠানের।
এটি শুধু একটি উদাহরণ। বন্ড লাইসেন্স ও ইউপি সনদ নবায়নের দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়ায় কারখানায় উৎপাদন চালু রাখতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন অনেক রফতানিমুখী কারখানার মালিক। গার্মেন্ট এক্সেসরিজ উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোও কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের দুর্নীতিবাজ কালো চক্রের হাতে জিম্মি। তারা গণমাধ্যমে বিভিন্ন অভিযোগের কথা তুলে ধরলেও কেউই ভয়ে নিজেদের নাম প্রকাশ করতে চান না। কারণ প্রাপ্যতা নবায়নে ঘুষ বা স্পিডমানি ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা হলেও গণমাধ্যমে কথা বললে সেই রেট ৪০ থেকে ৫০ লাখে গিয়ে ঠেকে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতি বছর নবায়নের বাধ্যবাধকতা থাকায় মেয়াদ শেষ হওয়ার পর একটি নির্দিষ্ট সময়ে হয়রানির শিকার হতে হয় লাইসেন্স প্রাপ্ত প্রায় ১৩ হাজার প্রতিষ্ঠানকে। বন্দরে কাঁচামাল আটকে থেকে বিপুল লোকসান দিতে হয় রফতানিকারকদের। রাসায়নিকের চালান বন্দরে আটকে যাওয়ায় বায়ারদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদনও অনেক সময় ব্যাহত হয়।

বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যাক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সাবেক এক সভাপতি বলেন, কাস্টমস বন্ড কমিশনারের অদক্ষতা, অনিয়মসহ নানা কারণে প্রাপ্যতা লাইসেন্স নবায়নে ব্যবসায়ীরা চরম ভোগান্তির মুখে পড়েন। তাদের লোকসান গুনতে হয় এসব জটিলতায়। সাত দিনের মধ্যে প্রাপ্যতা নবায়ন পাওয়ার কথা থাকলেও মাসের পর মাস ঘুরতে হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বন্ড লাইসেন্সের জটিল নিয়ম ও সময়ক্ষেপণের কারণে বিপাকে দেশের রফতানি খাতের সব প্রতিষ্ঠান। বন্ড লাইসেন্সিং হলো শতভাগ রফতানির শর্তে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির সুযোগ। পণ্য আমদানির পর প্রতি বছর ইউপি সনদ নিয়ে বন্ড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানকে বন্ডেড ওয়্যারহাউজে রেখে ওই কাঁচামাল ব্যবহার করতে হয়। সব ডকুমেন্টস ঠিক থাকলে নবায়নের জন্য সাত কার্যদিবসের কথা বলা হলেও বিপুল অঙ্কের ঘুষ দিয়েও কোনো প্রতিষ্ঠানই এই সময়ের মধ্যে তা হাতে পায় না বলে অভিযোগ উদ্যোক্তাদের। অন্য দিকে অডিট সময় সাপেক্ষ হওয়া আইনে সাময়িক সনদপত্র দেয়ার নির্দেশনা থাকলেও তা পেতে বহু হয়রানির শিকার হতে ব্যবসায়ীদের।
চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের এক কর্মকর্তা বলেন, জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে পোশাক শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য শিল্প স্থাপন ও কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বন্ড কমিশনারেট সচেষ্ট রয়েছে। পোশাক শিল্পের বন্ড সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে বিদ্যমান জটিলতা নিরসন করা হবে।
দেশের পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের শীর্ষ সংগঠনের (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘লাইসেন্স নবায়নের প্রক্রিয়া সহজ করাসহ অস্থায়ী সার্টিফিকেট ইস্যু করার নির্দেশনা দেয়ার অনুরোধ করে আমরা এনবিআর চেয়ারম্যানের সাথে আলোচনা করেছি। আমাদের অনেক সদস্য ফোন করে অভিযোগ করছেন যে তারা অস্থায়ী সনদ পেতে সমস্যার মধ্যে পড়েছেন। দেশের আমদানি-রফতানি প্রক্রিয়া বাধাহীন করতে খুব দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করা হবে বলে আমরা আশা করছি।
ঢাকা বন্ডের কমিশনারেটের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, লাইসেন্স নিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল এনে কেউ কেউ খোলা বাজারে বিক্রি করে দেয়। ইউপি সনদ নবায়নের বাধ্যবাধকতা না থাকলে প্রতিষ্ঠানগুলো কাঁচামাল ব্যবহারের প্রতিবেদন জমা দেয় না। তখন হিসাবও পায় না এনবিআর। আর এ কারণেই প্রতি বছর নবায়ন জরুরি।

 


আরো সংবাদ



premium cement