০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, empty
`

এনসিটিবি সাবেকদের পুনর্বাসনকেন্দ্র

-

- পতিত সরকারের সুবিধা নেন অনেকে
- ঘুরে ফিরে এক ব্যক্তিকে চারবার পদায়ন
- উচ্চপদেই সবার অগ্রাধিকার

পতিত আওয়ামী লীগ সরকার আমলের সাবেক কর্মকর্তারাই এখন পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে পদায়ন পাচ্ছেন। বিষয়টি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যেন সাবেক হলেই কেউ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) পদায়নের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন। একই ব্যক্তি ঘুরে ফিরে চারবারও পদায়ন পেয়েছেন এনসিটিবিতে। এদের অনেকের বিরুদ্ধে আবার বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিশেষ সুবিধাভোগের অভিযোগও রয়েছে। এনসিটিবিতে আগে যারা কাজ করেছেন এখন তারাই আবার উচ্চপদে পদায়ন নিয়ে এখানে আসছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী এবং সাবেকদের পুনর্বাসনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান পাঠ্যপুস্তক বোর্ড।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এনসিটিবির শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নবনিযুক্ত সচিব, একাধিক উপসচিব, দুইজন সদস্য, বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ এবং ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ সবাই আওয়ামী লীগের সময়ে বিশেষ সুবিধা নিয়ে দীর্ঘ দিন এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে শিক্ষামন্ত্রীর সাথে লেনদেন কিংবা বনিবনার বিষয়ে ঝামেলা হওয়ার কারণে শেষ মুহূর্তে তারা নিরাপদে অন্যত্র বদলি হয়ে যান। এখন আবার সেই সাবেক কর্মকর্তারাই পদোন্নতি নিয়ে এনসিটিবিতে চলে আসছেন।

শিক্ষা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক সপ্তাহে এনসিটিবিতে যারা পদায়ন পেয়েছেন তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানাভাবে সুবিধা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনির আর্থিক বিভিন্ন অনিয়ম আর ঘুষ বাণিজ্যের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন এমন ব্যক্তিদেরও এখন এনসিটিবিতে পদায়ন করা হচ্ছে। অন্যদিকে দীর্ঘ দেড় যুগের বেশি সময় ধরে যারা যোগ্যতা, পেশাগত দক্ষতা ও অন্যান্য ক্রাইটেরিয়া পূরণ করার পরও সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে অনেককে বছরের পর পর বদলি করে রাখা হয়েছে। শুধুমাত্র আওয়ামী মানসিকতা পোষণ না করার কাল্পনিক অজুহাতে (!) জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী আখ্যা দিয়ে অনেক দক্ষ যোগ্য এবং সিনিয়র কর্মকর্তাকেও তাদের প্রাপ্যতার ভিত্তিতে ন্যায্য পদোন্নতি থেকেও বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। গত ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও বদলি কিংবা পদায়নের ক্ষেত্রে তারা আবারো তালিকার বাইরেই থাকছেন, বঞ্চিত হচ্ছেন।

সূত্র মতে, গত রোববার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি আদেশে এনসিটিবির সচিব হিসেবে পদায়ন পেয়েছেন শাহ মুহাম্মদ ফিরোজ আল ফেরদৌস (পরিচিতি নং ১২৫০৫৩), সহযোগী অধ্যাপক (বাংলা)। তিনি আগে থেকেই এনসিটিবিতে উপসচিব (প্রশাসন) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর আগেও তিনি এই একই প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে নিয়োজিত ছিলেন। বিশাল ক্ষমতাধর এই কর্মকর্তা একাই চার চারবার এনসিটিবিতেই পদায়ন নিয়েছেন। শুধু এনসিটিবিতে নয়, পুরো শিক্ষা প্রশাসনে ফিরোজ আল ফেরদৌস সাবেক এক মন্ত্রীর ভাগ্নে হিসেবে আওয়ামী আমলে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিকের ভাগ্নে হিসাবে দাপট দেখিয়ে ফেরদৌস রাজনৈতিক ভিন্ন মতাদর্শের ব্যক্তিদের ভীতসন্ত্রস্ত রাখতেন।

শিক্ষা প্রশাসনের সবাই জানেন ফিরোজ আল ফেরদৌস আওয়ামী সুবিধাভোগী শাহেদুল খবির, রতন কুমার মজুমদার, নিজামুল করিম সিন্ডিকেটের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তিনি নিজেও আওয়ামী আমলের একজন সুবিধাভোগী ব্যক্তি। এছাড়া তিনি দীপু মনির দুই পিএসকে দিয়ে দীর্ঘ সাত বছর এনসিটিবিতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পোস্টিং নিয়েছেন। ফিরোজ আল ফেরদৌস এবারো পুরস্কৃত হয়ে এনসিটিবির উচ্চপদে আসীন হয়েছেন। তাকে এনসিটিবির উপসচিব (প্রশাসন) পদ থেকে সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।

রোববারের একই আদেশে এনসিটিবিতে সদস্য (অর্থ) হিসেবে পদায়ন পেয়েছেন মো: মুনাব্বির হোসেন (পরিচিতি নং ২৭১২)। বিগত আওয়াসী লীগের সময়ে দুইটি নির্বাচনে শাহেদুল খবীর এর প্যানেলের কুমিল্লা নোয়াখালী জোনের সমন্বয়ক ছিলেন মুনাব্বির। নোয়াখালী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ সালমা খাতুন ও উপাধ্যক্ষ লোকমান ভূঁইয়ার অন্যতম সহযোগী। বর্তমানে তিনি নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজ থেকে এনসিটিবিতে সদস্য (অর্থ) হিসেবে পদায়ন পেয়েছেন। এর আগেও তিনি দীর্ঘদিন এনসিটিবিতে ছিলেন। এখন আবার সেই এনসিটিবিতে পুনর্বাসিত হলেন। নতুন পদায়নের তালিকায় রয়েছেন সিরাজুল ইসলাম (পরিচিতি নং ১৪৪৭০)। তিনি এনসিটিবিতে উপসচিব হিসেবে পদায়ন পেয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে তিনি জুলাই আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তীব্রভাবে বিরোধিতাকারী শাহেদ-রতন সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য। ২০২২ সালে শাহেদ রেহেনা প্যানেলে তিনি দফতর সচিব পদে নির্বাচনও করেছেন (ভোটার নং ঢাম-১১৯৮)। আওয়ামী লীগের আস্থাভাজন হওয়ায় তিনি আজীবনই ঢাকায় চাকরি করছেন। তিনিও এবার নতুন করে এনসিটিবিতে পুনর্বাসিত হয়েছেন। এনসিটিবিতে দ্বিতীয় দফায় পদায়ন পেয়েছেন ইংরেজির অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা (পরিচিতি নং ৯২৩৫)। আগে চাঁদপুর সরকারি কলেজে চাকরি করতেন। পরে দীপু মনি মন্ত্রী হওয়ার পর রতন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এনসিটিবিতে পদায়ন পান। কিছু দিন রাজবাড়ী থাকার পর গত রোববারের আদেশে আবারো এনসিটিবিতে পদায়ন পেয়েছেন ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ (মাধ্যমিক) হিসেবে।

এনসিটিবিতে একাধিকবার পদায়ন কিভাবে নিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে গতকাল বিকেলে শাহ মুহাম্মদ ফিরোজ আল ফেরদৌস নয়া দিগন্তকে বলেন, আমি মাঝখানে অন্যত্র বদলি হয়ে চলে গিয়েছিলাম। একনাগাড়ে এনসিটিবিতে ছিলাম না। আর জাহিদ মালেক আমার মামা না। সবাই এটা ভুল বলছে। রবং প্রকৃত সত্য হচ্ছে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক আমার আপন মামার স্কুল করে সেটি তার (মন্ত্রীর) বাবার নামে করেছে। আমরা এর প্রতিবাদও করেছি। আমি আওয়ামী লীগের কোনো সুবিধা নেইনি কখনোই।

এদিকে অভিযোগ রয়েছে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান এখন তার ইচ্ছা এবং পছন্দের আলোকে সাবেক কর্মকর্তাদের এনসিটিবিতে পদায়নের সুপারিশ করে নিয়ে আসছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এনসিটিবি একটি স্পর্শকাতর জায়গা। বিগত আওয়ামী লীগের আমলে কারিকুলাম নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছে। সেই বিতর্কের অন্যতম কুশীলব ছিলেন বর্তমান এই চেয়ারম্যান। তিনি ছিলেন সরকারের আজ্ঞাবহ ও নির্ভরযোগ্য এক ব্যক্তি যিনি সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির সাথে একাধিকবার বিদেশ ভ্রমণে গিয়েছিলেন।

এনসিটিবিতে সাবেক অনেক কর্মকর্তাকে নতুন করে পদায়নের বিষয়ে গতকাল বিকেলে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান এই প্রতিবেদককে জানান, আগে যারা এনসিটিবিতে ছিলেন তারা বিতর্কিত কারিকুলামের বিরুদ্ধে মতামত দেয়ার কারণেই তাদেরকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছিল। এখন যেহেতু সেই কারিকুলাম পরিমার্জন করা হচ্ছে তাই সাবেকদের অগ্রাধিকার দিয়ে আবার এনসিটিবিতে নিয়ে আসা হচ্ছে। তারা আওয়ামী লীগের সুবিধাভাগী কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সুবিধাভোগী হলে তারা তো ওই সময়ে আরো ভালো পদে পদায়ন পেতেন। কাজেই তারা কোনো সুবিধা নেননি। বরং তারা এখন ভালো সাপোর্ট দিতে পারবেন এই আশাতেই তাদেরকে এনসিটিবিতে নিয়ে আসা হচ্ছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement