২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১, ২৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

কেরানীগঞ্জে দখল হয়েছে কবি সিরাজুল ইসলাম বই বাগান ও লাইব্রেরি

-


কেরানীগঞ্জে দখল হয়েছে কবি সিরাজুল ইসলাম বই বাগান ও লাইব্রেরি নামের দুইটি প্রতিষ্ঠান। কেরানীগঞ্জ উপজেলায় বিগত বিএনপির শাসনামলে তৈরি ভবন সিরাজুল ইসলাম বই বাগানটি আওয়ামী লীগ শাসনামলে দখল করে নিয়েছে পুলিশ। অন্য দিকে কবির নিজ বাড়িতে নিজ হাতে গড়া লাইব্রেরিটি দখল করেছে ভাতিজা সুখন। এ দুইটি প্রতিষ্ঠান দখল হওয়ায় কবি ভক্তদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে।
‘হলুদিয়া পাখি সোনার বরণ, পাখিটি ছাড়িল কে?’ ‘নবী মোর পরশমণি, নবী মোর সোনার খনি’ আল্লাহু আল্লাহু তুমি জাল্লেজালালুহ, এই যে দুনিয়া কিসেরও লাগিয়া এতো যত্নে গড়াইয়াছেন সাই, এ রকম অসংখ্য বিখ্যাত গানের গীতিকবিতার রচয়িতা মরমি কবি সিরাজুল ইসলামের নিজ হাতে গড়া বই বাগান ও লাইবেরি দখল হয়েছে। পড়ে আছে অযত্নে অবহেলায়।

গতকাল কেরানীগঞ্জ উপজেলায় এবং কবির বাড়ি কেরানীগঞ্জ উপজেলার রসুলপুর গ্রামে ঘুরে এ তথ্য পাওয়া গেছে। কেরানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের প্রবেশদ্বারে রয়েছে কবি সিরাজুল ইসলাম লাইবেরি ভবন। অযত্নে অবহেলায় তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে লাইব্রেরিটি। জানালার ফাঁক দিয়ে ভেতরে দেখা যায় নর্দমার স্তূপ, ভবনের একপাশে দেখা যায় ২০০২ সালে সাবেক প্রতিমন্ত্রী আমান উল্লাহ আমানের উদ্বোধনী নামফলক। তিনি এই ভবনটি ২০০২ সালে কবি সিরাজুল ইসলাম পাঠাগার নামে উদ্বোধন করেন। যা ঢাকা জেলা সমবায় অফিস থেকে রেজিস্ট্রিকৃত। রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ঢ-০৭৩৩৮। কেরানীগঞ্জ উপজেলায় ভূমি রেজিস্ট্রি কাজে জড়িত স্থানীয় কয়েকজন দলিল লেখক জানান, আওয়ামী লীগের শাসনামলে কবি সিরাজুল ইসলাম লাইব্রেরি দখল করে এখানে পুলিশ ফাঁড়ি বানানো হয়। ৫ আগস্টের পর পুলিশ সদস্যরা চলে যাওয়ার পর থেকে এটি তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে।

অন্য দিকে কবি সিরাজুল ইসলামের বসতবাড়ি কেরানীগঞ্জ উপজেলার রসুলপুর গ্রামে দেখা যায়, অযন্তে অবহেলায় তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে কবির শখের বই বাগান। ঘরের বিভিন্ন কক্ষের জানালা ভাঙা। বই বাগানের ভেতর কবির ব্যবহৃত আসবাবপত্র এদিক-সেদিক পড়ে রয়েছে। ধুলো আর জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে বুকশেলফগুলো। যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কবির শখের বই। উইপোকা ইঁদুরের বসতি ঘরের ভেতরে। ঘরটি খোলা হয়নি অনেক দিন ধরে। এলাকাবাসী জানান, কবির ভাতিজা সুখন বই বাগান নামক ঘরটি দখল করে তালা লাগিয়েছেন।

১৯৩০ সালের ২ সেপ্টেম্বর দেশের প্রখ্যাত এই গুণী কবির জন্ম হয় কেরানীগঞ্জ উপজেলার জিনজিরা ইউনিয়নের রসুলপুরের এই গোকুলচর নামক গ্রামে। ২০০২ সালের ৯ জুন নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন এবং মৃত্যুর পরে বাগানের পাশে নিজের হাতে তৈরি করা কবরে দাফন করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৪৮ সাল থেকে সঙ্গীত চর্চা শুরু করেন কবি সিরাজুল ইসলাম। পরে ১৯৫৪ সালে তিনি রেডিওর গীতিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় টেলিভিশন কেন্দ্র স্থাপিত হলে সেখানেও গীতিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। আধুনিক, দেশাত্মবোধক, মারফতি, মুর্শিদি, মরমিসহ তার কয়েক শ’ গান বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের আর্কাইভে রয়েছে।
কবির লেখা গানে কণ্ঠ দিয়েছেন খ্যাতনামা কণ্ঠশিল্পীরা। তিনি ছিলেন বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য। পরে নিজ উদ্যোগে নিজ বাড়িতে এলাকার মানুষের জ্ঞানচর্চার জন্য স্থাপন করেন একটি পাঠাগার, যার নাম ‘বই বাগান’। সিরাজুল ইসলামের লেখা বইয়ের সংখ্যা ১৯টি। কবির বই বাগানে তার স্বরচিত বই ছাড়াও ছিল অসংখ্য দেশী-বিদেশী বই। কবি প্রতিনিয়তই বই বাগানের জন্য বই সংগ্রহ করতেন। একপর্যায়ে চোখ অপারেশন করার ফলে প্রচুর আর্থিক দুর্দশায় পড়ে যান তিনি। সে সময় কেউ কবির প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। তাই শেষ বয়সে আর্থিক দুর্দশায় পতিত হয়ে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেন।

এলাকাবাসী জানান, কবির স্মৃতিবিজড়িত বইবাগান ঘরটি দখল করে তার ভাতিজা সুখন বাইকের গ্যারেজ বানিয়েছে। যখন তার প্রয়োজন হয় গাড়ি বের করার জন্য ঘরটি তখন খুলেন অন্যথায় বন্ধ থাকে। কবি সিরাজুল ইসলামের পুত্রবধূ খালেদা আক্তার সিমা জানান, কবির পরিবারের কেউই সচ্ছল নয়। কবির স্ত্রী ও এক ছেলে মারা গেছেন। তার স্বামী একটি ইলেকট্রিক দোকানে চাকরি করে সংসার চালান। তাদের পক্ষে কবির রেখে যাওয়া বই বাগান দেখাশোনা করা সম্ভব নয়। সিমা বলেন, বই বাগান বন্ধ থাকায় ‘আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে পারি না। এ ছাড়া মাঝে একবার বই বাগানের রঙ করানো হয়েছিল। কবি জীবদ্দশায় মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। এখন সরকারের উচিত কবির ইতিহাস ও বইগুলো সংরক্ষণ করা।
এ ব্যাপারে কবির ভাতিজা সুখনের বাসায় গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। মোবাইলে ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তার বাসায় দৈনিক নয়া দিগন্ত প্রতিবেদকের নাম্বার দিয়ে আসা হলেও তিনি ফোন করেননি। যে কারণে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার রীনাত ফৌজিয়া নয়া দিগন্ত প্রতিনিধিকে বলেন, কেরানীগঞ্জে নতুন বদলি হয়ে আসার কারণে আমি অনেক কিছুর ব্যাপারে অবগত নই। তবে এলাকাবাসী যদি লিখিত আবেদন করে তাহলে আমি ভবনটি কবি সিরাজুল ইসলাম লাইব্রেরি হিসেবে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করব। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কেরানীগঞ্জ সার্কেল) মো: জাহাঙ্গীর আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, পুলিশ বিভাগের অতীতের কর্মকাণ্ডের জন্য আমরা লজ্জিত। একজন বিখ্যাত কবির নামে প্রতিষ্ঠা করা লাইব্রেরি দখল করে সেখানে পুলিশ ফাঁড়ি করায় তিনি দুঃখজনক বলে অবহিত করেন। তিনি এ ব্যাপারে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান।


আরো সংবাদ



premium cement