২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১, ২১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা বিশ্বনেতাদের

লেবাননে ইসরাইলি হামলার প্রতিক্রিয়া
-


গাজায় চলমান আগ্রাসনের মধ্যে লেবাননে ইসরাইলের বিধ্বংসী বিমান হামলায় আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়ে একটি ‘পূর্ণাঙ্গ’ যুদ্ধে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্ব নেতারা। সোমবার থেকে শুরু হওয়া এবং মঙ্গলবারেও অব্যাহত থাকা আক্রমণ ছিল উত্তর প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে ইসরাইলের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আক্রমণ এবং ১৯৭৫-৯০ সালের গৃহযুদ্ধ শেষের পর থেকে লেবাননে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু। আলজাজিরা।
মঙ্গলবার লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরাইলি হামলায় ৫০ শিশু ও ৯৪ নারীসহ ৫৫৮ জন নিহত হয়েছে। দেশজুড়ে বেসামরিক স্থানগুলোতে হানা হামলায় ১৬০০ জনেরও বেশি লোক আহত হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চল থেকে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। লেবাননে ইসরাইলি এই হামলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে।

জাতিসঙ্ঘ : সেক্রেটারি-জেনারেল আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘ব্লু লাইন বরাবর ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি দেখে তিনি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। লেবানন ও ইসরাইল অধিকৃত গোলান মালভূমি বিভক্ত করা সীমানা রেখা বরাবর বসবাসকারী বড় সংখ্যক বেসামরিক লোকদের হতাহতের ব্যাপারে তিনি উদ্বিগ্ন। তার মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক বলেন, জাতিসঙ্ঘের প্রধান দক্ষিণ লেবানন ও উত্তর ইসরাইলের পাশাপাশি ওই অঞ্চলে দায়িত্বরত জাতিসঙ্ঘের কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়েও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ইউনিসেফের প্রধান ক্যাথরিন রাসেল বলেন, এই ‘ছড়িয়ে পড়া উত্তেজনা’ অগণিত শিশুকে হুমকির মুখে ফেলেছে। বাস্তুচ্যুত হওয়ার কারণে, গোলাবর্ষণ ও বিমান হামলার কারণে শিশুদের মধ্যে ‘মানসিক যন্ত্রণার মাত্রা উদ্বেগজনক’। তিনি অবিলম্বে ছড়িয়ে পড়া উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছেন।

ইরান : লেবাননের হিজবুল্লাহর সাথে তাদের চলমান সঙ্ঘাতে ইরানকে জড়াতে ও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধ শুরু করতে ইসরাইল উসকানি দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। এ ধরনের কিছু হলে তার ‘অপরিবর্তনীয়’ পরিণতির বিষয়ে সতর্ক করেছেন তিনি। জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে সোমবার নিউ ইয়র্কে উপস্থিত হয়ে একদল সাংবাদিককে এসব কথা বলেন তিনি, জানিয়েছে রয়টার্স। পেজেশকিয়ান বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার কারণ হতে চাই না আমরা, এর পরিণতি অপরিবর্তনীয় হতে পারে। আমরা শান্তিতে থাকতে চাই, আমি যুদ্ধ চাই না। ইসরাইল চায় সর্বাত্মক সঙ্ঘাত তৈরি করতে।”

মিসর : মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইউএনএসসিকে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানিয়েছেন এবং ‘লেবাননের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের’ নিন্দা জানিয়েছেন। ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী দেশ মিসর বারবার আঞ্চলিক উত্তেজনার বিষয়ে সতর্ক করে আসছে। দেশটির মতে ইসরাইলি আগ্রাসন সমগ্র অঞ্চলটিকে ব্যাপক আঞ্চলিক যুদ্ধের দিকে টেনে নেয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করছে। লেবাননের সাথে ‘সংহতি’ জানিয়ে মিসর বলেছে যে তারা গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখছে।

কাতার : ইসরাইলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানিয়েছে কাতার। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালযের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরাইলের কর্মকাণ্ডে কোনো প্রতিবন্ধকতার অনুপস্থিতি, আন্তর্জাতিক আইনের ক্রমাগত লঙ্ঘন এবং তার অব্যাহত দায়মুক্তির কারণে ইসরাইলকে বেপরোয়া করে তুলছে। এই হামলা বাস্তব সঙ্কটকে আরো প্রকট করবে। আঞ্চলিক সঙ্ঘাত আরো বৃদ্ধি পাবে যা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও গভীর প্রভাব ফেলবে।
সৌদি আরব : সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে তারা লেবাননের হামলায় ব্যাপক উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং সব পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযমের আহ্বান জানিয়েছে। মন্ত্রণালয়টি ‘লেবাননের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই অঞ্চলের উত্তেজনা কমাতে ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত : এ ঘটনায় উপসাগরীয় দেশটি ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছে এবং সহিংসতা বৃদ্ধি, লাগামহীন হামলা সার্বভৌমত্ব আইনকে উপেক্ষা করে এমন তৎপরতার বিরুদ্ধে তার অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরাইলকে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র পাঠিয়েছে। এর পাশাপাশি ইসরাইল-হিজবুল্লাহ মধ্যস্থতাও চালিয়ে গিয়েছে যেন দু’টি পক্ষ যুদ্ধের দ্বারপ্রান্ত থেকে সরে আসতে পারে। হোয়াইট হাউজে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সাথে বৈঠকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, ‘আমার দল তাদের প্রতিপক্ষদের সাথে অবিরাম যোগাযোগ করছে এবং আমরা এমনভাবে কাজ করছি যাতে মানুষ নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারে।’ যদিও পেন্টাগন মুখপাত্র প্যাট্রিক রাইডার বলেছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লেবাননের উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে অতিরিক্ত সৈন্য পাঠাচ্ছে। অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা বা তাদের নির্দিষ্ট কোন পক্ষের হয়ে কাজ করবে সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে বর্ধিত উত্তেজনার আলোকে ও সতর্কতার কারণে আমরা ইতোমধ্যে এই অঞ্চলে অল্প সংখ্যক অতিরিক্ত মার্কিন সৈন্য পাঠাচ্ছি। কিন্তু অপারেশনাল নিরাপত্তার কারণে বিস্তারিত তথ্য দিতে চাচ্ছি না। এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪০ হাজার সৈন্য রয়েছে।

জি সেভেন : জি সেভেন বর্তমান ধ্বংসলীলা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছে, এই সঙ্ঘাত পুরো মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তর আঞ্চলিক সঙ্ঘাতে পরিণত করতে পারে, যার ফল অকল্পনীয় হতে পারে। কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত জি৭-এর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রতিক্রিয়া ও পাল্টা প্রতিক্রিয়া সহিংসতার এই বিপজ্জনক ধারাকে ক্রমাগতভাবে বড় করে তুলতে পারে।
ব্রিটেন : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি সোস্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ পোস্ট করে বলেন, তিনি লেবাননে ইসরাইলের বিমান হামলায় ‘গভীর উদ্বিগ্ন’। তিনি বলেন, ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকা এই সঙ্ঘাত ভবিষ্যতে আরো বিধ্বংসী পরিণতি বয়ে আনবে। আমি উভয় পক্ষকেই অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বানের পুনরাবৃত্তি করছি।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন : ইউ এর পররাষ্ট্রনীতির প্রধান জোসেপ বোরেল সতর্ক করে বলেন, আমরা প্রায় একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের মধ্যে আছি। নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে তিনি উত্তেজনা কমানোর জন্য উভয় পক্ষকে পূর্ণ প্রচেষ্টার আহ্বান জানিয়েছেন।
ফ্রান্স : ফ্রান্স বলেছে, সীমান্তের উভয় দিকে হামলা ‘অবিলম্বে শেষ হওয়া উচিত’। দেশটি সঙ্ঘাতের সমাধানের জন্য ইউএনএসসির জরুরি বৈঠক আহ্বান করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন-নোয়েল ব্যারোট বলেন, আমি লেবাননের জনগণের কথা ভাবছি কারণ ইসরাইলি হামলায় কয়েক ডজন শিশুসহ কয়েক শ’ বেসামরিক লোক মারা গেছে।

বেলজিয়াম : উপ-প্রধানমন্ত্রী পেট্রা ডি সাটার বলেছেন, লেবাননে ইসরাইলের হামলায় হতাহতের সংখ্যা দেখে তিনি ‘বিস্মিত’। তিনি সোস্যাল মিডিয়া এক্সে এ লিখেছেন, লেবাননে ৪৯২ জন প্রাণ হারিয়েছে। ১৬০০ জনেরও বেশি আহত। ১০ হাজার মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এই সবই হয়েছে মাত্র এক দিনের মধ্যে। ইসরাইলের এই ভয়ঙ্কর আক্রমণ এই অঞ্চলের জন্য কোনো সমাধানের দিকে নিয়ে যাবে না। একমাত্র কূটনীতিই নাগরিকদের নিরাপদে ঘরে ফিরিয়ে আনবে।

চীন : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, চীন সার্বভৌমত্ব রক্ষায় লেবাননকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে এবং ইসরাইলের হামলার তীব্র নিন্দা জানায়।
রাশিয়া : ক্রেমলিন বলেছে যে ইসরাইল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সংঘর্ষের বৃদ্ধি এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সাংবাদিকদের বলেন, অবশ্যই এটি এমন একটি ঘটনা যা সম্ভাব্য খুব বিপজ্জনক। নতুন করে সঙ্ঘাতের এলাকা বৃদ্ধি পাওয়া এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

 


আরো সংবাদ



premium cement