২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১, ২১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

পুলিশে নিয়োগ পদোন্নতি পদায়নের মাপকাঠি ছিল আ’লীগ ও গোপালগঞ্জ

-


বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পুলিশে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নের মাপকাঠি ছিল গোপালগঞ্জে বাড়ি অথবা আওয়ামী লীগ ব্যাকগ্রাউন্ড। এই অলিখিত শর্তের কারণে যোগ্য মেধাবীরা পদোন্নতি ও পদায়নবঞ্চিত হন। নিয়োগ পাননি অনেক মেধাবী মুখ। এমনকি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় থেকেও অনেকে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিতে পারেননি এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে। যদিও বিষয়টি নিয়ে এখন পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা মুখ খুলতে রাজি নন।

তারা জানান, সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন ৩৭তম ব্যাচের মোট এক হাজার ১৭৪ জন ক্যাডেট এসআই। তাদের মধ্যে ৮৬ জনের বাড়িই গোপালগঞ্জে। জেলাভিত্তিক হিসেবে এই ব্যাচে গোপালগঞ্জ থেকেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যদিও জেলার জনসংখ্যা অনুযায়ী গোপালগঞ্জ থেকে ১০ জনেরও কম নিয়োগ পাওয়ার কথা। অথচ এই ব্যাচে দেশের ২৫টি জেলা থেকে একজনকেও নিয়োগ দেয়া হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গোপালগঞ্জ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এই ছিল পুলিশের নিয়োগ, পদোন্নতি আর ভালো পদায়নের মূলনীতি। চলতি বছরের শুরুর দিকেও পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ অন্তত সাতটি পদে গোপালগঞ্জের কর্মকর্তারা ছিলেন। তাদের মধ্যে পুলিশের বিশেষ শাখার প্রধান (অতিরিক্ত আইজি) মনিরুল ইসলাম, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, র্যাবের মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন, এটিইউর অতিরিক্ত আইজিপি রুহুল আমিন, রেলওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজি দিদার আহমেদ, সিআইডির প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নূরে আলম মিনা ও রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি মো: আনিসুর রহমান। শুধু গোপালগঞ্জ নয়; বৃহত্তর ফরিদপুরে বাড়ি এমন কর্মকর্তারা গত ১৫ বছরে বিশেষ সুবিধা ভোগ করে গেছেন। পুলিশের নীতিনির্ধারণী পদগুলোতে নিয়োগ হয়েছে হয় শুধু ভৌগোলিক আঞ্চলিকতার বিবেচনায়, নয়তো দলীয় বিবেচনায়।

দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বিদায়ী আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আওয়ামী পরিবারের সদস্য হিসেবে দুই দফায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার ভাই চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ সুনামগঞ্জ-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান। যদিও তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়া সেন গুপ্তের কাছে পরাজিত হয়েছেন। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বাবা মরহুম আবদুল মান্নান চৌধুরী শাল্লা উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন।
দায়িত্বশীল পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, বিএনপি (২০০১-২০০৬) সরকারের সময়ে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা বিভিন্ন সময় সরকার বা আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছেন তারাও সুবিধাভোগীদের কাতারে ছিলেন। কাগজে-কলমে মূল্যায়নের মাপকাঠি হিসেবে দক্ষতা, যোগ্যতা আর সততার কথা বলা হলেও বাস্তবে এসব বিবেচনায় আসত অনেক পরে।

পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘১০-১১ বছর আগে যখন তার ব্যাচমেটরা সবাই একে একে এসপি পদোন্নতি পেলেন, তখন তিনি ও তার আরেক ব্যাচমেট অতিরিক্ত এসপি হিসেবেই থেকে যান; কিন্তু পদোন্নতি আর হয়নি। ব্যাচমেটরা পরামর্শ দিলেন এ কে এম শহীদুল হকের সাথে দেখা করতে। তখন তিনি অতিরিক্ত আইজি অ্যাডমিন। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে গিয়ে তার সাথে দেখা করলাম। বললাম, ‘ব্যাচমেটদের পদোন্নতি হয়ে গেছে, আমারটা হচ্ছে না। শহীদুল হক জিজ্ঞেস করলেন বাড়ি কোথায়, বললাম লক্ষ্মীপুর। শুনেই তিনি বললেন, ‘সে তো পশ্চিম পাকিস্তান’। শুনেই মুখটা কেমন তেতো হয়ে গেল, এ কেমন কথা?
ওই কর্মকর্তা বলেন, আমাদের সংবিধানে বলা আছে ধর্ম, বর্ণ, আঞ্চলিকতা কোনো কিছুর ভিত্তিতেই বৈষম্য করা যাবে না। অথচ পুরো পুলিশে এই বৈষম্য হয়েছে গত ১৫ বছর ধরে। হাবিব যখন ঢাকার এসপি ও ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি ছিল, তখন ঢাকার জেলা কোটায় গোপালগঞ্জের শত শত লোককে চাকরি দিয়েছেন। এটি রীতিমতো ফৌজদারি অপরাধ বলা যায়। এগুলো নিয়ে তখন অনেক সংবাদও প্রকাশ হয়েছে, কিন্তু কারো কিচ্ছু হয়নি। কারো বিরুদ্ধে একটা ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

শিক্ষাজীবনে ছাত্রলীগ করেছেন পুলিশের এমন কর্মকর্তাদের একটা দল মূলত পুরো বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করত। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেপরোয়া হিসেবে পরিচিতি পান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাবেক প্রধান ২০ ব্যাচের কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ। একসময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হারুনের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। এর আগে নারায়ণগঞ্জের এসপি থাকা অবস্থায় দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপ ‘পারটেক্স’ এর কর্ণধার এম এ হাশেমের ছেলের স্ত্রীকে শিশুসন্তানসহ অপহরণ করে নারায়ণগঞ্জে নিয়ে মাদকের মামলা দেন। বিষয়টি তখন ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি’ ছিল। এতে হারুনের পদোন্নতি, সেরা পদায়ন কোনটাই আটকে থাকেনি। তিনি ঠিকই ব্যাচে সবার আগে ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। ডিআইজি হয়েই পোস্টিং পেয়েছেন ডিবির প্রধান হিসেবে। গত ৫ আগস্ট থেকে তিনি পলাতক আছেন।

২০ ব্যাচের আরেক কর্মকর্তা সৈয়দ নুরুল ইসলাম, মোল্যা নজরুল ইসলাম, ২৪ ব্যাচের প্রলয় কুমার জোয়ার্দ্দার পুলিশের নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলোতে প্রভাব রাখতেন। এরা সবাই ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত ছিলেন।
তাদের মধ্যে প্রলয় কুমার জোয়ার্দ্দার ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি যখন পুলিশে ফেরত আসেন, তখন মাঠপর্যায়ের কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই একের পর এক ভালো পদায়ন দেয়া হয় তাকে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ জঙ্গিবাদ দমনে বিশেষায়িত সিটিটিসি ইউনিট করার পর ডিসি হিসেবে প্রলয়কে সেখানে নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি সিটিটিসিতে কর্মরত থাকাবস্থায় একটা সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। যার নেতৃত্ব দিতেন মনিরুল ইসলাম, আতিকুল ইসলাম। তাদের আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে কাজ করতেন হাসান উল হায়দার।

সেখানকার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রলয় ছিলেন এসএজির (স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ) ডিসি। অথচ স্যারের মাঠপর্যায়ের তখন কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। তার রুমে সারাদিন রাজনৈতিক তদবিরে লোকজন বসে থাকত। কিছু দিন পরই তাকে বদলি করা হয় নরসিংদীতে এসপি হিসেবে। কিন্তু তিনি মিন্টো রোডে সিটিটিসি ভবনে আগের রুমটার দখল ছাড়েননি। নরসিংদী গেলে রুমটা তালা মেরে যেতেন। আবার ছুটিতে ঢাকায় এলে পলিটিক্যাল লোকজনের বাজার বসাতেন। তখন সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম এসব দেখেও কিছুই বলেননি।
২০ ব্যাচের আরেক কর্মকর্তা সৈয়দ নুরুল ইসলাম হাঁটছিলেন এমপি হওয়ার দিকে। তর গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। আওয়ামী লীগে রীতিমতো নিজের গ্রুপ খুলে বসেছিলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে আওয়ামী লীগের সেই গ্রুপকে লোকে ডাকত ‘এসপি লীগ’ হিসেবে। কয়েকটা খুনের অভিযোগ এলেও নুরুল ইসলাম নিজ ক্ষমতা বলে সামলে নিতেন। সর্বশেষ ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি ছিলেন, এখন তিনি পলাতক।

সাবেক ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে পুলিশে সুযোগ নেয়া আরেক আলোচিত কর্মকর্তা হচ্ছেন বিপ্লব কুমার সরকার। ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার হিসেবে কর্মরত ২১ ব্যাচের কর্মকর্তা বিপ্লব হাসিনা সরকারের পুরোটা সময়জুড়েই ভালো পদায়ন পেয়েছেন। ঢাকা মহানগরে বিএনপির যেকোনো বিক্ষোভ-সমাবেশ কর্মসূচি থাকলেই দেখা মিলত বিপ্লবের। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনে বিপ্লবের কুখ্যাতি ছিল ডিএমপিতে। এর সাথে গায়েবি মামলা, আর গণগ্রেফতারেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। সেখানেও বিপ্লব তালিকা ধরে বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেফতারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন।

বাড়ি গোপালগঞ্জ অথবা আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্ক নেই এমন কোনো ব্যক্তি ঢাকার কোনো থানার ওসি হয়েছেন এমন নজির গত ১৫ বছরে দেখা যায়নি। পুলিশের নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের নেতা হয়ে বসেছিলেন বি এম ফরমান আলী, মাজহারুল ইসলাম কাজলসহ কয়েকজন। ফরমানের বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায়। আর মাজহারুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হল ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন।
ফরমান আলী দেড় যুগের বেশি সময় ধরে চাকরি করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশে। ঘুরেফিরে কাটিয়েছেন ঢাকার বিভিন্ন থানার ওসি হিসেবে। একইভাবে ঢাকার থানাগুলোতে ওসিগিরি করেই গত এক যুগ কাটিয়েছেন মাজহারুল ইসলাম। সর্বশেষ গুলশান থানার ওসি ছিলেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যখন শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান, তখন ঢাকার ২০টি থানার ওসি ছিলেন গোপালগঞ্জের লোকজন। এ ছাড়া পরিদর্শক তদন্ত ও অপারেশনও ছিলেন ওই এলাকার কর্মকর্তারা। তারাই বেপরোয়াভাবে গ্রেফতারে বাণিজ্য ও সরকারের পক্ষ নিয়ে জনগণের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়।

 


আরো সংবাদ



premium cement