২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১, ২১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

গোলাম ফারুক সিন্ডিকেটে জিম্মি গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট

-


সিনিয়র দুই কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে দিনাজপুর গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (ডিজি) করা হয় ড. গোলাম ফারুককে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের (বাকৃবি) বান্ধবী ওয়াহিদা আক্তার কৃষি সচিব হওয়ার সুবাদে দলবাজ এই কর্মকর্তাকে বসানো হয় প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে। শেখ হাসিনার সাবেক পিএস ওয়াহিদা আক্তার কৃষি মন্ত্রণালয়ে ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন। সেই ক্ষমতায় গোলাম ফারুকও হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। দিনাজপুরে তার বাড়ি, প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ইকবালুর রহিম পরিবারও তার ঘনিষ্ঠ। সেই সুবাদে দিনাজপুর (নশিপুর) গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের ডিজি গোলাম ফারুক হয়ে ওঠেন প্রতিষ্ঠানটির সর্বময় ক্ষমতাধর ব্যক্তি। দলীয় কোটায় নিয়োগবাণিজ্য, দল বিবেচনায় বদলি, পদোন্নতি, সবক্ষেত্রেই তার নেতৃত্বে সেখানে গড়ে ওঠে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগের দিন রাজধানীর খামারবাড়ির সামনের রাস্তায় ছাত্রজনতার এক দফার আন্দোলনের বিরুদ্ধে নিজের অনুসারীদের নিয়ে ড. রাজ্জাক ও বাহাউদ্দিন নাছিমদের সাথে কর্মসূচি পালন করেন ড. গোলাম ফারুক। স্বৈরশাসনের পতনের পর দিনাজপুর গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ স্থানীয়রা ডিজির অপসারণের দাবিতে মানববন্ধন করেন। এই আন্দোলনে যোগ দেন স্থানীয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নেতাকর্মীরাও। গত ৫ সেপ্টেম্বর তাকে ডিজি পদ থেকে সরিয়ে প্রশাসন ও অর্থ উইংয়ের পরিচালক করা হয়। ডিজি করা হয় তারই বন্ধু প্রশাসন ও অর্থ উইংয়ের পরিচালক সালাহউদ্দিন আহমেদকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২১ সালের নভেম্বরে ডিজি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর ড. গোলাম ফারুক নিজ প্রতিষ্ঠানে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। বিএনপি-জামায়াত তকমা দিয়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের দিনাজপুর গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান কার্যালয়ছাড়া করা হয়। তিনি যেমন সিনিয়রদের ডিঙিয়ে ডিজি হয়েছিলেন, ঠিক একই কায়দায় দলবাজ জুনিয়রদের সিনিয়র পদে বসিয়ে নিজ সিন্ডিকেট পাকাপোক্ত করেন। ডিজি পদ থেকে সরলেও বর্তমানে গোলাম ফারুক সিন্ডিকেটই দিনাজপুর গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের পক্ষ থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, সচিব, বর্তমান ডিজিসহ বিভিন্ন দফতরে দেয়া স্মারকলিপিতে গোলাম ফারুকের অপসারণ দাবি করা হয়।

এতে উল্লেখ করা হয়, সাবেক ফ্যাসিবাদ সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত ড. গোলাম ফারুক, দুই সিনিয়র বিজ্ঞানীকে টপকিয়ে মহাপরিচালকের (চলতি দায়িত্ব) চেয়ারে বসেন। হাসিনা সরকারের সময় কৃষি মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিগ্রস্ত সচিব ওয়াহিদা আক্তার ক্লাসমেট ও ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হওয়ায় তার দোহাই দিয়ে ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদেরকে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। ফ্যাসিবাদ সরকারের আস্থাভাজন হওয়ার কারণে, নিয়ম বহির্ভূতভাবে অনুমতি ছাড়াই সাত বছর বিদেশে অবস্থান করেন। যেখানে তার চাকরিই থাকার কথা না, সেখানে তিনি প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক পদে দাপটের রাজত্ব করছেন। তিনি সাবেক সরকারের হুইপ মো: ইকবালুর রহিমের অত্যন্ত আস্থাভাজন পরিচয়েও দিনাজপুরে প্রভাব বলয় সৃষ্টি করেন।
স্মারকলিপিতে আরো অভিযোগ করা হয়, ড. গোলাম ফারুক মাসে দুই-তিনবার ঢাকায় যান। প্রতিবারই বিভিন্ন প্রজেক্ট থেকে চাপ প্রয়োগ করে ১০-১২ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন সচিব ওয়াহিদা আক্তারসহ বিভিন্ন কর্মকর্তার নাম করে। বিগত তিন বছর ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদেরকে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে বিভিন্ন দেশী ও বিদেশী প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা পকেটে ভরেছেন তিনি।

স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, গোলাম ফারুক প্রতিষ্ঠানটির জনবল নিয়োগেও অর্থ আত্মসাৎ ও স্বজনপ্রীতি করেছেন। প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ রেজাউল কবীরের আপন ভগ্নিপতি মো: নাজমুল হককে সহকারী প্রোগ্রামার (আইসিটি শাখা) পদে চাকরি দিয়েছেন। ভগ্নিপতি নিয়োগের একজন প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও রেজাউল কবীরকে ওই নিয়োগের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই ও নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কম্পাইল করার সাথে নিয়মবহির্ভূতভাবে সরাসরি সংয্ক্তু করেন গোলাম ফারুক। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব (গবেষণা উইং) কমলারঞ্জন দাসের আপন ভাগ্নে কপিল দেবকেও নিয়োগ দেন ফারুক। ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো: মোস্তফা খানের ভাগ্নে মো: আশরাফুল আলমকে বৈজ্ঞানিক সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তার আমলে। ড. মো: মোস্তফা খান আঞ্চলিক কেন্দ্র, গাজীপুরের বিজ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও তার ভাগ্নেকে চাকরি দেয়ার জন্য নিয়ম বহির্ভূতভাবে তিনি নিয়োগ সংক্রান্ত কাজে সংয্ক্তু হন। শুধু তা-ই নয়, মহাপরিচালক থাকা অবস্থায় নিয়ম বহির্ভূতভাবে সিনিয়র বিজ্ঞানীদেরকে টপকিয়ে জুনিয়রদের বিভিন্ন দেশী-বিদেশী প্রকল্পের পরিচালক করেন। ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কৃষ্ণ কান্ত রায়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরিতে (বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে) যোগ দেয়ার অভিযোগে দুদকের মামলা চলমান রয়েছে। তা সত্ত্বেও তাকে এসএসও পদে যথাসময়ে পদোন্নতি দেয়া হয়।
অন্য দিকে ড. মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমানের (প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক কেন্দ্র, জামালপুর) ২০২১ সালের জুনে পিএসও পদোন্নতি ডিউ হলেও আওয়ামী লীগ না করায় বঞ্চিত করা হয়। তাকে প্রায় তিন বছর দেরিতে গত মে মাসে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গোলাম ফারুক ডিজি হওয়ার পর তিনিও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে কর্মকর্তাদের পদায়ন করেছেন। তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় সমর্থক হিসেবে পরিচিত জুনিয়র কর্মকর্তাদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে পুরস্কৃত করেছেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটিকে তিনি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন। কৃষি মন্ত্রণালয় ড. গোলাম ফারুককে পদাবনতি করে পরিচালক করেছে। এতে তার প্রভাব একটুও কমেনি বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।

নাম না প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, গোলাম ফারুক বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের দোসর ছিলেন। তিনি ও তার সহযোগী প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদ পরিষদের নেতা ও সাবেক হাবিপ্রবি ছাত্রলীগের নেতা ড. মো: আব্দুল হাকিম ঢাকায় ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে মাঠে নেমে আন্দোলন করেছেন। তারা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংস করেছেন। দুর্নীতিবাজ এই হাকিমের বিরুদ্ধে দুদকের একটি মামলায় তদন্ত চলমান রয়েছে। তারা এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অপসারণ দাবি করেন।

এ দিকে ডিজির পদ থেকে সরানো গোলাম ফারুক বর্তমানে অন্য কয়েক কর্মকর্তাকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করছেন। ইন্টারন্যাশনাল হুইট কনফারেন্সে তিনি এবং প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আব্দুল হাকিম, সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আবুল আওলাদ খান ও ড. মো: ফরহাদ যোগ দিয়েছেন। অথচ এই সফরে ড. গোলাম ফারুকের যোগ দেয়ার কথা নয় বলে জানান গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা।
বিদেশে থাকায় পদোন্নতি ড. গোলাম ফারুকের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। আর গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের বর্তমান মহাপরিচালক সালাহউদ্দিন আহমেদকে ফোন দিলে তিনি রিসিভ করে জানান, এখন ফ্লাইটে উঠব (বিমানে) তাই কথা বলতে পারছি না।

 


আরো সংবাদ



premium cement