২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`
গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণ

বাংলাদেশকে অনেক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে

-

গণ-অভ্যুত্থানের স্বপ্ন বাস্তবায়নে নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে অনেক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। ব্রিটিশ মিডিয়া দ্য গার্ডিয়ানের নিবন্ধে বলা হয়েছে দিকনির্দেশনা নিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন স্থির হয়ে আছে। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিদায়ের পর জনগণের উত্তেজনা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে অন্তর্বর্তী সরকার উপলব্ধি করতে পারছে যে, তাদের ওপর মানুষের প্রত্যাশার ওজন অনেক বেশি। তার পরও বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ অন্তর্বর্তী সরকারকে কাক্সিক্ষত সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় সময় দিতে রাজি।
বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে গার্ডিয়ান বলছে, হাসিনার শাসনের পতনের মাত্র এক মাসের কিছু বেশি সময় পরে বাংলাদেশ এখন একটি মোড়কে দাঁড়িয়েছে। বিজয়ী ছাত্র নেতাদের অনুরোধে, নোবেল বিজয়ী ও হাসিনার আক্রোশের শিকার ড. মুহাম্মদ ইউনূস, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিতে সম্মত হন। উপদেষ্টা পরিষদে যারা আছেন তাদের অনেককেই একসময় হাসিনা রাষ্ট্রের শত্রু বলে মনে করতেন, যার মধ্যে বিশিষ্ট এনজিও প্রধান, আইনজীবী, সাংবাদিক, কর্মী এবং ছাত্ররাও আছেন। গার্ডিয়ান সরেজমিন দেখতে পেয়েছে রাজধানী ঢাকার রাজপথে এখনো আশাবাদ বিরাজ করছে। লোকেরা আনন্দের সাথে ‘বাংলাদেশের জন্য দ্বিতীয় স্বাধীনতা’, রাতারাতি বাকস্বাধীনতার প্রত্যাবর্তনের স্বস্তির কথা বলছে এবং রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করার সময় আর ভয়ের সাথে তাদের কাঁধের দিকে তাকাতে হচ্ছে না।
ঢাকার একটি হোটেলের লবিতে বসে প্রখ্যাত মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন স্মরণ করেন যে, কয়েক সপ্তাহ আগ পর্যন্ত তিনি সার্বক্ষণিক পুলিশি নজরদারিতে ছিলেন এবং জনসমক্ষে অবাধে সভা করতে পারবেন, তা কল্পনাও করতে পারেননি। বিএনপি নেতারা, যাদের অনেকের বিরুদ্ধে শত শত ফৌজদারি মামলা হয়েছে, তারা আর আদালত কক্ষে বা কারাগারে বসে দিন কাটাচ্ছেন না।
তবুও দেশটি এখনো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারেনি এবং কিছু ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে। গত এক মাস ধরে ব্যাপক বিক্ষোভের কারণে অনেক কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে, অনেকগুলো বন্ধও হয়ে গেছে। লাভজনক পোশাক শিল্পকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। অর্থনৈতিক স্থবিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে।
পুলিশকে হাসিনার শাসনে নিয়মিতভাবে বেসামরিক নাগরিকদের আতঙ্কিত রাখতে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে পুলিশের প্রতি মানুষের আক্রোশ তৈরি হয়। গণ-অভ্যুত্থানের সময় বেশ কয়েকটি থানায় আগুন দেয়া হলে পুলিশ বাহিনী একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এখনো অনেক পুলিশ কাজে যোগ দেননি। ফলে এখন অনেক ক্ষেত্রে বেসামরিক ব্যক্তিরা ঘটনার সমাধান করতে, অন্যায়ের অভিযোগ জানাতে বা সাহায্য চাইতে পুলিশের পরিবর্তে ছাত্র গোষ্ঠীগুলোর কাছে যাচ্ছে।
এই সপ্তাহে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার সামরিক বাহিনীকে গ্রেফতার ও তল্লাশি পরোয়ানাসহ পুলিশি দায়িত্ব পালনের জন্য বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে। যদিও সরকার বলছে ব্যবস্থাটি অস্থায়ী, কেবল দুই মাসের জন্য।
বিশ্লেষকরা বলছেন যে, ড. ইউনূস ও তার উপদেষ্টারা যে উচ্চাভিলাষী গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা জটিল; যার মধ্যে মূল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শুরু থেকে পুনর্গঠনের বিষয়টি জড়িত এবং এটি বাস্তবায়নে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা ছাত্রদের জন্য, যাদের মধ্যে অনেকেই এখন ড. ইউনূসের ডান দিকে বসেন, তাদের কাজটি হলো পুলিশ থেকে বিচার বিভাগ, শেয়ারবাজার থেকে ব্যাংক এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার সব কিছুর পুনর্বিবেচনা করা যাতে নিশ্চিত করা যায় যে কর্তৃত্ববাদ কখনো ফের চেপে বসবে না। আবার অনেকে সংবিধান পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছেন, যা হাসিনা সংশোধন করেছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে অধ্যয়নরত প্রতিবাদ সমন্বয়কারী রেজওয়ান আহমেদ রেফাত বলেন, ‘এটি একটি বিশাল ও জটিল প্রক্রিয়া। প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে হাসিনা যে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা চালু করেছিলেন তার অনেকগুলো এখনো আছে। সরকারি সচিবালয়, পুলিশ ও বিচারব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে আমাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। যতক্ষণ না এই প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীন হবে, ততক্ষণ কিছুই বদলাবে না।’
‘এই সংস্কারে সময় লাগবে’
রেফাত বলেন, ড. ইউনূসের পক্ষে এখনো লাখ লাখ লোকের একটি শক্তিশালী ম্যান্ডেট রয়েছে, যার জন্য তারা রাস্তায় নেমেছিল। সরকার যদি দ্রুত অগ্রসর না হয় এবং শিগগিরই তাদের সংস্কার এজেন্ডার সুনির্দিষ্ট বিবরণ না দেয় তবে শিক্ষার্থীরা আবারো প্রতিবাদ করতে দ্বিধা করবে না।
তবুও ব্যক্তিগতভাবে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, অন্তর্বর্তী সরকার ‘হারিয়ে গেছে’ এবং খুব বেশি কিছু নেয়ার চেষ্টা করছে বলে মনে হচ্ছে। তবে খুব কম জনই প্রকাশ্যে কথা বলতে চান, প্রফেসর ইউনূসকে হেয় করতে দেখতে চান না তারা।
হাসিনার প্রস্থানের পর জনগণের উচ্ছ্বসিত হওয়ার পর, সরকার স্বীকার করেছে যে প্রত্যাশার ওজন অনেক বেশি এবং সংস্কারের পথটি চ্যালেঞ্জে পরিপূর্ণ, বিশেষ করে যখন হাসিনা গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটে দেশকে রেখে যান। সরকারের উপদেষ্টাদের মতে, ২০১৪ সাল থেকে হাসিনার তথাকথিত ‘বন্ধুরা’ কয়েক বিলিয়ন ডলার অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে পাচার করেছে, দুর্নীতি ও ক্ষতির মাত্রা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ধৈর্যের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন যে, অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার বলতে ঠিক কী বোঝায় তার রূপরেখা এখনো চূড়ান্ত করা হচ্ছে এবং সম্ভবত আগামী কয়েক মাসের মধ্যে স্বচ্ছ হয়ে উঠবে। নতুন সরকারে অন্যদের মতো, বাংলাদেশের একটি নতুন রূপকল্প বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছেন, যার জন্য তরুণরা তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে। তৌহিদ হোসেন বলেন, কাজ শেষ হলেই আমরা নির্বাচন করব। ‘রাজনীতিবিদরা আসবে, দেশ চালাবে এবং আমরা বিবর্ণ হয়ে যাবো। আমাদের কারোরই ভবিষ্যৎ সরকারের কোনো পদে থাকার কোনো উচ্চাকাক্সক্ষা নেই। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বয়স ইতোমধ্যে ৮৪।’
তা সত্ত্বেও অনেকের কাছে বড় প্রশ্ন হল উপদেষ্টারা কত দিন ক্ষমতায় থাকতে চান। যদিও প্রাথমিকভাবে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল যে এটি মাত্র কয়েক মাস হবে, অনেকেই এখন বিশ্বাস করেন যে, এটি পাঁচ বা ছয় বছর পর্যন্তও হতে পারে, যাতে তাদের দেশের মূল প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিপূর্ণ মেরামত করার জন্য সময় দেয়া যায়। জোরপূর্বক গুমের মতো বিষয়গুলো দেখার জন্য সরকার কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলেছেন যে, তাদের প্রাথমিক তদন্ত করতে কমপক্ষে ১৮ মাস সময় লাগবে।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি সময়সীমা সম্পর্কে অনুমান করব না, তবে আমি মনে করি না যে এটি তিন বা ছয় মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। এই সংস্কারে সময় লাগবে।’
আপাতত বিএনপি এ ব্যাপারে পিছু হটতে সম্মত হয়েছে এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে তাদের নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে সংস্কার বাস্তবায়ন করতে দিতে সম্মত হয়েছে এই আশায় যে, ড. ইউনূসের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে দৃঢ় সংযোগ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বৈদেশিক অর্থনৈতিক সহায়তাকে উৎসাহিত করবে। বিএনপির সিনিয়র নেতা আবদুল মঈন খান বলেন, ‘যদি এই ক্রান্তিকালীন সরকার সফল না হয়, তা হলে এটি শুধু সরকারকেই ধ্বংস করবে না, বাংলাদেশকেও ধ্বংস করবে।’
তার পরও কয়েক বছর স্থায়ী অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার প্রসঙ্গে বিএনপি প্রায়ই পিছিয়ে যায়। এটি সর্বজনস্বীকৃত যে, হাসিনার আওয়ামী লীগ দল ছিন্নভিন্ন অবস্থায়, তার বেশির ভাগ নেতা আত্মগোপনে বা বিদেশে থাকলে, বিএনপি যেকোনো নির্বাচনে বিশাল বিজয় পাবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য বিএনপির অধৈর্য হয়ে ওঠা অস্থিরতার কারণ হতে পারে। অন্যরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, চলমান রাজনৈতিক শূন্যতা বাংলাদেশে সক্রিয় ইসলামপন্থী দলগুলোকে আরো বেশি এগিয়ে যেতে সক্ষম করতে পারে।
কিন্তু রাস্তায়, বেশির ভাগ মানুষই ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদী। ৩৫ বছরের গাজী জাকারিয়া, যিনি ৪০০ জন আহতদের মধ্যে একজন, বিক্ষোভ চলাকালীন হামলায় আংশিকভাবে অন্ধ হয়েছিলেন, যখন তাকে পুলিশ গুলি করে এবং তারপরে তাকে কয়েক সপ্তাহ ধরে কোনো চিকিৎসা ছাড়াই কারাগারে ফেলে রাখা হয়। তিনি বলেন, হাসিনার পতনের জন্য এই আত্মত্যাগে আমার কোনো অনুশোচনা নেই। আমরা পরিবর্তনের জন্য লড়াই করতে রাস্তায় নেমেছিলাম এবং ড. ইউনূসের সরকার সেটাই করছে তাই আমি খুশি। আমরা রাতারাতি সব কিছু ঠিক করতে পারি না।
অনেক বিরোধী রাজনৈতিক নেতার মতো বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও যে দিন প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন সে দিন জেলে ছিলেন। ১৫ বছর আগে হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর এটি ছিল চৌধুরীর তৃতীয় কারাবাস। ৫ আগস্ট চৌধুরী জানতে পারেন যে, তার চারপাশের কারাগারগুলো, গ্রেফতারকৃত ছাত্র ও বিএনপি সদস্যে ভরা। কেউ কেউ খবর পায় যে হাসিনা হেলিকপ্টারে পালিয়ে গেছে কারণ প্রায় ১০ লাখ লোক তার বাসভবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তিনি বলেন, ‘যখন আমরা শুনলাম সে চলে গেছে, এটা জেলে বোমা বিস্ফোরণের মতো ছিল।’ পরদিন সকালে মাহমুদ চৌধুরী ও সহবন্দীদের মুক্তি দেয়া হয়।
এবার বাংলাদেশে বিরোধী দল নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিক্ষোভ শুরু করেছিল। তাদের আন্দোলন যখন গতি পেতে শুরু করে এবং হাসিনার বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়, তখন গার্মেন্টশ্রমিক, কৃষক, আইনজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি বিএনপি এবং অন্যান্য দলও রাস্তায় নেমে আসে।
মারধর, টিয়ারগ্যাস, রাবার বুলেট ও গোলাবারুদ ব্যবহার করে রাষ্ট্র বিক্ষোভকারীদের ওপর পাল্টা আঘাত করেছিল। কিন্তু বিক্ষোভগুলো এমনভাবে ফুঁসে ওঠে যে, হাসিনার পদত্যাগের দাবি জানিয়ে তা একটি সম্পূর্ণ গণবিপ্লবে পরিণত হয়। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে হাজার হাজার লোককে গ্রেফতার এবং এক হাজারেরও বেশি লোককে হত্যা করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী পর্বগুলোর একটি।


আরো সংবাদ



premium cement