এক পিস ছাগলের চামড়ার দাম ৩ টাকা ৮৫ পয়সা
- এম. আইউব, যশোর অফিস
- ২২ জুন ২০২৪, ১৪:০২, আপডেট: ২২ জুন ২০২৪, ১৪:১৭
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্ববৃহৎ চামড়ার বাজার যশোরের রাজারহাট থেকে লোকসান নিয়ে ফিরেছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। এমন কোনো ব্যবসায়ী পাওয়া যায়নি যার লোকসান হয়নি। শনিবার ছিল ঈদ পরবর্তী রাজারহাটের প্রথম বাজার। এদিনই লোকসানের কথা জানান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগের রাতেই চামড়া নিয়ে হাজির হন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। বাইরে থেকে আসা ব্যাপারীরাও আগের রাতে এসে অবস্থান নেন বিভিন্ন হোটেল-মোটেলে। সকাল ৭টা থেকে শুরু হয়ে যায় কেনাবেচা। এবারো এর ব্যতিক্রম হয়নি। তবে এই বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে কোনো চামড়া কেনাবেচা হয়নি। অধিকাংশ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী লোকসানে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। গরুর চামড়া মোটামুটি বিক্রি হলেও বিপাকে পড়েন ছাগলের চামড়া বিক্রেতারা। প্রতি পিস ছাগলের চামড়া তিন টাকা ৮৫ পয়সায়ও বিক্রি করতে দেখা গেছে। আবার কারো কারো ছাগল ও ভেড়ার চামড়ার দাম বলেননি কোনো ব্যাপারী- এমন ঘটনাও ঘটেছে। বাজারে এমন কোনো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পাওয়া যায়নি যে তার গরুর চামড়ায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা লোকসান হয়নি। সবমিলিয়ে বড় বাজারে বড় দরপতন হয়েছে।
গত ৩ জুন চামড়া খাতের একাধিক সংগঠনের নেতাদের সাথে বৈঠক করে কোরবানির পশুর চামড়ার দর নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেই অনুযায়ী, ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫৫-৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০-৫৫ টাকা। ঢাকার বাইরে গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫০-৫৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৪৫-৪৮ টাকা। এ ছাড়া খাসির লবণযুক্ত চামড়া ২০-২৫ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৮-২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
রাজারহাটে আসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, আড়তদার ও ব্যাপারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত বড় আকারের গরুর চামড়া ৩১ থেকে ৪০, মাঝারি আকারের ২১-৩০ এবং ছোট আকারের গরুর চামড়া ১৬-২০ বর্গফুটের হয়।
সরকার নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, যশোরের রাজারহাটে বড় আকারের লবণযুক্ত একটি গরুর চামড়া বিক্রি হওয়ার কথা কমপক্ষে এক হাজার ৭০৫ টাকা। মাঝারি আকারের গরুর ২৫ বর্গফুটের একটি লবণযুক্ত চামড়ার দাম হওয়ার কথা এক হাজার ৩৭৫ এবং ছোট আকারের একটি চামড়ার দাম হয় ৮৮০ টাকা।
তবে ১০ জনের বেশি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানান, সর্বোচ্চ নয় শ’ টাকার বেশি গরুর চামড়া বিক্রি হয়নি। সর্বনিম্ন দাম ছিল ৫০ টাকা। ছাগলের চামড়ার অবস্থা ছিল আরো করুন। তোষামোদ করেও পাঁচ টাকায় ছাগলের চামড়া বিক্রি করতে পারেননি অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।
অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, কেশবপুর থেকে আসা কালীদাস নামে এক বিক্রেতা ইমরান হোসেন পাপ্পু নামে এক আড়তদারকে তার ৫২ পিস ছাগলের চামড়া পাঁচ টাকা করে কেনার জন্য তোষামোদ করতে থাকেন। পাপ্পু ৫২ পিস চামড়া নিয়ে পাঁচ টাকা হিসেবে ৪০ পিসের দাম দেয়ার শর্ত দেন। কালীদাস উপায় না পেয়ে তাতেই রাজি হন। সেই হিসেবে কালীদাস এক পিস ছাগলের চামড়া বিক্রি করেন তিন টাকা ৮৫ পয়সায়।
এখানেই শেষ না, বাজারে দু’স্তূপ ছাগলের চামড়া পড়ে থাকতে দেখে আশপাশের বিক্রেতাদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কোনো ব্যাপারী দাম না বলায় হতাশ হয়ে বিক্রেতারা সেগুলো ফেলে রেখে চলে গেছেন।
খুলনার কয়রা উপজেলার ঘুগরাকাটি থেকে গরুর ১১৭ পিস চামড়া নিয়ে রাজারহাটে আসেন ফটিক মণ্ডল।
তিনি জানান, তার প্রতি পিস চামড়ায় গড়ে দুই শ’ টাকা করে লোকসান হয়েছে। ছাগলের চামড়া বিক্রি করেছেন ১০ টাকায়। অথচ একটি চামড়ায় লবণ গেছে ৩০ টাকার। তার ওপর চামড়ার দাম তো রয়েছেই।
ডুমুরিয়া থেকে গরুর ২৫০ পিস চামড়া নিয়ে আসেন মনিরুল ইসলাম। তিনি পাঁচ শ’ থেকে নয় শ’ টাকায় চামড়া বিক্রি করেন। তার বড় একটি লোকসান হচ্ছে বলে জানান তিনি।
নওয়াপাড়া থেকে ৪৫০ পিস চামড়া নিয়ে আসা অশ্বিনী জানান, তিনি ৫০ থেকে আট শ’ টাকায় গরুর চামড়া বিক্রি করেছেন। তার প্রতি চামড়ায় দুই শ’ থেকে চার শ’ টাকা পর্যন্ত লোকসান হয়েছে। প্রতি বছর লোকসান হওয়ার পরও কেন চামড়ার ব্যবসা করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি পেশা হিসেবে নিয়েছি। এ কারণে ব্যবসা না করে পারি না।’
৫০ বছর ধরে চামড়া ব্যবসা করছেন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার রাশেদ ব্যাপারী। তিনি আসেন ২৫০ পিস চামড়া নিয়ে। রাশেদ ব্যাপারী জানান, এক হাজার দুই শ’ টাকায় কেনা চামড়া তাকে নয় শ’ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। তার ৩০ হাজার টাকার মতো লোকসান হবে বলে জানান তিনি।
মঠবাড়িয়া থেকে আসা আব্দুল লতিফ নামে আরেক ব্যবসায়ী জানান, ছোট আকারের গরুর ২২ পিস চামড়া তিনি বিক্রি করেছেন মাত্র এক হাজার দুই শ’ টাকায়। অথচ ওই চামড়ার কেনা দামই ছিল চার হাজার চার শ’ টাকা। তার উপর লবণ, মজুরি ও পরিবহন খরচ রয়েছে। এভাবে একজনও ক্ষুদ্র বিক্রেতা পাওয়া যায়নি, যিনি লোকসানের কথা বলেননি।
রাজারহাটের আড়তদার শেখ হাসানুজ্জামান হাসু বলেন, ‘ভালো চামড়ার ভালো দাম। এবার আবহাওয়ার কারণে চামড়ার মান খারাপ। তাছাড়া, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া ঠিকমতো কিনতে পারে না। অনেক সময় তারা চামড়া বেশি দামে কিনে ফেলেন।’
কাজী আনিছুর রহমান নামে একজন রফতানিকারক বলেন, ‘ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা আজীবন বলবে লোকসান হয়েছে।’
তিনি এক ট্রাক ভালো মানের এঁড়ে গরুর চামড়া কিনবেন বলে জানান।
বৃহত্তর যশোর চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন মুকুল বলেন, ‘ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা প্রতি বছর বলে লোকসান হচ্ছে। এবার দাম ভালো। বাজারে ৩৫ হাজারের মতো চামড়া এসেছে।’