২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

পানিবন্দি মানুষের প্রাণের আকুতি : ত্রাণ নয়, টেকসই বেড়িবাঁধ চাই

- ছবি : নয়া দিগন্ত

ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে সুন্দরবন উপকূলীয় খুলনার পাইকগাছা উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল লণ্ডভণ্ড হয়েছে। বিশেষ করে উপজেলার বিভিন্ন পোল্ডারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেঁড়িবাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রামে মুহূর্তেই লবণ পানি প্রবেশ করে প্লাবিত হয়েছে হাজার-হাজার বিঘার চিংড়ি ঘের, ভেসে গেছে কোটি কোটি টাকার মাছ।

রোববার রাতে জোয়ারের ওপর জলোচ্ছ্বাসে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বেড়িবাঁধের একাধিক পয়েন্টে ভেঙে ও বাঁধ উপছে লোকালয়ে লবণ পানি ঢুকে ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট, পুকুর ও ফসলের ক্ষেত তলিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে।

যদিও শীবসার শাখা মাঙ্গা নদীর দেলুটির ২০, ২১ ও ২২ নম্বর পোল্ডারের পাউবোর বেড়িবাঁধের বিভিন্ন পয়েন্টে ভেঙে গোপিপাগলা, হাটবাড়িয়া, ফুলবাড়িয়া, সৈয়দখালী, সেনের বেড়, খেজুরতলা, বিগরদানা, দূর্গাপূর, কালীনগর, দারুনমল্লিক, নলডাঙ্গাসহ কমপক্ষে ১৪টি গ্রাম এখনো প্লাবিত রয়েছে। এসব এলাকার প্রায় ৯০ শতাংশ কাঁচা-ঘর বাড়ি ধসে পড়েছে। এছাড়া সেখানকার সহস্রাধিক পরিবার ওয়াপদাসহ আশপাশের রাস্তার ধারে পলিথিনের নিচে কোনো রকম আশ্রয় নিয়েছেন। যদিও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিদিন শুকনো খাবার পৌঁছালেও পর্যাপ্ত সূপেয় পানির অভাব দেখা দিয়েছে।

বৃহস্পতিবার দুর্গত এলাকায় সরেজমিনে প্রতিবেদনকালে কথা হয়, দারুনমল্লিক এলাকার প্রশান্ত অধিকারী ও গোপি পাগলার বিল্লমঙ্গলের সাথে। তারা বলেন, রেমালের হানা দেয়ার আগে শনিবার (২৫ মে) থেকে তারা সেখানকার বাঁধে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে বাঁধ রক্ষায় প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন।

তেলিখালীর দেবাশীষ গাইন ও নজরুল মোড়ল জানান, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে তাদের এলাকার ৯০ শতাংশ মাটির ঘর ধসে পড়েছে। সেখানকার বেশিভাগ পরিবার এখনো খোলা আকাশের নিচে ওয়াপদার ওপর জবুথবু বসবাস করছেন।

মূলত, রোববার (২৬ মে) রাতে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে উপজেলার পাউবোর বেঁড়িবাঁধের কমপক্ষে ৩৫টি স্থানে ভাঙনে বিস্তীর্ণ অঞ্চল লবণ পানিতে প্লাবিত হয়। এতে হাজার হাজার বিঘার চিংড়ি ঘের, ফসলের ক্ষেত ভেসে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েন প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার পরিবার। এ সময় প্লাবিত অঞ্চলসমূহের ৯০ শতাংশ কাঁচা ঘর-বাড়ি ধসে পড়ে। বাতাসের একটানা গতিবেগের সামনে ও গাছ পড়ে বৈদ্যুতিক পিলার উপড়ে পড়ে ও সংযোগ তার ছিড়ে পড়ে। এখনো প্লাবিত সব এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া সম্ভব হয়নি।

যদিও প্রথম থেকেই উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে পাউবো ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাসমূহে জিও ব্যাগ ও বস্তা সরবরাহ করে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামত কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছেন। ভাঙনকবলিত অনেক এলাকায় জোয়ারের পানির চাপে ফের লবণ পানি প্রবেশের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এ দিকে, পানিবন্দি ওয়াপদার রাস্তার ওপর ও আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করা পরিবারসমূহের মধ্যে সূপেয় পানির অভাব দেখা দিয়েছে। উপজেলা পরিষদ ও বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিসহ ব্যক্তি উদ্যোগে সরবরাহকৃত শুকনো খাবার তুলে দেয়া হলেও সূপেয় পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ারও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, তাৎক্ষণিক ১৩ হাজার ৪৬১টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েন। যার মধ্যে সম্পূর্ণ পানিবন্দি রয়েছে কমপক্ষে ৮৩১টি পরিবার। যাদের নারী, শিশু ও বয়স্কদের নিয়ে খানিকটা মানবিক সঙ্কট তৈরি হয়েছে।

ইতোমধ্যে দুর্যোগ পরবর্তী সরকারের ভূমি মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রীসহ একাধিক প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্যরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি সঙ্কট মোকাবেলায় তাদের পাশে থাকার আশ্বাস প্রদান করেন।

এছাড়া দুর্যোগ পরবর্তী প্রায় সার্বক্ষণিক সকল কার্যক্রমের ওপর নজর রাখছেন, খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য মো: রশীদুজ্জামান, উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ার ইকবাল মন্টু, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহেরা নাজনীন, সহকারী পুলিশ সুপার ডি-সার্কেল সাইফুল ইসলাম, থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ওবাইদুর রহমান, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইমরুল কায়েসসহ জনপ্রতিনিধিরা।

সবচেয়ে বড় ব্যাপার আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীরা সশরীরে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তারা প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকায় উপস্থিত হয়ে খাদ্যপণ্য সরবরাহের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতে সহযোগীতা করছেন।

প্রার্থীদের একজন আনন্দ মোহন বিশ্বাস বলেন, তিনি উপজেলার দুর্যোগপীড়িত সব এলাকায় গিয়েছেন। তাদের একটাই কথা ত্রাণ নয়, তারা শুধুমাত্র টেকসই বাঁধ চান। তাই তিনি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।

এমনকি বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুরু করে নদীতে জোয়ার আসা পর্যন্ত আনন্দ মোহন বিশ্বাসকে দেলুটির বিভিন্ন এলাকায় স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামতে অংশ নেয়া গণমানুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে দেখা গেছে।

এ দিকে, দুর্যোগপীড়িতরা গণমাধ্যমকর্মী আঁচ করতে পারলেই এগিয়ে আসছেন। এ সময় তারা মিডিয়ার মাধ্যমে তাদের দুর্দশার কথা তুলে ধরে সরকারের কাছে টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান।


আরো সংবাদ



premium cement