কপি এখন কৃষকের গলার কাঁটা
- ওয়াজেদুল হক মেহেরপুর
- ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৬:৩১
শীতের সবজি কপি এখন কৃষকের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক কষ্ট আর অর্থ বিনিয়োগ করে ফলানো ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই তাদের। কপির বড় কোনো খরিদ্দার নেই। নিজেরাও বাজারজাত করতে পারছেন না। বিক্রি করে যা টাকা হচ্ছে তা দিয়ে বস্তার খরচই উঠছে না। শ্রমিক খরচ, পরিবহন খরচ, জল খাবার সবই ঘর থেকে দিতে হচ্ছে। তাই জমিতেই পচে পচে নষ্ট হচ্ছে কৃষকের অর্থ আর ঘাম ঝরা এই সবজি।
সদর উপজেলার উজলপুর গ্রামের কৃষক আবু বক্কর জানান, তার তিন বিঘা জমিতে ফুলকপি ও বাঁধাকপি রয়েছে। ফলনও হয়েছে খুব ভাল। কয়েকদিন আগে এক ব্যবসায়ী তার সবচেয়ে ভালো এক বিঘা জমির ফুল কপির দাম দিতে চেয়েছেন মাত্র এক হাজার টাকা। দাম শুনে তিনি নিজেই লজ্জায় পড়ে যান। তিনি ওই ব্যবসায়ীকে বলেন, ‘ভাই যা বললেন- এ কথা আর অন্য কাউকে শুনাবেন না।’ তখন ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘আপনার জমিটা খালি করে দেয়ার জন্য আমি এ দাম বলেছি। আপনি যদি লেবার দিয়ে জমি পরিষ্কার করতে যান তাহলে আপনাকে ঘর থেকে টাকা গুনতে হবে। একই গ্রামের কফিল উদ্দিন জানান, তিনি চার বিঘা জমিতে কপি চাষের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত আড়াই বিঘা জমিতে ফুলকপি আর ওলকপির চাষ করেছেন। কিন্তু ওই জমি থেকে তার একটি টাকাও ফিরে আসেনি। আড়াই বিঘা জমিতে কপি চাষ করতে বীজ, সার, কীটনাশক, শ্রমিক, জমি চাষসহ সব মিলিয়ে প্রায় ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এখন তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। কারণ সার-কীটনাশকের দোকানে অনেক বকেয়া রয়েছে তার।
একই কথা জানালেন গাংনী উপজেলার গাড়াবাড়িয়া গ্রামের কৃষক ফড়ি। তিনি বলেন, মাঠের পর মাঠজুড়ে রয়েছে কপি। কপির চেহারা দেখলে মন জুড়িয়ে যাবে। কিন্তু সে সব কপি বিক্রি না হওয়ায় জমিতেই পচে নষ্ট হচ্ছে। অনেকে গরু ছাগলের খাবারের জন্য কেটে কেটে নিয়ে যাচ্ছে। জমির কাছে গেলে কৃষকের বুক ভেঙে যায়। অনেকের রাতের ঘুম চলে গেছ। ঋণ করে সার-কীটনাশক কিনেছেন, দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়েছেন। যত দিন যাবে সুদের বোঝা তত ভারী হবে। কী করে সে ঋণ পরিশোধ করবেন তা ভেবে চোখে অন্ধকার দেখছেন।
এ গ্রামের বড় সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ী হাজী শওকত হোসেন জানান, প্রায় চারশ’ চাষি তার দোকান থেকে বাকিতে সার-কীটনাশক নিয়ে গেছেন। কপি বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করার কথা। কিন্তু চাষিদের কাছ থেকে জানতে পারছি তাদের কপি জমিতেই নষ্ট হচ্ছে। গরু-ছাগলকে খাওয়ানো হচ্ছে। চাষিরা চোখে অন্ধকার দেখছেন। একদিকে বকেয়া পরিশোধের চিন্তা অপর দিকে পরবর্তী ফসলের চাষ কিভাবে হবে, তা নিয়ে ভাবনার শেষ নেই তাদের।
এত হতাশার মধ্যে বাঁধাকপি চাষিদের আশার আলো দেখিয়েছে অ্যঅগ্রো ফ্রেশ এক্সপোর্টার্স নামে একটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। সিঙ্গাপুরে রফতানি করার জন্য এ প্রতিষ্ঠানটি বাঁধাকপি মাঠ থেকে মোড়কজাত করে নিয়ে যাচ্ছে। অ্যাগ্রোফ্রেশ এক্সপোর্টাস কেন্দ্রের ম্যানেজার রুবেল আহমেদ জানান, গাংনী উপজেলার ৫৫ জন কৃষক রফতানি উপযোগী বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করেছেন। মূলত তাদের সাথে চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে এই অঞ্চলের বাঁধা কপি প্রথমে সিঙ্গাপুর, পরে পর্যায়ক্রমে আরো বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হবে। এবারে তারা ১০০ একর জমির বাঁধাকপি সিঙ্গাপুরে পাঠাবেন। আগামী বছর আরো তিনগুণ বেশি সবজি এ জেলা থেকে বিদেশে রফতানি করা হবে। মেহেরপুরের বিষমুক্ত স্বাস্থ্যসম্মত সবজি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতে এবার মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাধ্যমে অ্যাগ্রোফ্রেশ এক্সপোর্টার্স নামে রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্যসহ ১২টি দেশের সাথে নতুন চুক্তি করেছে। বিঘাপ্রতি ৫৫ হাজার টাকা চুক্তিতে চুক্তিবদ্ধ চাষিদের হাতে আগেই রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানটি টাকা তুলে দিয়েছে।
রফতানির সুযোগের বিষয়ে একাধিক চাষির সাথে কথা বললে তারা জানান, জেলার সব চাষিতো আর রফানিতারকদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে পারবেন না। যারা চুক্তিবদ্ধ হবেন তারাই হয়তো দামের নিশ্চয়তা পাবেন। অন্য চাষিদের অবস্থা আগের মতোই থাকবে। কারণ চাহিদা থাকলে কদর থাকবে, না থাকলে গরু ছাগলে খাবে।
মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক স্বপন কুমার খাঁ বলেন, জেলায় এ বছর ৪ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় সবজির ফলনও হয়েছে ভালো। তবে বাজার দর পড়ে যাওয়ায় চাষিরা কিছুটা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তবে বিদেশে রফতানির সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় আশার আলোও দেখছেন অনেক চাষি। দেশের সবজি বিদেশে পাঠানোর উপযোগী করে ফসলকে লাভজনক ও ঝুঁকিমুক্ত করতে সরকার এ পদক্ষেপ নিয়েছে। অ্যাগ্রোফ্রেশ এক্সপোর্টার্সের সাথে চুক্তিবদ্ধ চাষিদের জমির মাটি পরীক্ষা থেকে শুরু করে ফসল তোলা পর্যন্ত কৃষি বিভাগের নিবিড় তত্ত্বাবধানে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন নিশ্চিত করা হচ্ছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা