২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৩ শাবান ১৪৪৬
`

ঝিনাইদহে তিনজনকে হত্যা, দায় স্বীকার নিয়ে ধোঁয়াশা

ঝিনাইদহে তিনজনকে হত্যা, দায় স্বীকার নিয়ে ধোঁয়াশা (ঝিনাইদহ জেলার ম্যাপ) - ছবি : নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা ঝিনাইদহে তিনজনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের ঘটনায় দায় স্বীকার নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধোঁয়াশা।

শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাতে হত্যার ঘটনাটি ঘটেছে জেলার শৈলকুপা উপজেলার রামচন্দ্রপুর মাঠের শ্মশানঘাট এলাকায়।

নিহতরা হলেন হানিফ আলী (৫০), লিটন হোসেন ও রাইসুল ইসলাম।

নিহতদের মধ্যে হানিফ আলীর বিষয়ে স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, হানিফ নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতা ছিলেন।

বাকি দু’জন সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন কিনা, তা জানা সম্ভব হয়নি।

জানা গেছে, হানিফ আলীর সাথে তাদের দু’জনের বেশ সখ্যতা ছিল। লিটন হোসেন ছিলেন হানিফ আলীর শ্যালক। তিনি হানিফের সাথেই চলাফেরা করেন।

আর পাশের জেলা কুষ্টিয়ার রাইসুল ইসলাম স্নাতকোত্তর শেষ করে এলাকাতেই থাকতেন।

এদিকে একটি ‘চরমপন্থি দলের’ পরিচয় দাবি করে ‘দায় স্বীকারের’ বার্তা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

স্থানীয় সাংবাদিক ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার রাত আটটার দিকে স্থানীয়রা শ্মশানঘাট এলাকায় গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান। পরে খবর পেয়ে রাত ১২টার দিকে সেখানে গিয়ে একটি খালের পাশে পড়ে থাকা তিনজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহতদের প্রত্যেকের মাথায়ই গুলির চিহ্ন রয়েছে।

এর পরই গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে আসা একটি বার্তায় বলা হয়, ‘জাসদ গণবাহিনী’ নামে একটি সংগঠনের সদস্যদের হাতে এই তিনজন নিহত হয়েছেন।’

অতীতে এ নামে একটি সংগঠনের অস্তিত্ব থাকলেও এখন সক্রিয়তা আছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

শৈলকুপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুম খান শনিবার দুপুরে বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘হত্যার ঘটনায় শনিবার রাত পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি।’

স্থানীয়রা বলছেন, সীমান্তবর্তী এই জেলা ও আশপাশের এলাকায় একসময় একাধিক চরমপন্থি দলের ব্যাপক প্রভাব ছিল। প্রায়ই সংবাদ হতো হত্যা-অপহরণের। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সহিংসতার ঘটনা খুব একটা চোখে পড়েনি। এ ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে আবারো দানা বেঁধে ওঠেছে আতঙ্ক।

এদিকে ঝিনাইদহের স্থানীয় সাংবাদিক বিমল সাহা বিবিসিকে জানিয়েছেন, ‘নিহত হানিফের নামে অনেক মামলা ছিল। সেইসাথে, হানিফ আওয়ামী লীগের সাথেও জড়িত ছিলেন মৎস্যজীবী লীগ।’

বিবিসিকে শৈলকুপা থানার ওসি মাসুম খান জানান, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সাথে হানিফ জড়িত। তার নামে ১৭টি মামলার মধ্যে নয়টিই হত্যা মামলা।’

হত্যার শিকার ‘বাকি দু’জন হানিফের সহযোগী’ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

মাসুম খান আরো বলেন, ‘বিগত সময়ে ওকে হায়ার করতো বিভিন্ন দল। প্রয়োজন হলে ওকে ‘মাসল পাওয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করতো। গত ১৫ বছরে তো আওয়ামী লীগই ছিল, তারাই করছে।’

এদিকে শুক্রবার রাতেই এ তিনজনকে হত্যার ‘দায় স্বীকার করে’ সাংবাদিকদের কাছে হোয়াটসঅ্যাপে একটি ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়। এতে ‘জাসদ গণবাহিনী’ ও ‘কালু’ নামগুলো ব্যবহার করা হয়েছে।

বার্তায় লেখা ছিলো ‘ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনাবাসীর উদ্দেশে জানানো যাচ্ছে, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী কুখ্যাত ডাকাত বাহিনীর শীর্ষ নেতা অসংখ্য খুন, গুম, দখলদারী, ডাকাতি ও ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হরিণাকুন্ডুর হানিফ তার দুই সহযোগীসহ জাসদ গণবাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছেন।’

সেখানে হুঁশিয়ারি দিয়ে আরো বলা হয়, ‘এই অঞ্চলের হানিফের সহযোগীদের শুধরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হলো, অন্যথায় আপনাদের একই পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে।’

শৈলকুপা থানার ওসি বিবিসি বাংলাকে কালুর পরিচয়ের বিষয়ে বলেন, ‘কালু ইতিপূর্বে বিভিন্ন হত্যা করছে, তার নামে বিভিন্ন অভিযোগ আছে। সে আন্ডারওয়ার্ল্ডের লোক। সে এখন পলাতক, তাকে প্রকাশ্যে দেখা যায় না।’

‘ওর এক ভাই ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ছিল। আরেক ভাই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সেক্রেটারি ছিল,’ যোগ করেন তিনি।

কালুর বাড়ি কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামে বলেও তিনি জানান।

খুনের নেপথ্যে কারণ

স্থানীয় সাংবাদিক, পুলিশ, মানবাধিকারকর্মীরা বিবিসি বাংলাকে জানায়, চরমপন্থি দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকতে পারে।

এ বিষয়ে শৈলকুপা থানার ওসি মাসুম খান বলেন, ‘দলের মাঝেই দ্বন্দ্ব ছিল, এখন পর্যন্ত এটাই সামনে এসেছে। তদন্ত হয়ে গেলে আমরা বলতে পারবো।’

স্থানীয় সাংবাদিক বিমল সাহা এলাকার বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে জানান, হানিফের নামে নতুন করে কোনো সংগঠন হচ্ছিলো, সেটিকে প্রতিরোধ করার জন্য হতে পারে। পূর্ব শত্রুতাও পারে।

আরেক সাংবাদিক নয়ন খন্দকার বলেন, ‘চরমপন্থি দলের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দক্ষিণাঞ্চলে এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। তবে অনেকদিন এই ধরনের সহিংসতা ছিল না। দীর্ঘদিন পর আবার এরকম হত্যাকাণ্ড ঘটলো।’

ওই জেলার মানবাধিকারকর্মী আমিনুর রহমান বলেন, ‘হঠাৎ করে গতকাল এটা ঘটেছে।’ এখানে অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকতে পারে বলেও জানান তিনি।

তিনি আরো বলেন, ‘বিগত অনেক বছর ধরে অনেকে কারাগারে ছিল। সরকার পতনের পর যারা বেরিয়েছে। তাদের হয়তো শত্রুতা ছিল। এগুলো সেই শত্রুতার প্রতিশোধও হতে পারে।’

শৈলকুপা থানার ওসি এ বিষয়ে বলেন, ‘কিছু কিছু নাম আসছে যারা দলীয় কোন্দলে আছে। এদের অনেকেই জামিন পেয়ে গেছেন।’

জানা গেছে, নিহতদের প্রত্যেককে শুক্রবার রাতে ফোন করে বাড়ি থেকে ডাকা হয়েছিলো। তবে কারা ডেকেছিলো, কী বলে ডেকেছিলো সে বিষয়ে এখনো কিছু জানা যায়নি।

ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সভাপতি এম এ মজিদের বিবিসিকে বলেন, ‘এই ঘটনা চরমপন্থিদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতা। এটি আগে থেকেই আছে।’

‘পুলিশ-প্রশাসনের নজরদারির দুর্বলতার কারণে এই ঘটনা ঘটেছে’ বলে তিনি মনে করেন।


আরো সংবাদ



premium cement