১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

‘এমন কাজ করবো, একদিন গর্ব করবে’ : বাবাকে শহীদ জাবের

‘এমন কাজ করবো, একদিন গর্ব করবে’ : বাবাকে শহীদ জাবের - সংগৃহীত

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার হাজিরবাগ ইউনিয়নের দেউলি গ্রামের মেধাবী তরুণ ইমতিয়াজ আহম্মেদ জাবির (২০)।

জাবির রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না। ছিল না তার কোনো বাড়তি চাহিদা, বায়না কিংবা আবদার। জাবির এতোটাই সহজ-সরল ছিল যে বাবা নওশের আলী মাঝে মাঝেই বিরক্ত হয়ে বলতেন, ‘তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না’।

জাবির বলতেন, ‘একদিন এমন কাজ করবো, তুমি ভাবতেও পারবা না, আমার জন্যে গর্ব করবা’।

ঘরের বারান্দায় বসে এভাবেই ছেলেকে স্মরণ করছিলেন জাবিরের বাবা নওশের আলী। বলছিলেন, ‘আজ মানুষ আমাদের শহীদের মা, শহীদের বাবা বলছে। সে যে সত্যি সত্যিই এমন কাজ করবে, আমাদের ভাবনাতেও আসেনি।’

নওশের আলী বলেন, ‘এসএসসি, এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করে জাবির। সাউথ-ইস্ট ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ’তে ভর্তি হয়। আমরা মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবার। মাঠে চার-পাঁচ বিঘা জমি আছে। সেখানকার আয়-রোজগার দিয়ে সংসার চলে। ছোট একটা মুরগির খামার করেছিলাম, বন্ধ হয়ে গেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ চালানো খুবই কষ্টকর ছিল। তারপরও একমাত্র ছেলে বলে বহু কষ্টে পড়াচ্ছিলাম। প্রথম বর্ষে ছিল। বনশ্রী এলাকায় একটি মেসে থাকতো।’

জাবিরের মা মোছাম্মত শিরিনা বলেন, ‘ছেলের স্বপ্ন ছিল স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকা যাবে। একমাত্র ছোট বোনকে ভালোভাবে পড়াশুনা করাবে। ভালো বিয়ে দেবে। সারাক্ষণ শুধু বাবা, মা আর বোনের চিন্তা করতো। নিজে রাজনীতি করতো না। বাবা রাজনীতির সাথে কিছুটা জড়িত ছিল বলে বকাবকি করতো। ছেলেকে ঘিরে কতো স্বপ্ন ছিল, সব আজ শেষ।’

নওশের আলী বলেন, কোরবানির ঈদে বাড়ি এসেছিল জাবির। ঈদের সপ্তাহখানেক পর আবার ঢাকায় চলে যায়। আর বাড়িতে আসেনি। মৃত্যুর পর তার লাশটা বাড়ির উঠানেও নিতে দেয়নি পুলিশ আর গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা। ২৬ জুলাই রাত ১১টায় এলাকায় লাশ পৌঁছানোর পরপরই পারিবারিক কবরস্থানের পাশে দ্রুত জানাজা পড়া হয়। এরপর সাথে সাথেই কবর দিয়ে দেয়া হয়।

জাবিরের বাবা বলেন, ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে মহাখালীতে অংশ নেয় জাবির। এদিন তার শরীরে কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট লাগে। কিন্তু বাড়িতে কাউকে সে বলেনি। ঢাকার আন্দোলনের খবর শুনে ভয় হতো। ফোনে তাকে বলতাম ঘর থেকে না বেরুনোর জন্য।  জাবির বলতো, ‘ঘরে কে আছে? সবাই বাইরে, আমি স্বার্থপরের মতো ঘরে থাকবো কী করে?’

পরদিন ১৯ জুলাই রামপুরায় আন্দোলনে অংশ নেয় জাবির। বেলা আড়াইটার দিকে পুলিশ সেখানে গুলি চালায়। জাবিরের চোখের সামনে পুলিশের গুলিতে আন্দোলনরত দু’জনের মৃত্যু হয়। ওই দু’জনকে উদ্ধার করতে গিয়েই জাবিরের উরুতে গুলি লাগে।

জাবিরের মামা ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ১৯ জুলাই বিকেলে কেউ একজন তার কাছে ফোন করে জানায় যে জাবির মুগদা হাসপাতালে ভর্তি, তার জন্য দ্রুত রক্ত লাগবে। পরিচিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে এক ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করা হয়। আমরাও ঢাকায় পৌঁছে রাতেই জাবিরকে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে ভর্তি করি। শনিবার জাবিরের অবস্থা একটু ভালো হয়। পরিবারের সবার সাথে কথাও বলে। কিন্তু হঠাৎই তার কিডনিতে সমস্যা দেখা দেয়।

ডাক্তাররা বলেন, গুলিতে তার কিডনির একটি শিরা বন্ধ হয়ে গেছে। তারা জাবিরের পা কেটে ফেলার পরামর্শ দেন। গত ২২ জুলাই জাবিরকে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু এদিন ডাক্তাররা বলেন, পা কাটার প্রয়োজন নেই। বৃহস্পতিবার জাবিরকে ডায়ালাইসিস করার জন্য নেয়া হয়। কিন্তু আধা ঘণ্টা পর ডায়ালাইসিস বন্ধ হয়ে যায়। নেয়া হয় আইসিইউতে। বিফলে যায় সব চেষ্টা। ২৬ জুলাই শুক্রবার বিকেল ৪টায় শেষবারের মতো নিঃশ্বাস নেন জাবির।

ডানপিটে ছোট বোন এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী জেরিনকে নিয়ে চিন্তার শেষ ছিল না জাবিরের। সেই ভাই আর নেই, একথা ভাবতেই পারছেন না বোন জেরিন।

মা শিরিনা বলেন, ভাইকে হারিয়ে মেয়েটা এখন আর ঘরের বাইরে বের হতে চায় না। মনমরা হয়ে থাকে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় উঠতেই জাবিরের কবর সামনে পড়ে।

জাবিরের চাচা ইব্রাহিম হোসেন বলেন, এলাকায় জাবিরদের রক্তদানের একটা গ্রুপ ছিল। কারো রক্তের প্রয়োজন হলে ওরা নিজেদের মধ্য থেকে ব্যবস্থা করতো। নিয়মিত নামাজ পড়তো। রোজার সময় বন্ধুরা মিলে এলাকায় ইফতার পার্টি দিতো। বন্ধুদের মধ্যে কোনো সমস্যা হলে জাবির ছাড়া কেউ তা মেটাতে পারতো না। এলাকার ছোট ছোট বাচ্চাদের ডেকে ডেকে সালাম দিতো, খাবার খাওয়াতো।

সম্প্রতি ঢাকায় গিয়েছিলেন জাবিরের বাবা নওশের আলী। জাবিরের বন্ধুদের সাথে কথা বলেছিলেন। বন্ধুদের উদ্ধৃতি দিয়ে নওশের আলী বলেন, সংঘর্ষের মধ্যে আহত অবস্থায় জাবির অনেককে বলেছিল, তাকে যেন দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হয়, রক্ত পড়া বন্ধ করতে পারলে সে বেঁচে যাবে। কিন্তু হাসপাতালে নিতে অনেক দেরি হয়ে যায়।

ডাক্তাররাও বলেছেন, মূলত অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণেই জাবিরকে বাঁচানো যায়নি।
নওশের আলী বলেন, ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ ছাড়া প্রধান সব দলের নেতাই তার বাড়িতে এসেছেন সান্ত্বনা দিতে। ঝিকরগাছার ইউএনও গিয়েছিলেন জাবিরদের বাড়িতে। গিয়েছিলেন জেলা প্রশাসকও। তিনি ২৫ হাজার টাকা দিয়েছেন। জামায়াতে ইসলামী দুই লাখ টাকা দিয়েছে। আমেরিকা প্রবাসী স্থানীয় এক ব্যক্তি ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন।

যশোরের জেলা প্রশাসক মো: আজাহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমি যশোরের জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেই জাবিরদের বাসায় গেছি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সামান্য কিছু টাকা দিয়েছি। সরকারিভাবে শহীদদের তালিকা চূড়ান্ত করা হচ্ছে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ীই শহিদ পরিবারকে সহায়তা দেয়া হবে।

এ দেশের ৩০ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা পতাকাকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে জীবন দিয়েছেন জাবির। যেন আরো বেশি লাল হয়ে সেই পতাকা আজ মুক্ত বাতাসে পতপত করে উড়ছে জাবিরের কবরের ওপরে। জাবির কি তা দেখতে পাচ্ছেন?
সূত্র : বাসস


আরো সংবাদ



premium cement
হাসিনার কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগ অনুঘটকের কাজ করেছে : ড. ইফতেখারুজ্জামান দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রদূতের সাথে বিএনপির প্রতিনিধি দলের সাক্ষাৎ দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে শি’র কাছে ‘গুরুতর উদ্বেগ’ প্রকাশ জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সিরাজদিখানে চালককে হত্যা করে অটোরিকশা ছিনতাই খুলনার দুঃখ বিল ডাকাতিয়া ২৩ দিন পর কাজে ফিরলেন গাজীপুরের টিএনজেড কারখানার শ্রমিকরা ‘সুপার টাইফুনে’ পরিণত হয়েছে ম্যান-ই : ফিলিপাইন মারাত্মক সঙ্কটে আয়ারল্যান্ডের অর্থনীতি সৈয়দপুরে ঘন কুয়াশায় ২ ঘণ্টা বিমান ওঠানামা বিলম্ব প্রতিটি সমস্যারই সমাধান আছে, যদি ধৈর্য-সাহস-অধ্যবসায় থাকে : ড. ইউনূস

সকল