উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে জাকাত
- ড. মুহাম্মাদ মোহন মিয়া
- ১৩ মে ২০২০, ০০:০০
জাকাত গরিবের হক হিসেবে আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। জাকাত দেয়া ফরজ । জাকাত না দিলে বা তা অস্বীকার করলে দুনিয়া ও আখেরাতে ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করতে হবে। আর জাকাত দিলে মানুষ তার সম্পদের পবিত্রতা ও বৃদ্ধিই অর্জন করবে না, এতে তার পরকালীন মুক্তির পথও সুগম হবে। এ ছাড়া জাকাত সামাজিক জীবন ও জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়নে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জাকাতের আর্থসামাজিক গুরুত্ব নি¤েœ বর্ণনা করা হলো :
জাকাত সম্পদ বৃদ্ধি ও পবিত্র করে : নবী করিম সা: বলেছেন, ‘তুমি যখন জাকাত দেবে তখন তা থেকে তার খারাবিকে দূর করে দিলে।’ যারা জাকাত দেয় তারা সবসময় চিন্তা করে যে, তার আয়টা যেন হালাল হয় এবং উপার্জনের মধ্যে যেন কোনো খারাবি না থাকে। এতে জাকাতদাতাদের মধ্যে সম্পদের পবিত্রতা অর্জনের প্রয়াসও সৃষ্টি হয়। হজরত আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, মহানবী সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার পবিত্র উপার্জন থেকে একটি খেজুরও সদকা (জাকাত) করে, আল্লাহ সেটা নিজ হাতে নিয়ে বর্ধিত করতে থাকেন যেমন তোমরা তোমাদের সন্তান প্রতিপালন করো, তারপর সেটা একটা পাহাড়ের সমান হয়ে যায়। Ñবুখারি
জাকাত ধনীদের পরিশুদ্ধ করে : পবিত্র কুরআনে সূরা তওবার ১০৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আপনি তাদের ধন-সম্পদ থেকে জাকাত গ্রহণ করে তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে দিন।’ সম্পদশালীরা জাকাত দেয়ার মাধ্যমে মালের পরিশুদ্ধি লাভের পাশাপাশি তাদের মনেরও পরিশুদ্ধি অর্জন করে। গরিব-দুঃখী ও অভাবী মানুষের মধ্যে জাকাত বণ্টনের মাধ্যমে তারা স্বার্থপরতা থেকে যেমন পরিশুদ্ধ হয়, তেমনি তাদের মধ্যে জন্মলাভ করে সহযোগিতা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মনোভাব।
জাকাত দারিদ্র্য দূর করে : জাকাতের আটটি খাত রয়েছে। এর মধ্যে ফকির, মিসকিন, দাস-দাসী এবং ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি এই চারটি শ্রেণী হচ্ছে অবহেলিত, পীড়িত ও অভাবগ্রস্ত। জাকাত এদের মধ্যে বণ্টিত হলে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হতে বাধ্য, যা সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর করে সমাজকে করে আর্থিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ।
জাকাত উৎপাদন বৃদ্ধি করে : অর্থনীতিতে জাকাতের প্রভাব খুবই উল্লেখযোগ্য। জাকাত গরিব, দুঃখী ও অভাবী মানুষের মধ্যে বণ্টিত হলে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে এসব লোকের চাহিদা বাড়ে । চাহিদা পূরণের জন্য স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পাবে উৎপাদন ও জোগান। এতে চাহিদা, উৎপাদন ও মুনাফাও বেড়ে যায়। অর্থনীতিতে সঞ্চারিত হয় গতি।
জাকাত অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে : জাকাত ঠিকমতো আদায় ও বিলি-বণ্টন হলে গরিব ও অভাবীরা সচ্ছল ও উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ পায়। ফলে ধনী-গরিবের বৈষম্য দূরীভূত হয়। জাকাত ধনীদের সম্পদকে গরিবদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। এর ফলে সম্পদ কেবল ধনীদের হাতেই আটকে থাকে না। তাই আল্লাহ তায়ালা সূরা হাশরের ৭ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘সম্পদ যেন কেবল তোমাদের ধনীদের মধ্যে আবর্তিত না হয়।’
জাকাত সমাজে শান্তি আনয়ন করে : জাকাতের ওপর অর্থনীতির যে ভিত তৈরি হয় তাতে ধনী-গরিবের বৈষম্য কমে যায়। সমাজের বিরাট হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতে সম্পদ বণ্টিত হওয়ার ফলে সমাজে থাকে না কোনো বিরোধ। এতে সমাজে আসে শান্তি ও নিরাপত্তা।
দারিদ্র্য বিমোচন ও জাকাত : জাকাতের বহুমুখী অবদান অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বিশেষ করে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ ও তার অভাব-অনটন দূর করার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে জাকাতের ভূমিকা অনন্য। ইসলাম সমাজের অনাহারী, অভুক্ত ও অবহেলিত মানুষের চাহিদা পূরণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। এমনকি এসব শ্রেণীর চাহিদার অবহেলার পরিণতি সম্পর্কে ইসলামে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। আল্লাহর নবী হজরত মুহাম্মদ সা: বলেছেন, ‘স্বর্ণ ও রৌপ্যের যে কোনো মালিক নিজের মালের হক (জাকাত) আদায় করে না (তার জেনে রাখা উচিত) কিয়ামতের দিন সেই স্বর্ণ ও রৌপ্যকে আগুনে জ¦ালিয়ে তা দিয়ে তখতি বানানো হবে, তারপর তাকে জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং ওই ব্যক্তির পাশর্^দেশ, কপাল ও পিঠ তা দিয়ে দাগানো হবে।’ Ñবুখারি
ইসলামের এই যে বিধান এবং মানুষের কাছে অর্থনৈতিক সহায়তা পৌঁছে দিয়ে তাকে স্বাবলম্বী ও কর্মক্ষম করে তোলা, তার অনন্য কর্মকৌশল হলো জাকাতব্যবস্থা। মুসলিম বিশ্বের অন্যতম অর্থনীতিবিদ প্রফেসর উমর চাপড়া বলেছেন, ‘জাকাত হচ্ছে এমন পূর্ণ ধর্মীয় আঙ্গিকে একটি সামাজিক আত্ম-সহযোগিতার ব্যবস্থা যাতে রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির পরও যারা নিজেদের সাহায্য করতে পারে না, সেরূপ গরিব দুস্থদের সাহায্য করা, যাতে মুসলিম সমাজ থেকে দরিদ্রতা ও কৃপণতা দূর হয়। তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু একজন মুসলমানের দায়িত্ব হচ্ছে নিজের উপার্জন নিজে করা, যেহেতু এটাই সমীচীন হবে যে, জাকাত এমনভাবে বিতরণ করতে হবে যাতে দরিদ্ররা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। জাকাত হচ্ছে তাদের জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা যারা নিজেদের প্রচেষ্টায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। অন্যদের জন্য জাকাত হবে একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা যা দ্বারা তাদের পর্যাপ্ত উপার্জনের জন্য প্রশিক্ষণ, যন্ত্রপাতি ও উপকরণ সরবরাহ করা হবে। আত্ম-কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিকাশের উৎসাহ দিতে হবে। যার মাধ্যমে লোকেরা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য জাকাতকে ব্যবহার করবে। এভাবে মুসলিম দেশগুলোতে বিরাজমান বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও বৈষম্য হ্রাসে জাকাত কার্যকর না হওয়ার কোনো কারণ নেই।’
উপসংহার : উপরের আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে, জাকাত ইসলামের এক অনন্য বিধান যা মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান এবং অভাবী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণে অভাবনীয় ভূমিকা পালন করে। জাকাত আধ্যাত্মিক ব্যবস্থা হিসেবে ধনীদের সম্পদের পরিশুদ্ধ এবং তার আখেরাতের মুক্তিকেই শুধু নিশ্চিত করে না, বরং জাকাত সম্পদকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সচল রাখে, উৎপাদন বৃদ্ধি করে, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে এবং সামগ্রিকভাবে দারিদ্র্য বিমোচন করে সমাজে শান্তি ও স্থিতি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। অতএব, ইসলামের বুনিয়াদি নীতির স্বার্থে, দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তির লক্ষ্যে এবং সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে স¤পদশালী মুসলমানের উচিত সুষ্ঠুভাবে জাকাত দেয়া। আমরা যদি বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর ও টেকসই কৌশল হিসেবে জাকাত আদায় ও বিতরণকে নিশ্চিত করতে পারি, তা হলে আমরা এমন এক সমাজ কায়েম করতে পারব, যেখানে প্রতিটি মানুষ খেয়ে পরে সুখ ও শান্তির সাথে বেঁচে থাকতে পারবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে জাকাতের মর্ম ও উপকারিতা বোঝার তৌফিক দান করুন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সাবেক ডিএমডি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা