২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সদাকাহ : করোনা প্রেক্ষাপট

-

আল্লাহ তায়ালার বড়ই মেহেরবানি যে, তিনি আমাদের সদাকাহর মাধ্যমে তাঁর নিকটবর্তী হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। সদাকাহ এমন একটি ইবাদাত যার মাধ্যমে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ এক দিকে যেমন উপকৃত হয় অন্য দিকে সদাকাহকারী নিজেও জান্নাতপ্রাপ্তি ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির দিকে এগিয়ে যান। বর্তমানে গোটা বিশ্ব ‘করোনাভাইরাস’ নামক এক কঠিন মুসিবতের মধ্যে রয়েছে, যার কারণে মানুষ চিকিৎসা, খাদ্যসহ নানান কষ্টে বিপর্যস্ত। এই কষ্ট দূর করার ক্ষেত্রে সদাকাহ বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ বিষয়ে আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব দুঃখকষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তার কিয়ামতের দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন। [সহিহ মুসলিম : ৭২০২৮] এই কঠিন মুসিবতের সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানো প্রত্যেক ঈমানদারের দায়িত্ব।
সদাকাহ বলতে কী বুঝায় : সদাকাহ আরবি শব্দ, এর অর্থ দান। আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য শরিয়া অনুমোদন করে এমন কল্যাণকর কাজে দান করাকে সদাকাহ বলে। এর মধ্যে ফরজ সদাকাহ হলো জাকাত দেয়া। এ ছাড়া আল্লাহর পথে খরচ করা, ফকির, মিসকিন ও অভাবীকে সাহায্য করা, ক্ষুধার্তকে খাদ্য খাওয়ানো, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ করা, করজ দেয়া, সৎ কাজের আদেশ দেয়া ইত্যাদি সদাকাহর অন্তর্ভুক্ত। আল কুরআনে সদাকাহ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এভাবে, ‘তোমরা আল্লাহ তায়ালা ও রাসূল সা:-এর প্রতি ঈমান আনো এবং আল্লাহ তোমাদের যা কিছুর উত্তরাধিকারী বানিয়েছেন তা থেকে কিছু (তাঁর রাস্তায়) ব্যয় করো। অতএব তোমাদের মধ্য থেকে যারা (আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর ওপর) ঈমান এনেছে এবং (তাঁর রাস্তায় নিজেদের ধন-সম্পদ) ব্যয় করেছ তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার।’ [সূরা আল-হাদিদ : ৭] রাসূল সা:-ও সদাকাহ করার বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, ‘তোমরা জাহান্নাম থেকে বাঁচো। এমনকি একটি খেজুরের একাংশ সদাকাহ করে হলেও।’ [সহিহ আল-বুখারি : ১৪১৭]
সদাকাহর গুরুত্ব ও ফজিলত : সদাকাহর অনেক গুরুত্ব ও ফজিলত রয়েছে : এক. সদাকাহ করলে তা অনেক গুণে বৃদ্ধি পায় : এ বিষয়ে কুরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-সম্পদগুলো ব্যয় করে তাদের উপমা যেমন একটি শস্য বীজ। যা থেকে উৎপন্ন হয়েছে সাতটি শীষ। প্রত্যেক শীষে রয়েছে শত শস্য। আর আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছে করবেন তাকে আরো বাড়িয়ে দেবেন। বস্তুত আল্লাহ তায়ালা হচ্ছেন মহান দাতা ও মহাজ্ঞানী।’ [সূরা আল-বাকারা : ২৬১] আরো বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ সুদের বরকত উঠিয়ে নেন এবং সদাকাহ বর্ধিত করেন। বস্তুত আল্লাহ অতি কৃতঘœ তথা কাফির পাপাচারীদের ভালোবাসেন না।’ [সূরা আল-বাকারা : ২৭৬] দুই. সদাকাহ করলে সম্পদ কমে না, এ বিষয়ে আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা: বলেন, ‘সদাকাহ-খয়রাত ধন-সম্পদ কমিয়ে দেয় না।’ [সহিহ মুসলিম : ৬৭৫৭] তিন. সদাকাকারীর জন্য ফিরিশতা দোয়া করেন। আবু হুরায়রা রা: বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে দু’জন ফিরিশতা অবতীর্ণ হন। তাদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! আপনি দানকারীর সম্পদ আরো বাড়িয়ে দিন। অন্যজন বলেন, হে আল্লাহ! আপনি কৃপণের সম্পদ ধ্বংস করে দিন।’ [সহিহ আল-বুখারি : ১৪৪২] চার. জান্নাত পাওয়ার একটি বিরাট মাধ্যম হলো সদাকাহ। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা নিজ প্রভুর ক্ষমা ও জান্নাতের প্রতি দ্রুত ধাবিত হও। যার প্রসারতা নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সদৃশ। যা তৈরি করা হয়েছে আল্লাহভীরুদের জন্য। যারা সচ্ছল ও অসচ্ছলাবস্থায় আল্লাহর পথে দান করে, ক্রোধ সংবরণ করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন।’ [সূরা আলে-ইমরান : ১৩৩-১৩৪] পাঁচ. সদাকাহ এমন একটি ইবাদাত যা মৃত্যুর পরও জারি থাকে। এ বিষয়ে আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা: বলেছেন, মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে ৩টি আমল বন্ধ হয় নাÑ১. সদাকাহয়ে জারিয়া ২. এমন ইলম-যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় ৩. এমন নেক সন্তান- যে তার জন্য দোয়া করে। [সহিহ মুসলিম: ৪৩১০]
সদাকাহ না করার পরিণাম : সামর্থ্য থাকার পরও সদাকাহ না করার পরিণামগুলো হলো : এক. কার্পণ্য জাহান্নামের দিকে ধাবিত করে : এ বিষয়ে কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আর আল্লাহ যাদের তাঁর অনুগ্রহ থেকে যা দান করেছেন তা নিয়ে যারা কৃপণতা করে তারা যেন ধারণা না করে যে, তা তাদের জন্য কল্যাণকর, বরং তা তাদের জন্য অকল্যাণকর। যা নিয়ে তারা কৃপণতা করেছিল, কিয়ামত দিবসে তা দিয়ে তাদের বেড়ি পরানো হবে। আর আসমানসমূহ ও জমিনের উত্তরাধিকার আল্লাহরই জন্য। আর তোমরা যা আমল করো সে ব্যাপারে আল্লাহ সম্যক অবহিত।’ [ সূরা আলে ইমরান : ১৮০] দুই. কৃপণতা গুনাহর দিকে নিয়ে যায়। আবদুল্লাহ্ ইবন আমর রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা: একদিন খুতবা দিতে গিয়ে বলেন, ‘তোমরা কার্পণ্যের মানসিকতা পরিহার করো। এই মানসিকতা তোমাদের পূর্ববর্তীদের ধ্বংসের কারণ। এটি কৃপণতার আদেশ করে, তখন মানুষ কৃপণ হয়ে যায়। আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করতে বলে, তখন মানুষ তা ছিন্ন করে। গুনাহ্ করতে আদেশ করে, তখন মানুষ গুনাহ্ করে বসে।’ [সুনান আবু দাউদ : ১৭০০] তিন. সদাকাহ না করলে কিয়ামতে গরিব হয়ে উঠবে। আবু যর রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেন, ‘নিশ্চয় দুনিয়ার বড় ধনীরা কিয়ামতের দিন বড় গরিব হবে। তবে সে ব্যক্তি গরিব হবে না যাকে আল্লাহ অঢেল সম্পদ দিয়েছেন এবং সে তা আল্লাহর পথে ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে তথা সর্বদিকেই সদাকাহ করেছে। উপরন্তু সর্বদা সে তাঁর সম্পদগুলো কল্যাণকর কাজেই খরচ করেছে।’ [সহিহ বুখারি : ৬৪৪৩]
বর্তমান অবস্থায় সদাকাহ : গোটা বিশ্ব আজ অবরুদ্ধ, মানুষ নানাবিধ কষ্টে জীবনযাপন করছে, এ সময় জাকাত আদায়সহ বিভিন্ন প্রকারের সদাকাহ খুবই জরুরি। রমাদান মাস সদাকাহ করার বিশেষ মাস। আর বিপদাপদ থেকে রক্ষার অন্যতম মাধ্যম হলো সদাকাহ। এ বিষয়ে আবু উমামাহ্ রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেন, ‘ভালো কাজ তথা সদাকাহ সদাকাহকারীকে সমূহ বিপদাপদ থেকে রক্ষা করে।’ [সহিহ সামেউস সগীর : ৭২৪৫] রাসূল সা: রমজান মাসে অধিক হারে সদাকাহ করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, ‘রাসূল সা: ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল, আর রমজানে তাঁর এ দানশীলতা আরো বেড়ে যেত।’ [সহিহ বুখারি : ১৯০২]
আমাদের করণীয় : বর্তমানে ৩টি বিষয়ে সহায়তা দেয়া খুবই প্রয়োজন : ১. মেডিক্যাল সহায়তা ২. খাদ্য সহায়তা ও ৩. অন্যান্য সহায়তা দেয়া। এ সব বিষয়ে আমাদের করণীয় হলো :
১. উদ্যোগ গ্রহণ করা : প্রত্যেককেই সদাকাহর বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে বা সামষ্টিকভাবে, প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক এবং মসজিদভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। কেননা উদ্যোক্তাদের সওয়াবের বিষয়ে হাদিসে বলা হয়েছে, জারির ইবন আবদুল্লাহ্ রা: থেকে বর্ণিত, ‘রাসূল সা: বলেন, প্রত্যেকেই যেন দিনার, দিরহাম, কাপড়, গম, খেজুর এমনকি একটি খেজুরের একাংশ হলেও সদাকাহ করে। এ কথা শুনে জনৈক আনসারী বড় এক থলে খেজুর নিয়ে এলো। যা সে অনেক কষ্ট করেই বহন করছিল। এরপর আরো অনেকেই অনেক কিছু নিয়ে এলো। এমনকি দেখতে দেখতে খাদ্য ও কাপড়ের দু’টি স্তুপ জমে গেল। তা দেখে রাসূল সা:-এর চেহারা স্বর্ণের মতো জ্বলজ্বল করছিল। অতঃপর রাসূল সা: বললেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সমাজে ইসলামের কোনো একটি ভালো কাজ চালু করল যা এর আগে ওই সমাজে চালু ছিল না, তাহলে তার আমলনামায় সে ভালো কাজটির সাওয়াব লেখা হবে এবং আরো লেখা হবে ওই সব আমলের সাওয়াবও যা তার পরবর্তীতে তারই অনুকরণে করা হয়েছে। তবে ওদের সাওয়াব এতটুকুও কম করা হবে না। ঠিক এরই বিপরীতে যে ব্যক্তি কোনো সমাজে ইসলামের কোনো একটি খারাপ কাজ চালু করল যা এর আগে ওই সমাজে চালু ছিল না, তা হলে তার আমলনামায় সে খারাপ কাজটির গুনাহ্ লেখা হবে এবং আরো লেখা হবে ওই সব আমলের গুনাহ্ও যা তার পরবর্তীতে তারই অনুকরণে করা হয়েছে। তবে ওদের গুনাহ্ এতটুকুও কম করা হবে না।’ [সহিহ মুসলিম : ২৩৯৮]
২. সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া : নিজ নিজ অবস্থান থেকে উদ্যোক্তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়া প্রত্যেক ঈমানদারের নৈতিক দায়িত্ব। এ বিষয়ে কুরআনে এসেছে, ‘তোমরা ভালো ও তাকওয়ামূলক কাজে পরস্পরকে সাহায্য করো।’ [সূরা মায়িদাহ : ০২] নবী সা:-ও ঘোষণা করেছেন, ‘আল্লাহ বান্দাহর সাহায্যে থাকেন, বান্দাহ যতক্ষণ তার ভাইয়ের সাহায্যে থাকে।’ [সহিহ মুসলিম : ৭২০২৮]
৩. সদাকাহ পৌঁছানো : প্রকৃত অভাবী ব্যক্তির কাছে সদাকাহ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, মহল্লাবাসী এবং নিজ প্রতিষ্ঠানের সহকর্মী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রাধান্য পাবেন। এ ক্ষেত্রে কাউকে কষ্ট দেয়া বা হকদার ব্যক্তিকে বাদ দেয়া যাবে না। এ বিষয়ে কুরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা খোঁটা ও কষ্ট দেয়ার মাধ্যমে তোমাদের সদাকাহ বাতিল করো না। সে ব্যক্তির মতো, যে তার সম্পদ ব্যয় করে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে এবং বিশ্বাস করে না আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি। অতএব তার উপমা এমন একটি মসৃণ পাথর, যার উপর রয়েছে মাটি। অতঃপর তাতে প্রবল বৃষ্টি পড়ল, ফলে তাকে একেবারে পরিষ্কার করে ফেলল। তারা যা অর্জন করেছে তার মাধ্যমে তারা কোনো কিছু করার ক্ষমতা রাখে না। আর আল্লাহ কাফির জাতিকে হিদায়াত দেন না।’ [ সূরা আল-বাকারাহ : ২৬৪]
করোনার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আসুন, আমাদের যার যে অবস্থা আছে সেখান থেকে যতটুকুন পারি সদাকাহ করি, সদাকাহর কাজে সম্পৃক্ত হই, এ বিষয়ে আরো আন্তরিক হই। আশা করা যায় আল্লাহ চাইলে সদাকাহর মাধ্যমে এই বালা থেকে মুক্তি পেতে পারব। মহান আল্লাহ আমাদেরকে মাফ করে দিন, আমিন।
লেখক : চেয়ারম্যান, তানযীমুল উম্মাহ ফাউন্ডেশন


আরো সংবাদ



premium cement