২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আল্লাহর নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে সবাই

-

মানুষের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণাদি একমাত্র মহান আল্লাহর প্রদত্ত নিয়ামত। আল্লাহর নিয়ামত ও অনুগ্রহ ছাড়া মানুষের বা কোনো প্রাণীর এক মুহূর্তও বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মানুষ আল্লাহর অগণিত নিয়ামত ভোগ করা সত্ত্বে¡ও এ নিয়ামতের উপযুক্ত শুকর আদায় করে না। আর আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের অর্থ হচ্ছে তাঁর আদেশাবলি যথাযথভাবে মেনে চলা। অথচ বেশির ভাগ মানুষই আল্লাহর শুকরগুজার না করে প্রতিনিয়ত আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত।
আল্লাহ মানুষকে যে নিয়ামত দান করেছেন তা সীমাহীন। এমন অনেক নিয়ামতও আছে যেগুলোর খবর মানুষ জানেই না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেনÑ ‘যদি তোমরা আল্লাহর নিয়ামতগুলো গণনা করতে থাকো তাহলে সেগুলো পুরোপুরি গণনা করতেও পারবে না।’ (সূরা ইবরাহিম-৩৪)
অর্থাৎ আল্লাহর নিয়ামত এত অধিক যে, সবাই মিলে গণনা করতে চাইলে গুণে শেষ করা যাবে না। মানুষের নিজের অস্তিত্বই স্বয়ং একটি ক্ষুদ্র জগত। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, হস্ত, পদ, দেহের প্রতিটি গ্রন্থি এবং শিরা-উপশিরায় আল্লাহর অন্তহীন নিয়ামত নিহিত রয়েছে। [ফাতহুল কাদির] এ থেকে অনুমান করা যায় যে, আল্লাহর সম্পূর্ণ দান ও নিয়ামতের সংক্ষিপ্ত বা বিস্তারিত কোনোভাবেই আমরা গণনা করে শেষ করতে পারব না। এই অসংখ্য নিয়ামতের বিনিময়ে অসংখ্য ইবাদত ও অসংখ্য শোকর জরুরি হওয়াই ছিল ইনসাফের দাবি। মানুষ সে শোকর আদায়ের ব্যাপারে অতিশয় জালেম, কারণ সে এ ব্যাপারে গাফেল (অজ্ঞ) থাকে। (ফাতহুল কাদির)
আর এসব নিয়ামতের বিষয়ে আল্লাহর কাছে সবাইকে জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই সেদিন (শেষ বিচারে) তোমাদেরকে নিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।’ (সূরা আত-তাকাসুর-৮)
অর্থাৎ তোমরা সবাই কিয়ামতের দিন আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে যে, সেগুলোর শোকর আদায় করেছ কি না, সেগুলোতে আল্লাহর হক আদায় করেছ কি না; নাকি পাপকাজে ব্যয় করেছ? এতে সব প্রকার নিয়ামত এসে যায়। কুরআন ও হাদিসের অন্যত্র এরকম কিছু নিয়ামতের উদাহরণ দেয়া হয়েছে। অন্য আয়াতে এভাবে বলা হয়েছে, ‘কান, চোখ, হৃদয়Ñ এদের প্রত্যেকটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ (সূরা আল-ইসরা-৩৬) এতে মানুষের শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও হৃদয় সম্পর্কিত লাখো নেয়ামত অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, এগুলো মানুষ প্রতি মুহূর্তে ব্যবহার করে।
বিভিন্ন হাদিসেও নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হওয়ার কথা স্পষ্টভাবে এসেছে। যেমনÑ রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘দুটি নেয়ামত এমন আছে যাতে বেশির ভাগ মানুষই ঠক খায়। তার একটি হলো স্বাস্থ্য, অপরটি হচ্ছে অবসর সময়।’ (সহিহ বুখারি-৬৪১২)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, একবার রাসূলুল্লাহ সা: ক্ষুধায় কাতর হয়ে বের হলেন, পথে আবু বকর রা: ও উমরও রা: বের হলেন, রাসূল সা: তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কেন বের হয়েছ? তারা বলল, ক্ষুধা। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘যার হাতে আমার নফস তার শপথ, আমিও সে কারণেই বের হয়েছি। তারপর তিনি বললেন, চলো। তারা সবাই এক আনসারের (মুহাজিরদের সাহায্যকারী) বাড়িতে আগমন করলেন। আনসার লোকটির স্ত্রী রাসূলুল্লাহ সা: ও তার সাথীদের দেখে বেজায় খুশি, তিনি শুভেচ্ছা ও স্বাগতম জানানোর মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানালেন। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, অমুক কোথায়? স্ত্রী জানাল যে, সে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে গেছে। এ কথা বলতে বলতে আনসার লোকটি এসে তাদের সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ! আজ কেউ আমার মতো মেহমান পাবে না। তারা বসলে তিনি তাদের জন্য এক কাঁদি খেজুর নিয়ে এলেন যাতে কাঁচা-পাকা, আধাপাকা, ভালো-মন্দ সব ধরনের খেজুর ছিল। তারপর আনসার লোকটি ছুরি নিয়ে দৌড়াল। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, সাবধান! দুধ দেয় এমন ছাগল জবাই করো না। আনসার তাদের জন্য জবাই করলে তারা ছাগলের গোশত খেলো, খেজুর গ্রহণ করলো, পানি পান করলো। তারপর যখন (খাবার খেয়ে) তৃপ্ত হলো তখন রাসূলুল্লাহ সা: আবু বকর ও উমরকে বললেন, তোমরা কিয়ামতের দিন এ সমস্ত নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। তোমাদেরকে ক্ষুধা তোমাদের ঘর থেকে বের করলো, তারপর তোমরা এমন নেয়ামত ভোগ করার পর ফিরে গেলে।’ (সহিহ মুসলিম-২০৩৮)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, এ আয়াত নাজিল হলে যুবাইর রা: বললেন, হে আল্লাহরাসূল! আমরা কোন নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবো? এটা তো শুধু (আসওয়াদান বা দুই কালো জিনিস) খেজুর ও পানি। রাসূল সা: বললেন, অবশ্যই তা সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (তিরমিজি-৫/৪৪৮, ইবনে মাজাহ-৪১৫৮, মুসনাদে আহমাদ-৩/২৪) অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, কিয়ামতের দিন প্রথম যে নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে তা হচ্ছে, ‘আমি কি তোমাকে শারীরিকভাবে সুস্থ করিনি? আমি কি তোমাকে সুপেয় পানি পান করাইনি?’ (সুনান আত-তিরমিজি-৩৩৫৮) অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, আল্লাহ কিয়ামতের দিন বলবেন, আদম সন্তান! তোমাকে ঘোড়া ও উটে বহন করিয়েছি, তোমাকে স্ত্রীর ব্যবস্থা করে দিয়েছি, তোমাকে ঘুরাফিরা ও নেতৃত্ব করার সুযোগ দিয়েছি, এগুলোর কৃতজ্ঞতা কোথায়? (সহিহ মুসলিম-২৯৬৮, মুসনাদে আহমাদ-২/৪৯২)
উপরের বর্ণনা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ শুধু কাফেরদের নয় বরং সৎ মুমিনদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সুতরাং সর্বাবস্থায় আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা উচিত। যাতে করে আল্লাহর নিকট হিসাব দেয়া সহজ হয়।
লেখক : প্রফেসর, আল-হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

 


আরো সংবাদ



premium cement