২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

করোনায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা

-

মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সতর্কতামূলক বিধানগুলোর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা গ্রহণের তাগিদও রয়েছে ইসলামে। এ ছাড়া ইসলাম মুমিনদের জন্য আরো কতগুলো জরুরি বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। মানুষ অসুস্থতা ও কঠিন রোগের সময় এসব বিধান মেনে চলতে পারলে জীবন হয়ে উঠবে সুস্থ, সবল এবং স্বস্তিদায়ক।
চিকিৎসাসেবা : মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি তাদের ভালো-মন্দ, আপদ-বিপদ এবং তা থেকে উত্তরণের সব কৌশল অবগত আছেন। রোগ-শোক মানব সৃষ্টির সেই শুরু থেকেই ছিল, আজও আছে এবং এর নিরাময়ও আল্লাহ তায়ালা বাতলে দিয়েছেন। আল্লাহর রাসূল সা: বলেন, ‘আল্লাহ এমন কোনো রোগ দেননি, যার চিকিৎসা তিনি দেননি’ (সহিহ বুখারি, হাদিস-৫৮২)। আল্লাহর নবী মুহাম্মদ সা: সাহাবিদের চিকিৎসা নিতে বলতেন এবং জ¦রের সময় পানি ব্যবহার করার পরামর্শ দিতেন। মহানবী সা: বলেন, ‘পানি ব্যবহার করো এবং জ্বর কমাও’ (সহিহ বুখারি, হাদিস-৬২০)। মহানবী সা: আরো বলেন, ‘আল্লাহ রোগ ও নিরাময় দুটোই দিয়েছেন। তিনি প্রতিটি রোগের জন্য নিরাময়ের ব্যবস্থা রেখেছেন। তাই চিকিৎসাসেবা নাও। তবে অবৈধভাবে নয়’ (আবু দাউদ, হাদিস-৩৮৬৫)। একবার কয়েকজন আরব মহানবী সা:-এর সাথে দেখা করলেন। তারা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও আল্লাহর নবী! আমরা কি চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করব? তিনি জবাবে বললেন, ‘তোমরা চিকিৎসা নাও। কেননা, আল্লাহ তায়ালা এমন কোনো রোগ দেননি, যার কোনো নিরাময় নেই। তবে একটি রোগ ছাড়া। সেটি হলো বার্ধক্য’ (আবু দাউদ, হাদিস-৩৮৪৬)।
জাকাত, সাদকা ও দান : এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রোগ-শোক, বালা-মুসিবত, খরা-দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী কোনোটার ওপরই মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এসব সমস্যার খবর যেমন আল্লাহ জানেন, এগুলো থেকে পরিত্রাণের উপায় ও সুযোগও তাঁরই হাতে। ইসলাম এসব বিপদ-মুসিবতে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা, তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সৃষ্টি করা (নামাজ পড়া) এবং বেশি বেশি দান-সাদকা করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা সালাত কায়েম করো, জাকাত দাও এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু করো’ (সূরা বাকারা, আয়াত-৪৩)। তিনি অরো বলেন, ‘আমার রহমত সব কিছু পরিব্যাপ্ত করে আছে, সুতরাং আমি তা তাদের জন্য নির্ধারিত করব যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, জাকাত দেয় এবং আমার নিদর্শনের প্রতি ঈমান রাখে’ (সূরা আরাফ, আয়াত : ১৫৬)। মহানবী সা: বলেন, ‘বিলম্ব না করে জাকাত দাও। কেননা, এটি দুর্যোগের পথে বাধা দেয়’ (তিরমিজি)। তিনি আরো বলেন, ‘তুমি দোজখের আগুন থেকে বাঁচো, এমন কি একটি খেজুর দান করে হলেও’ (বুখারি ও মুসলিম)।
আল্লাহর ওপর ভরসা (তাওয়াক্কুল) : রোগ-শোক, আপদ-বিপদে আমরা যতই সতর্কতা অবলম্বন করি না কেন, চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করি না কেন, এসব থেকে পরিত্রাণের জন্য আল্লাহর প্রতি আমাদের দৃঢ় আস্থা রাখতে হবে। এ আশা পোষণ করতে হবে যে, আল্লাহ চাইলে রোগ ও মহামারী থেকে আমাদের আরোগ্য দান করবেন। আল্লাহ বলেন, ‘আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট’ (সূরা তালাক, আয়াত-৩)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘আমার কোনো ক্ষতি চাইলে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ডাকো, তারা কি সেই ক্ষতি দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমাকে রহমত করতে চাইলে তারা সেই রহমত প্রতিরোধ করতে পারবে? বলো, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট’ (সূরা জুমার, আয়াত-৩৮)। এ প্রসঙ্গে হজরত ইবরাহিম আ:-এর আল্লাহর ওপর ভরসা রাখার একটি চমৎকার উদাহরণ রয়েছে, যা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে এভাবেÑ ‘আর যখন আমি অসুস্থ হই, তখন যিনি আমাকে আরোগ্য করেন’ (সূরা শুয়ারা, আয়াত-৮০)।
নামাজ এবং দোয়া : নামাজ এবং দোয়া আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার অন্যতম উপায়। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের জন্য (ডাকে) সাড়া দেবো’ (সূরা মুমিন, আয়াত-৬০)। আল্লাহ আরো বলেন, ‘আর তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য চাও’ (সূরা বাকারা, আয়াত-৪৫)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘কুরআনে আমি এমন বিষয় নাজিল করেছি, যা মুমিনদের জন্য রোগমুক্তি ও রহমত।’
কুরআনে আল্লাহ আমাদের জন্য দোয়ার কথা শিখিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি দুঃখ-কষ্টে পড়েছি, তুমি তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু’ (সূরা আম্বিয়া, আয়াত-৮৩)। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসূল সা:-এর একটি প্রসিদ্ধ হাদিস রয়েছে, যেখানে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রাসূল সা: কোনো রোগীকে দেখতে গেলে, বা কাউকে তাঁর কাছে আনা হলে, তিনি এই বলে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি তার রোগ তুলে নাও, তুমি তাকে আরোগ্য দান করো। কেননা, তুমিই নিরাময় করতে পারো। তুমি ছাড়া আরোগ্য করার আর কেউ নেই’ (বুখারি, হাদিস-৫৭৯)।
ধৈর্যধারণ করা, চিন্তামুক্ত থাকা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ : বিপদ-মুসিবত, রোগ-বালাইসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ ও চিন্তামুক্ত থাকার কোনো বিকল্প নেই। এতে মানসিক পেরেশানি ও অস্থিরতা হ্রাস পায়, যা বিপদ থেকে সেরে ওঠার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সাথে আছেন, যারা ধৈর্যধারণ করে’ (সূরা বাকারা, আয়াত-১৫৩)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘যে বিপদই আসুক ধৈর্যধারণ করো’ (সূরা মুজাম্মিল, আয়াত-১০)। আল্লাহর রাসূল সা: বলেন, ‘ধৈর্যের চেয়ে অধিক উত্তম ও ব্যাপক কল্যাণকর বস্তু আর কিছু কাউকে দান করা হয়নি’ (বুখারি ও মুসলিম)। রাসূল সা: অন্যত্র বলেন, ‘কোনো মুসলিম ব্যক্তি মানসিক বা শারীরিক কষ্ট পেলে, কোনো শোক বা দুঃখ পেলে অথবা চিন্তাগ্রস্ত হলে সে যদি ধৈর্যধারণ করে, তাহলে আল্লাহ প্রতিদানে তার সব গুনাহ মাফ করে দেবেন’ (বুখারি ও মুসলিম)। মহানবী সা: অন্য এক হাদিসে বলেছেন, ‘মুমিন নর-নারীর ওপর সময় সময় বিপদ ও পরীক্ষা এসে থাকে। কখনো সরাসরি তার ওপর বিপদ আসে। কখনো তার সন্তান মারা যায়। আবার কখনো তার ধন-সম্পদ বিনষ্ট হয়। আর সে এসব মুসিবতে ধৈর্যধারণ করার পর নিষ্পাপ আমলনামা নিয়ে আল্লাহর সাথে মিলিত হয়’ (তিরমিজি)। আপদ-বিপদ, দুঃখ-কষ্ট সব অবস্থায় আল্লাহর শোকর বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে আল্লাহ নিয়ামত আরো বাড়িয়ে দেন। আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা আমার নিয়ামতের শোকর আদায় করো, তবে আমি তোমাদের জন্য তা আরো বাড়িয়ে দেবো’(সূরা ইবরাহিম, আয়াত-৭)।
পরিশেষে আমাদের মনে রাখতে হবে, করোনাভাইরাস মহামারী আমাদের জীবনের গতিপ্রকৃতি এমনভাবে বদলে দিয়েছে যে, আমরা সবাই এক মহা আতঙ্কের মধ্যে দিনাতিপাত করছি। প্রতিদিন আমাদের সামনে একটার পর একটা জীবনের অবলম্বন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অভাব-অনটনের আশঙ্কা আমাদের ওপর কালো ছায়া বিস্তার করছে। গভীর অন্ধকার যেন আমাদের চারপাশ থেকে ঘিরে আসছে। এই মহামারী মোকাবেলায় নেই ওষুধ, নেই টিকা, নেই পর্যাপ্ত স্যানিটাইজার ও চিকিৎসাসামগ্রী। এ অবস্থার মধ্যে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন ও চিকিৎসার পাশাপাশি আমাদের মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সব চেষ্টা চালাতে হবে। নামাজ, দান-সাদকার প্রতি মনোযোগী হতে হবে। আর ধৈর্যধারণ করে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। কেননা, মহান আল্লাহর সাহায্য ছাড়া এই ভয়ঙ্কর মহামারী থেকে পরিত্রাণের আর কোনো সহজ উপায় নেই। উপরন্তু প্রতিরোধ ও প্রতিকারের দুনিয়াবি উপায় উদ্ভাবনের জন্যও চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। কেননা, আল্লাহ এমন কোনো রোগ-বালাই দেননি, যা থেকে আরোগ্য লাভ বা নিরাময় পাওয়ার উপায় রাখেননি। আল্লাহর রহমত হলে আমরা অবশ্যই একটা উপায় খুঁজে পাবো, ইনশা আল্লাহ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক ও সাবেক ডিএমডি, ইসলামী ব্যাংক
রশসড়যড়হ@মসধরষ.পড়স

 


আরো সংবাদ



premium cement