২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

যা করো না তা বলো না

-


আল কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় অনেক নাফরমানির কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং এগুলোর ভয়াবহ পরিণামের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, আল্লাহর সাথে শরিক করা, মা-বাবার সাথে দুর্ব্যবহার করা, আল্লাহর পথে আহ্বানে বাধা দেয়া, সুদে লেনদেন করা, জুলুম করা, মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা, মানুষের হক নষ্ট করা, এতিমের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করা, আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট করা, কৃপণতা করা ও ওজনে কমবেশ করা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এগুলো থেকেও আরো মারাত্মক ও ভয়াবহতার সাথে আল্লাহর ক্রোধকে উসকে দেয় অর্থাৎ আল্লাহর বিশাল রাগের কারণ হয় যেই কর্মটি, তা হলো ‘নিজে যা করে না, তা বলে বেড়ানো।’ আল কুরআনের সূরা সফের ২ ও ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বলো, যা নিজেরা করো না? আল্লাহর কাছে এটা অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ যে, তোমরা এমন কথা বলো যা করো না।’
সূরা সফের এ আয়াতটির অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট যা-ই থাক না, এটি একটি সাধারণ বিষয় যা সব মানুষের বেলায় সমভাবে প্রযোজ্য। আর এ জন্যই পৃথিবীর সব মানুষের কাছে এটি একটি ঘৃণার বিষয়। যারা বেশি বলে, বেশি লিখে, বেশি বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে বেড়ায়, অথচ তাদের চরিত্রে পাওয়ারি গ্লাস ব্যবহার করেও এগুলোর কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং অনেক ক্ষেত্রে উল্টো চিত্র বেশি করে পরিলক্ষিত হয়। তখন সে আল্লাহর বিশাল ক্রোধে নিপতিত হওয়ার সাথে সাথে পৃথিবীর সব ব্যক্তি মানুষেরও ঘৃণার পাত্রে পরিণত হতে হয়। জীবন চলার পথে এ ধরনের চরিত্রওয়ালা লোক খুব একটা কম নয়। এদের মধ্যে যেমন সাধারণ মানুষ আছে তেমনি আছে অনেক বিখ্যাত লেখক, কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, সরকারি ও বেসরকারি আমলা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বড় বড় পদবিধারী ব্যক্তি, সরকারের মন্ত্রী এমন কি অনেক আলেম ওলামাও। অনেকগুলো বইয়ের লেখক, লেবাসে চেহারায় দুরস্তভাব, বাইরের থেকে একজন বড় ধরনের লেখক ও বড় মনের মানুষও মনে হয়। কিন্তু একান্ত কাছাকাছি এলে তার ভেতরকার এক কুৎসিত চেহেরা বেরিয়ে আসে। তার বইগুলোর কোনো কোনো জায়গায় এসে আপনার চোখ আটকে যাবে, দেখা যাবে যে, সেই লাইনটির ঠিক বিপরীত চিত্র তার চরিত্রে বিরাজ করছে। এভাবে সমাজের অনেক সুবক্তা, যুক্তিবাদী, কত শত জ্ঞানগর্ব আলোচনা ও উপদেশবাক্য শোনা যাবে, কিন্তু তার ব্যক্তি চরিত্রে এ আলোচনা ও উপদেশের মিল খুঁজে পাওয়া আপনার জন্য দুরূহ হবে। সুসাহিত্যিক সাহিত্যের কারিশমায় একটি সাধারণবিষয়কে মর্মস্পর্শী ভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরেন, মানুষ এক গ্রাসে গিলে ফেলতে একটুও দ্বিধায় পড়ে না, কিন্ত যখন তার কাছাকাছি এসে বিপরীত দৃশ্য দেখে, তখন তার প্রচণ্ড বদহজম শুরু হয় এবং কষ্ট পায় তার প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে।
উল্লিখিত মানুষগুলো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর ক্রোধকে খুব কমই পরোয়া করে। তারা মনে করে, তাদের লেবাস দেখেই আল্লাহ মাফ করে দেবেন অথবা কথা ও কাজে অমিল থাকলেও অন্যান্য মহৎ কাজের জন্য তারা ছাড়া পেয়ে যাবে। সত্যিকার অর্থে এরা মানুষকে ধোঁকা দিয়ে সস্তা বাহবা খুঁজে ফেরে।
আয়াতে উল্লিখিত ‘মাকতান’ আরবি অভিধান ‘লিসানুল আরব’ বলা হয়েছে ঘৃণা, অবজ্ঞা, শুত্রুতা ও বিদ্বেষ ইত্যাদি। তাফসিরে ইবনে কাসির ও জালালাইন শরিফে বলা হয়েছে ‘আসাদ্দুল বোগদে’ ও ‘বোগদান শাদিদান’ অর্থাৎ কঠিন ক্রোধ। আল কুরআনের আরো দু’টি আয়াতে তথা সূরা ফাতির-৩৯ ও সূরা মুমিন-৩৫ এ শব্দটির হুবহু উল্লেখ পাওয়া যায় এবং সেখানে কঠিন ক্রোধের কথাই বলা হয়েছে। ইংরেজি ভাষায় তরজমায় ঐধঃবভঁষ (ঘৃণ্য), ঙফরড়ঁং (অপছন্দনীয়) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যার ঝুহড়হুসং বা সমার্থক হিসেবে টহনবধৎধনষব (অসহনীয়), ওহঃড়ষবৎধনষব (অসহ্য), চধরহভঁষ (বেদনাদায়ক), ওহংঁভভবৎধনষব (অসহ্য) শব্দগুলো পাওয়া যায়। আবার আয়াতের ‘মাকতান’ এর সাথে যোগ করা হয়েছে ‘কাবুরা শব্দ, যার অর্থ বিশাল। অর্থাৎ বিশাল ঘৃণার কাজ, বিশাল অপছন্দের কাজ, বিশাল অসহ্যের কাজ। একটু গভীরভাবে লক্ষ করুন, আল্লাহর এক নাম সাবুর বা মহাসহিষ্ণু, অথচ এটি এমন কি কর্ম যে, মহাসহিষ্ণু মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার জন্য অসহনীয় বা অসহ্যের কারণ হয়ে দাঁড়ায়? একটু গভীর মনযোগের সাথে চিন্তা করলে আপনার বুঝতে কষ্ট হবে না যে, এটি কত বড় ঘৃণার কাজ।
একজন খাঁটি মুসলমানের চরিত্র এমনটি হওয়ার কথা নয়। একজন মুসলমানের কথা ও কাজে মিল থাকা উচিত। সে যা বলবে তা করে দেখাবে। আর করার সৎ সাহস না থাকলে তা মুখেও আনবে না। আগেই বলা হয়েছে যে, এ রকম কথা বলা ও অন্য রকম কাজ করা আল্লাহর দৃষ্টিতে যেমন অত্যন্ত ঘৃণিত তেমনি মানুষের কাছেও জঘন্য ঘৃণিত কাজ হিসেবে চিহ্নিত হয়। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ করার দাবি করে তার পক্ষে এমন নৈতিক দোষ ও বদ স্বভাবে লিপ্ত হওয়া আদৌ সম্ভব নয়। নবী সা: বলেছেন: ‘কোনো ব্যক্তির মধ্যে এরূপ স্বভাব থাকা প্রমাণ করে যে, সে মুমিন নয় বরং মুনাফিক। কারণ তার এই স্বভাব বা আচরণ মুনাফিকির একটি স্পষ্ট আলামত।’
‘যা করে না তা বলে বেড়ানো’ বিশাল ক্রোধের কারণ হওয়ার পেছনে আরো যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। এ ধরনের স্বভাব বা প্রকৃতির লোক একই সাথে আরো কতগুলো বড় বড় গোনাহের কাজে লিপ্ত হয়।
(ক) প্রথমত তাকে একজন বড় মাপের মোনাফিক হতে হয়। তাকে মিথ্যার মতো একটি কবিরাহ গুনাহের আশ্রয় নিতে হয়। মোনাফিকের তিনটি বা চারটি লক্ষণের মধ্যে একটি হলোÑ মিথ্যা বলা। নবী সা: বলেছেন, ‘মুনাফিকের পরিচয় বা চিহ্ন তিনটি (যদিও সে নামাজ পড়ে এবং মুসলমান হওয়ার দাবি করে) তা হলো, সে কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করে করে তা ভঙ্গ করে এবং তার কাছে আমানত রাখলে তা খিয়ানত করে।’ (বুখারি-মুসলিম)
(খ) দ্বিতীয়ত : এদের ঈমান অবশ্যই ত্রুটিপূর্ণ। একজন প্রকৃত ঈমানদার আল্লাহ তায়ালার চরম গোস্সা কুড়াবেন তো দূরের কথা বরং আল্লাহ তায়ালার সামান্যতম অসন্তুষ্টির কারণ হতে পারে, সে ধরনের কাজের ধারে কাছে তিনি যেতে পারেন না। কারণ প্রকৃত ঈমানদার জানেন যে, আল্লাহ সামিউল বাছির।
(গ) এ ধরনের লোক সাধারণত লোক দেখানো কাজ করতে বেশি ভালোবাসে। মানুষের সস্তা বাহবা কুড়ানোর জন্য বা বাণিজ্যিক ফায়দা লুটার জন্য সদায় ব্যস্ত থাকে। তার বক্তব্য বা লেখনীর মাধ্যমে অন্তত দুটি মানুষ সংশোধন হয়ে উঠুক বা একটি সৎ সমাজ গড়ে ওঠার জন্য তার মেধা সামান্যতম অবদান রাখুক, তা তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হয় না। এ আশা তাদের থেকেই করা যায় ‘যারা প্রথমত নিজে আগে আমল করে, পরে মানুষকে তার দাওয়াত দেয়।
(ঘ) আল্লাহর চরম গোস্সা তো তারাই বহন করে বেড়াতে পারে, যারা চরম বেপরোয়া বা চরম উদাসীন। সুতরাং যারা নিজেরা করে না, কিন্তু বলে বেড়ায়, তারা অবশ্যই বেপরোয়া ও চরম উদাসীন প্রকৃতির মানুষ।
উল্লিখিত আলোচনায় আয়াতের সাধারণ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু সূরা সফ ও অন্য দুটি স্থান তথা সূরা ফাতির-৩৯ ও সূরা মুমিন-৩৫ এর বিশেষ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলো ‘যারা ইসলামের জন্য জীবনপাত করার লম্বা লম্বা ওয়াদা করত কিন্তু চরম পরীক্ষার সময় আসলে জান নিয়ে পালাত সেসব বাক্যবাগিশদের তিরস্কার করাই এর উদ্দেশ্য।
লেখক : প্রবন্ধকার


আরো সংবাদ



premium cement