শ্রমজীবী আল্লাহর বন্ধু
- অধ্যাপক শামসুল হুদা লিটন
- ২৬ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০
ইসলামে শ্রমের মর্যাদা অত্যধিক। শ্রম দ্বারা অর্জিত খাদ্যকে ইসলাম সর্বোৎকৃষ্ট খাদ্য হিসেবে আখ্যা দিয়েছে এবং জীবিকা অন্বেষণকে উত্তম ইবাদত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। মহানবী সা: বলেছেন, ‘ফরজ ইবাদতের পর হালাল রুজি অর্জন করা একটি ফরজ ইবাদত’Ñ বায়হাকি। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে এরশাদ করেছেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য ভূমি সুগম করে দিয়েছেন। কাজেই তোমরা এর দিক-দিগন্তে বিচরণ করো এবং তাঁর দেয়া রিজিক থেকে আহার করো’ (সূরা- মুলক : ১৫)।
আমাদের প্রিয় নবী সা: শ্রমকে ভালোবাসতেন। তিনি নিজ হাতে জুতা মেরামত করেছেন, কাপড়ে তালি লাগিয়েছেন, মাঠে মেষ চরায়েছেন। নবীজী ব্যবসা পরিচালনাও করেছেন। খন্দকের যুদ্ধে নিজ হাতে পরিখা খনন করেছেন। বাড়িতে আগত মুসাফির কর্তৃক বিছানায় পায়খানা করে রেখে যাওয়া কাপড় ধৌত করে মানবতা ও শ্রমের মর্যাদা সর্বোচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শ্রমিকের মর্যাদা সম্পর্কে মহানবী সা: বলেন, ‘শ্রমজীবী আল্লাহর বন্ধু’Ñ বায়হাকি। মহানবী এ ব্যাপারে আরো বলেন, ‘নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য আর নেই। আল্লাহর নবী দাউদ আ: নিজের হাতে কাজ করে খেতেন’Ñ বুখারি।
কুরআন-হাদিস, ইসলামের ইতিহাস পড়লে জানা যায়, নবী-রাসূলগণ শ্রমিকদের কত মর্যাদা দিয়েছেন। ইসলামের সব নবী ছাগল চরিয়ে নিজে শ্রমিক হয়ে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছেন। মালিক হজরত শোয়াইব আ: তাঁর মেয়ের বিয়ে দিয়ে শ্রমিক নবী মূসা আ:কে জামাই বানিয়েছেন। হজরত মুহাম্মদ সা: শ্রমিক জায়েদ রা:-এর কাছে আপন ফুফাতো বোন জয়নবের বিয়ে দিয়েছিলেন। বিশ্বনবী সা: জায়েদ রা:-কে মুতার যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ইসলামের প্রথম মোয়াজ্জিন বানানো হয়েছিল শ্রমিক হজরত বেলাল রা:কে। মক্কা বিজয় করে কাবা ঘরে প্রথম প্রবেশের সময় মহানবী সা: শ্রমিক বেলাল রা: ও শ্রমিক খাব্বাব রা:কে সাথে রেখেছিলেন। নবীজী কখনো নিজ খাদেম আনাস রা:কে ধমক দেননি এবং কখনো কোনো প্রকার কটুবাক্য ও কৈফিয়ত তলব করেননি।
নবী সা:-এর কন্যা হজরত ফাতিমা রা: নিজ হাতে যাঁতা ঘোরাতেন। আর এ জন্য তার হাতে যাঁতা ঘোরানোর দাগ পড়েছিল। তিনি নিজেই পানির মশক বয়ে আনতেন, এতে তাঁর বুকে দড়ির দাগ পড়েছিল।
কোদাল চালাতে চালাতে একজন সাহাবির হাতে কালো দাগ পড়ে যায়। রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর হাত দেখে বললেন, ‘তোমার হাতের মধ্যে কি কিছু লিখে রেখেছ? সাহাবি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল সা: এগুলো কালো দাগ ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি আমার পরিবার-পরিজনের ভরণ পোষণের জন্য পাথুরে জমিতে কোদাল চালাতে গিয়ে হাতে এ কালো দাগগুলো পড়েছে। নবীজী সা: এ কথা শুনে ওই সাহাবির হাতের মধ্যে আলতু করে গভীর মমতা ও মর্যাদার সাথে চুমু খেলেন।’ এভাবে অসংখ্য কর্ম ও ঘটনার মাধ্যমে হজরত মুহাম্মদ সা: পৃথিবীতে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।
ইসলামী আদর্শের কাছে মনিব-গোলাম, বড়-ছোট, আমির-গরিব সবাই সমান। ইসলামী সমাজে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সমাজপতি, শিল্পপতি, রাজনীতিবিদের আলাদাভাবে মর্যাদার একক অধিকারী হওয়ার সুযোগ নেই। অধীনস্থরা ও ইনসাফের দাবি করার অধিকার রাখে।
একমাত্র ইসলামই শ্রমিকদের সর্বাধিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার কথা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছে। পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্ম, অন্য কোনো মানবরচিত মতবাদ বা আদর্শ ইসলামের মতো শ্রমিকদের অধিকার দিতে পারে না। ইসলামের দাবি অনুযায়ী গোলামের সাথে ভালো আচরণ করতে হবে এবং তাদের কোনো প্রকার কষ্ট দেয়া যাবে না।
রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমাদের অধীন ব্যক্তিরা তোমাদের ভাই। আল্লাহতায়ালা যে ভাইকে তোমার অধীন করে দিয়েছেন তাকে তা-ই খেতে দাও, যা তুমি নিজে খাও, তাকে তা-ই পরিধান করতে দাও, যা তুমি নিজে পরিধান করো’Ñ বুখারি।
হজরত আবু বকর রা: বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, ‘ক্ষমতার বলে অধীন চাকর-চাকরানী বা দাস-দাসীর প্রতি মন্দ আচরণকারী বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না’Ñ ইবনে মাজাহ। তিনি আরো বলেন, ‘কেউ তার অধীন ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে এক দোররা মারলেও কেয়ামতের দিন তার থেকে এর বদলা নেয়া হবে।’
ইসলাম শ্রমিকদের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। শ্রমিককে কষ্ট দেয়া জাহেলিয়াতের যুগের মানসিকতা মনে করে। এ ব্যাপারে হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, নবী করিম সা: বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যেন আমার দাস, আমার দাসী, না বলে, কেন না আমরা সবাই আল্লাহর দাস-দাসী।’ ওমর ইবনে হুরাইস রা: থেকে বর্ণিত নবী করিম সা: বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের কর্মচারীদের থেকে যতটা হালকা কাজ নিবে তোমাদের আমলনামায় ততটা পুরস্কার ও নেকি লেখা হবে।’
শ্রমিকদের শ্রমের বিনিময়ে তিল তিল করে গড়ে উঠে শিল্পপ্রতিষ্ঠান। একটি শিল্পের মালিক-শ্রমিকদের শ্রম শোষণ করে অল্প সময়েই পাহাড় পরিমাণ অর্থ-বিত্তের মালিক হয়। শ্রমিকদের কম মজুরি দিয়ে, তাদের ঠকিয়ে গড়ে তোলে একাধিক শিল্প-ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। কারখানায় তাদের কোনো অংশীদারিত্ব থাকে না। এ ব্যাপারে মহানবী সা: বলেছেন, ‘মজুরকে তার কাজ থেকে অংশ দান করো, কারণ আল্লাহর মজুরকে বঞ্চিত করা যায় না’Ñ মুসনাদে আহমাদ।
মাসের পর মাস চলে যায় শ্রমিকরা বেতন পায় না। বেতনের দাবিতে শ্রমিককে মালিকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হয়। শ্রমিকের বেতন-ভাতার ব্যাপারে বিশ্বনবী সা: বলেছেন, ‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তাদের প্রাপ্য মজুরি পরিশোধ করো।’ শ্রমজীবী মানুষ বা কোনো শ্রমিক অবসর নেয়ার পর তার বাকি জীবন চলার জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা বা পেনশনের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এ ব্যাপারেও ইসলাম নীরব নয়। হজরত ওমর রা: বলেছেন, ‘যৌবনকালে যে ব্যক্তি শ্রম দিয়ে রাষ্ট্র ও জনগণের খেদমত করেছেন বৃদ্ধকালে সরকার তার হাতে ভিক্ষার ঝুলি তুলে দিতে পারে না।’
১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের ‘হে’ মার্কেটে অধিকার বঞ্চিত শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজসহ বিভিন্ন দাবিতে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করে। বিক্ষোভ সমাবেশে নিরীহ শ্রমিকদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। নিহত হয় অনেক শ্রমিক। শ্রমজীবী মানুষের আপসহীন মনোভাব ও আত্মত্যাগের ফলে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী ৮ ঘণ্টা কাজের স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ১ মে শ্রমিক আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয়। হজরত মুহাম্মদ সা:-এর হাদিস, শ্রমিকদের সাধ্যের অধিক কাজে কখনো খাটাবে নাÑ এ নির্দেশনামূলক কথাটির কিছু অংশ হলেও ১ মে’র আন্দোলনে প্রতিফলিত হয়। আগামী দিনে বাংলাদেশসহ বিশ্ব শ্রমিকেরা নিজেদের প্রয়োজনে ইসলামের দেয়া শ্রমের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসবেন বলে আশা করা যায়।
লেখক : কলেজ শিক্ষক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা