২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

লাশের মিছিল বাড়ছেই

-

আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া লাশের মিছিল বাড়ছেই। এর শেষ কোথায় কেউ জানে না। এ মিছিলের অংশগ্রহণকারীরাও জানত না যে তাদেরও শামিল হতে হবে এখানে। আমরাও আগামী মিছিলে আমার নামটি লেখা আছে কিনা। তবে, এটি বোধহয় বেশ নিশ্চিত, যারা এসবের দায়ভার নৈতিকভাবে বহন করে, কিংবা যাদের ন্যূনতম দায়িত্বহীনতার কারণে এ মিছিলের সংখ্যা একের পর এক বেড়েই চলেছে তাদের কারোই নাম নেই এখানে অথবা পরবর্তী মিছিলে।
৩ জুন ২০১০। পুরান ঢাকার নবাবপুরে নিমতলী মহল্লার সকালটা আগের দিনগুলোর মতোই হাসি-খুশি, আনন্দ-বেদনার মতোই শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সূর্য উদয় হওয়ার আগেই আগুন কেড়ে নিলো তরতাজা ১১৯টি জীবন। আহত হলো আরো কতশত।
২৪ নভেম্বর ২০১২ ঢাকার অদূরে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশন্সে আগুনের ভয়াবহতা বাংলাদেশের শুধু নয়, বিশ্বের অনেক মানুষই মনে রাখবে। ১১৭ জন পোশাক শ্রমিক তাদের জীবনকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হয় পুঁজিবাদী মানবতাবিহীন এ সমাজ ব্যবস্থাপনার কাছে। আরো ২০০ জন সেই ভয়াবহ কীর্তি বহন করে বেড়াচ্ছে এখনো আমাদের মতো কিছু বিবেকহীন মানুষের সামনে।
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। একটি অগ্নিকাণ্ড কেড়ে নিলো তরতাজা আরো ৮১টি জীবন। (সূত্র : বিবিসি, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯) বহু সংখ্যক আহত হলো। নিহত শ্রমিকদের এক লাখ টাকা এবং আহতদের ৫০ হাজার টাকা দেয়া হবে বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঘোষণা দেন। যথারীতি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো। ঘোষণা করা হলো, এটা করা হবে, ওটা করা হবে ইত্যাদি। কিন্তু আসলে যে কী করা হয়েছে কিংবা হবে তা আমাদের মতো আমজনতার না জানলেও চলবে।
গত ২৮ মার্চ দুপুরে সেই আগুন আরো একবার আমাদের মনুষত্যহীন জাতিকে দেখিয়ে দিলো বিবেক ও নৈতিকতার দাম কীভাবে দিতে হয়। বনানীর আধুনিক সুসজ্জিত বিল্ডিংয়ের অফিসগুলোর অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত ২৫সহ আহত চাকরিজীবীরা কিছু আগেও জানত না এমন একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে তারা। সুউচ্চ ভবনের আগুনের লেলিহান শিখা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে যখন ডিশের তার বেয়ে নিচে নামতে গিয়ে আছড়ে পড়তে লাগল, তখন হাজারো মানুষ তাদের মুঠো ফোনে সে চিত্র ধরে রাখতে ব্যস্ত। ইতিহাসের সাক্ষী হতে চায় তারা। এটি লজ্জার। কিন্তু এটি শুধু আমজনতার ক্ষেত্রে নয়। বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ডের পড় বিশ্বমিডিয়া কিভাবে তা কভারেজ করেছে তা নিয়েও প্রতিবেদন করেছে প্রথম সারির দৈনিকগুলো। এটি যেন বিরাট এক অর্জন। বিশ্বমিডিয়ায় স্থান (!)।
প্রতিটি ঘটনার পরে কিছু তথ্য কমনলি জানা যায়। যথা : ০১. বিদ্যুতের শটসর্কিট কিংবা গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত, ০২. ভবনটি অনুমোদনহীন। হয়তো ১৬ তলার অনুমোদন নেয়া হয়েছিল কিন্তু করা হয়েছে ২২-২৩ তলা, ০৩. রাজউকের অনুমোদিত নকশায় এটি করা হয়নি, ০৪. পর্যাপ্ত পরিমাণ ফায়ার ইস্টিনগুইশার (অগ্নি নিরোধক ব্যবস্থা) ছিল না ভবনটিতে, ০৫. জরুরি অবস্থায় বাইরে বের হওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই, ০৬. রাস্তায় জ্যাম, জনতা কিংবা ট্রাফিক অথবা সরু রাস্তা যে কারণে ফায়ার সার্ভিসের জনবল আসতে দেরি হয়েছে, ০৭. পর্যাপ্ত অগ্নিনিরোধক যন্ত্রপাতি, আধুনিক কিংবা সেকেলে নেই, ০৮. জনমনে আতঙ্কের কারণে হুড়োহুড়ি কিংবা ঝাঁপ দেয়া ইত্যাদিই তখন বিচারের বিবেচ্য বিষয় হিসেবে দেখা দেয়। এসব ছাড়াও আছে একেক দফতরের হুমকি, ধমকি, নীতি কথা। রাজউক যেমন নড়েচড়ে বসে বিল্ডিংটির অনুমোদন আছে কিনা, নকশা ঠিক আছে কিনা, তেমনি বিরোধী দল চোখ বুজে দেখতে পায় সরকারের অব্যবস্থাপনার ফল এটি। কেউ কেউ তো আরো এক ধাপ এগিয়ে সরকারের ওপর আল্লাহর গজব মনে করেন। অন্যদিকে সরকারের কেউ কেউ তো এসবের পেছনে বিরোধী দলের ষড়যন্ত্রের প্রমাণও খুঁজে পান সহসা।
ঘটনার পরে বুয়েটের একদল বিশেষজ্ঞ আসেন ভবনটির অবস্থা দেখার জন্য। তাদের মতামতে দেখা যায়, ওই ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি ব্যবহার অনুপোযোগী। কিন্তু ছয় মাস এক বছর পরে আবার তা ব্যবহার উপযোগী হয়ে ওঠে। জানি না বুয়েটের ওই বিশেষজ্ঞ দলটির মত সেটি কিনা।
প্রায় সব ঘটনায়ই নিহতদের এক লাখ টাকা এবং আহতদের ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়। প্রশ্ন হলো, একটি জীবনের দাম মাত্র এক লাখ টাকা?
এমন একটি ঘটনাও দেখা যাবে না যে, তারা এসবের বিনিময়ে টাকা চেয়েছে। কিংবা টাকা পেয়ে খুশি হয়েছে। প্রতিবারেই তাদের একটি দাবি আর যেন কাউকে এভাবে নৃসংশভাবে জীবন দিতে না হয় সে ব্যবস্থা করা হয়।
প্রত্যেকটি অগ্নিকাণ্ডের পরে কত সুন্দর সুন্দর প্রস্তাব আসে এসব প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করার। আধুনিক প্রযুক্তির এ যুগে আক্রান্ত কোনো জায়গা থেকে মানুষগুলোকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে আসার মতো ব্যবস্থা হাতে নিতে খুব বেশি খরচ হওয়ার কথা নয়। বনানীতে আমরা দেখেছি জানালার ফাঁকা দিয়ে মানুষগুলোর বাঁচার সেকি আকুতি! ২৩ তলা, সে তো বেশিদূর নয়। সেখানে মই না পাঠাতে পারলেও সাময়িকের জন্য নিচে স্পঞ্জ কিংবা পাম্পের কিছু আস্তরণ দিলেও ঝাঁপিয়ে পড়া মানুষ দুটোকে বাঁচানো যেত। প্রতিটি বিল্ডিংয়ের প্রতিটি ফ্লোরে কিংবা রুমে ফায়ার সেন্সর/স্মোক সেন্সরের মাধ্যমে অটোমেটিক পানির ব্যবস্থা করা মোটেও কঠিন কিছু নয়। প্রত্যেকটি ফ্লোরে তো পানির লাইন আছেই। তাছাড়া, প্রত্যেকটি রাস্তায় ওয়াসার পানির লাইন তো আছেই। সেসব লাইনকে যদি অগ্নিনির্বাপক পানির লাইনের সাথে সংযুক্ত করে রাখা হয় তাহলে ফায়ার সার্ভিসের লোকের জন্য অপেক্ষা না করেও পানির ব্যবস্থা করা যায়।
সংশ্লিষ্ট সবার উচিত আমাদের মানুষ হয়ে ওঠা। মনুষ্যত্বকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করা। দিনে দিনে বেলা অনেক গড়িয়েছে। না জানি পরবর্তী মিছিলে আমার, আপনার কিংবা আমাদের কলিজার টুকরোটার নাম লিস্ট হয়ে আছে কিনা? আমরা মানুষ না হলে কেউ বাঁচব না এ মিছিল থেকে।
লেখক : শিক্ষাবিদ


আরো সংবাদ



premium cement