২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সমাজ বিনির্মাণে নারী

-

মানব সৃষ্টির সূচনা থেকেই নারী-পুরুষের অবস্থান। সভ্যতা বিকাশে নারীর ভূমিকা অপরিসীম। এই পৃথিবীতে পারিবারিক বন্ধন, বংশবৃদ্ধির ক্রমধারা অব্যাহত রাখা, মানবীয় গুণাবলির সম্মিলন ঘটানো, সর্বোপরি জীবনকে সুন্দর ও পূর্ণাঙ্গ রূপে গড়ে তোলার ব্যাপারে নারী-পুরুষ উভয়ের সমান অংশীদারিত্ব রয়েছে। নর-নারীর মাধ্যমে যে মানবসভ্যতার সূচনা, তা আজ প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটিতে রূপান্তরিত হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। নারী পরিবার, সমাজ, দেশ কিংবা আন্তঃ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পর্যায়ে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
নারীরা হলেন ইসলামী সমাজের গুরুত্বপূর্ণ মৌল। কারণ, তাদের ওপরই ন্যস্ত আগামী প্রজন্মের আবেগ-অনুভূতি এবং চিন্তা-চেতনাকে সুস্থ ও অমলিন রাখার দায়িত্ব। প্রবৃত্তি তথা রিপুর তাড়না ও অধোমুখী পাশবিক আচরণের দূষণ থেকে তাদের সুরক্ষা দেয়ার সুকঠিন জিম্মাদারিও অর্পণ করা হয়েছে তাদের ওপর। এভাবেই নারীরা অবদান রাখেন সমাজকে পবিত্র করতে এবং এর প্রকৃত সম্পদ ও মর্যাদা অটুট ও অক্ষুণœ রাখতে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই, যত নবী-রাসূল সা: এসেছেন, সবার সহযোগিতায় প্রতিটি কওম থেকে এগিয়ে এসেছিলেন কিছু মহিয়সী নারী। তাদের সাহায্য-সহযোগিতা, ত্যাগ-কোরবানি এ ইসলামী জমিনকে উর্বর করতে সাহায্য করেছিল। সেই সাথে তাদের অনন্য সাধারণ মানবিক গুণাবলিও যুগে যুগে মুমিন নারীদের অনুপ্রেরণার উৎস।
ইবরাহিম আ: যখন আল্লাহর নির্দেশে স্ত্রী হাজেরা ও তার শিশুপুত্র ইসমাঈলকেসহ জনমানবহীন প্রান্তরে রেখে আসলেন, তখন ধৈর্য্যরে চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে স্ত্রী হাজেরা সন্তুষ্টচিত্তে আল্লাহ প্রদত্ত এ ফায়সালা মেনে নিলেন। হাজেরা জিজ্ঞেস করলেনÑ আপনি কি আল্লাহর নির্দেশে আমাকে এখানে রেখে যাচ্ছেন? তখন ইবরাহিম আ: বললেন, হ্যাঁ! হাজেরা বললেনÑ ‘আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে পরম ধৈর্য্যশীল পাবেন।’ শান্তভাবে শিশুপুত্রের পাশে বসলেন এবং বললেন, ‘যে আল্লাহ এ নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করবেন না।’ কী চমৎকার ধৈর্য্য ও তাওয়াক্কুলের নজরানা!
আছিয়া রা: ছিলেন ফেরাউনের সম্রাজ্ঞী। এরপরও দুনিয়ার বিলাসিতা ও সব আরাম-আয়েশ পদদলিত করে সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকার জন্য স্বেচ্ছায় সব দুঃখ-কষ্ট গ্রহণ করে নেন। ফেরাউনের কঠোর নির্যাতনের মধ্যেও আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্যকে বরণ করে নেন।
রাসূল সা: দ্বীনের কাজ করে যখন গভীর রাতে বাসায় ফিরতেন, খাদিজা রা: দরজার সাথে নিজের পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমাতেন। যাতে দরজার আওয়াজ শোনা মাত্রই ঘুম ভেঙে যায়। একদিন রাসূল সা: খাদিজা রা:কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে খাদিজা! তুমি কি ঘুমাও না? তখন খাদিজা রা: বললেন, ‘আল্লাহর নবী দরজায় করাঘাত করে দাঁড়িয়ে থাকবেন, আর আমি ঘুমে মশগুল থাকব তা কী করে সম্ভব।’
রাসূল সা:-এর সাথে শিয়াবে আবু তালিবে খাদিজা রা: ও অন্তরীণ ছিলেন। গাছের পাতা ছাড়া জীবন ধারণের আর কোনো ব্যবস্থা তাদের ছিল না। এর মধ্যেও খাদিজা রা: সবসময় হাসিমুখে থাকতেন।
রাসূল সা: তাঁর ব্যাপারে বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর চেয়ে উত্তম নারী আমাকে দান করেননি। মানুষ যখন আমাকে মানতে অস্বীকার করেছে, মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে, তখন সে আমার প্রতি ঈমান এনেছে। মানুষ যখন আমাকে বঞ্চিত করেছে, তখন সে আমাকে তাঁর সম্পদের অংশীদার করেছে।’
খাতুনে জান্নাত ফাতেমা রা: ছিলেন রাসূল সা:-এর কনিষ্ঠ কন্যা। উত্তম আখলাকের সব দিক ও অধ্যায় তাঁর মধ্যে প্রতিফলিত হতো। আয়েশা রা: বলেন, ‘আমি ফাতেমার চেয়ে একমাত্র তার বাবা ছাড়া আর কোনো ভালো মানুষ দেখিনি।’
সংসার জীবনে কৃচ্ছ্র সাধনের এক অনুপম দৃষ্টান্ত ফাতেমা রা:। দেখা যেত একাধারে তিনি হাতে ময়দা পিষার জন্য চাকা ঘুরাতেন, শিশুদের দোল দিতেন আবার কুরআনের আয়াতও পড়তেন। আটা পিষতে পিষতে তাঁর হাতে ফোসকা পড়ে যেত, পানির মশক টানতে টানতে বুকে দাগ হয়ে যেত। এরপরও সাংসারিক কাজেও কখনো অভিযোগ করেননি। ইসলামের খেদমতেও কোনো অবহেলা করেননি।
আসমা বিনতে আবুবকর শুরুতেই যারা ইসলাম গ্রহণ করেন তাদের মধ্যে অন্যতম। একবার তার ছেলে আবদুুল্লাহ ইবনে জুুবায়ের ইয়াজিদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ না করায় মৃত্যুও তাঁর পরবর্তী শাস্তির আশঙ্কা মায়ের কাছে ব্যক্ত করে। জবাবে আসমা রা: বলেন, বকরি জবাই করার পর তার চামড়া ছিলে ফেলা হোক বা তাকে কিমা করা হোক তাতে বকরির কোনো কষ্ট হয় না।
এ কথা শুনে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে আবদুল্লাহ মায়ের কাছে লৌহবর্ম পড়ে দোয়া চাইতে আসেন। বার্ধক্যে দৃষ্টিশক্তিহীন আসমা রা:-এর ছেলের সাথে কোলাকুলি করার সময় লৌহবর্ম অনুভব করে বললেন, ‘প্রাণপ্রিয় ছেলে আবদুল্লাহ! যারা শাহাদাতের আকাক্সক্ষী হয়, তারা বর্ম পরিধান করে না।’
তিন দিন পর নিজ ছেলের লাশ উল্টো করে ঝুলানো দেখে অত্যন্ত ধৈর্য্যরে সাথে বলেন, ‘ইসলামের ঘোড়সওয়ার দ্বীনের জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণ এ বীরপুরুষের কি ঘোড়ার পিঠ থেকে নামার এখনো সময় হয়নি!’
আসমা রা:-এর এহেন ব্যক্তিত্বের কাছে হাজ্জাজের দম্ভ ও ঔদ্ধত্য ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
খানসা রা:ও চমৎকার নসিহত দিয়ে তার চার ছেলেকে যুদ্ধের ময়দানে পাঠান এবং একেক করে চার ছেলেই শাহাদত বরণ করেন।
সর্বপ্রথম শহীদ সুমাইয়া রা:। মুশরিকরা তাঁকে লোহার পোশাক পরিয়ে উত্তপ্ত বালুর মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখত। রাসূল সা: পথ দিয়ে যেতে যেতে বলতেন, ধৈর্য্য ধারণ করো, তোমাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। আবু জেহেলের বর্শা নিক্ষেপে তিনি শাহাদাৎ বরণ করেন।
এমনি আরো অসংখ্য মহিয়সী নারী ইসলামী সমাজ গঠনে নিজেদের সবটুকু উজাড় করেছেন। জাহেলী রসম-প্রথাকে পদদলিত করে সত্য আদর্শের আলোকে নিজ ব্যক্তিত্ব গঠন, পরিবার গঠন এবং সমাজ গঠনেই তারা আত্মনিয়োগ করেন। ফলে চমৎকার পবিত্রতার আবহপূর্ণ একটি সমাজ উপহার দিয়ে গেছেন উত্তরসূরিদের।
মিসরীয় ইতিহাসে রানি নেফারতিতি রাজকার্যের সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণ করতেন। মিসরীয় দেয়ালচিত্রে এর প্রমাণ রয়েছে। গ্রিস সভ্যতার ইতিহাসে জানা যায়, সেই সময় মহিলারা বিভিন্ন চিত্রকলা, স্থাপত্যবিদ্যা ও ভাস্কর্যে পুরুষদের পাশাপাশি অংশগ্রহণ করতেন।
যুগে যুগে নারীরা সময়ের মাইলফলক হিসেবে অবদান রেখে চলেছেন। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে নারীদের ভূমিকা ছিল অনন্য। সবপর্যায়ের নারী ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশকে স্বাধীন করার জন্য। তাদের আত্মত্যাগ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এক উজ্জ্বল অধ্যায়।
সমসাময়িককালে বহুজাতিক ও করপোরেট দফতরগুলোতে নারীরা বিভিন্ন পদবিতে নারী উদ্যোক্তা, নারী সংগঠক, নারী রাজনীতিক হিসেবে কর্মরত আছেন। পাশাপাশি বিশ্বব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হচ্ছে।
মানবসভ্যতায় যে নারীর রয়েছে, এরূপ বিপুল ঐশ্বর্যমণ্ডিত ইতিহাস। পরিতাপের বিষয় হচ্ছেÑ সেই নারীই আজ নিগৃহীত, পীড়িত, অপমানিত হচ্ছেন অফিস-আদালতে কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
সভ্যতার এই চরম উৎকর্ষের লগ্নেও নারী নিরাপদ নয় তার নিজ গৃহেও। পরিবর্তনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ নারীদের মধ্যে শিক্ষার হার বেড়েছে। করপোরেট লেভেলেও উচ্চ পদে উঠে আসছেন যোগ্যতাসম্পন্ন নারীরা। আগে ‘চাকরিজীবী মহিলা’ মানেই যে নেতিবাচক ভাবমর্যাদা তুলে ধরা হতো, আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন নারীরা সে তীর্যক দৃষ্টিকে ঋজু করতে পেরেছেন অনেকখানি। সমাজে নারী-পুরুষের ভূমিকার ব্যাপারে আধুনিক সমাজে নারীকে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী না মনে করে একে অন্যের পরিপূরক মনে করা উচিত।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

 


আরো সংবাদ



premium cement