২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ইসলামী শিক্ষার প্রকৃতি

-


ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমাদের সমাজে একটি প্রচলিত ভুল ধারণা রয়েছে। আমরা মনে করি মাদ্রাসা শিক্ষাই একমাত্র ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা এবং অন্যান্য শিক্ষাব্যবস্থা ইসলামিক নয়। আবার কখনো কখনো বিজ্ঞজনদেরকেও দেখা যায় কথায় কিংবা লেখায় হরহামেশা ব্যবহার করেন ‘ইসলামী শিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষা’। এটি কত বড় মারাত্মক তা আমাদের অবহেলার কারণে অনুধাবন পর্যন্ত করতে পারি না। মাদ্রাসা শিক্ষাকে ইসলামী শিক্ষা এবং অন্যান্য সাধারণ শিক্ষাকে আধুনিক শিক্ষা হিসেবে অভিহিত করলে দুটি জঘন্য ভুল আমরা করে থাকি। ১. ইসলামী শিক্ষার প্রকৃতি ও পরিধিকে ছোট করে ফেলি যা মানবতার জন্য কল্যাণকর হতে পারে না; হয়ও না এবং ২. ইসলামী শিক্ষাকে সেকেলে বলে ধরে নেয়া হয়। এ দুটির কোনোটিই সত্য নয়। কারণ হলো:
ইসলাম শুধু প্রচলিত অর্থেও একটি ধর্ম নয়; বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। (সূরা আলে ইমরান: ১৯) যদি তাই হয় তাহলে জীবনের চলার পথে সব বিষয়ের সমন্বিত রূপ হবে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা। সেখানে ধর্মীয় বিষয়গুলোর পাশাপাশি অন্যান্য দুনিয়াবি বিষয়ের সমন্বয় ঘটবে তিনটি মূলনীতিকে সামনে রেখে। যেমন: (ক) তাওহিদ। এখানে তাওহিদ বা এক আল্লাহর এবং তার একত্ববাদের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো কিছুই শিক্ষা দেয়া হবে না। (খ) কুরআন ও সুন্নাহের পরিপন্থী কোনো কিছুই শেখানো হবে না এবং (গ) কল্যাণকর। সে শিক্ষা হবে মানবতা তথা সব সৃষ্টিকুলের কল্যাণার্থে। এ তিনটি বিষয় ঠিক রেখে যেকোনো শিক্ষাব্যবস্থায়ই ইসলামী শিক্ষা হিসেবে গণ্য হবে। কারণ, রাসূল সা:-এর হাদিসে বলা হয়েছে, “.... ঐ জ্ঞান যা মানুষের উপকারে আসে (মৃত্যুর পরেও তার বিনিময় ঐ ব্যক্তি পাবেন)”। (সহিহ বুখারি) এখানে জ্ঞানকে মানব কল্যাণের জন্য বিবেচিত করা হয়েছে। লক্ষ্য করুন, মাদ্রাসায় যে শিক্ষা দেয়া হয় তাতে কোনো চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সমাজতত্ত্ববিদ, বিজ্ঞানী পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? তাহলে ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় এগুলোর কি প্রয়োজন হবে না? এগুলো আমাদের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত। তাহলে? অথচ আমাদের দেশে আলিয়া মাদ্রাসায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে (কামিলে) মাত্র চারটি বিষয়ের দক্ষতার সার্টিফিকেট দেয়া হয়। তা হলো: তাফসির, হাদিস, ফিকহ ও আরবি সাহিত্য।
“ইসলামি ও আধুনিক শিক্ষা” পরিভাষা ব্যবহার করলে প্রকারান্তে ইসলামকে হেয় করা হয়। এতে বোঝা যায় ইসলামী শিক্ষা আধুনিক নয়। এটি পুরনো; সেকেলে। আধুনিক মানুষ তখন এ থেকে সরাসরি মুখ ফিরিয়ে নিবে এটাই স্বাভাবিক। অথচ, ইসলামের এবং এ শিক্ষার মূল দুটি উৎস কুরআন ও হাদিস-এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তা কিয়ামত পর্যন্ত সব মানুষের জন্য কার্যকর হবে। এখন এগুলোকে সময়োপযোগী হিসেবে বোঝা, উপস্থাপন করা কিংবা ব্যবহার উপযোগী করা কাদের দায়িত্ব? নিশ্চয় আমাদের। এ লক্ষ্যেই হয়ত আল্লাহ তা‘আলা মানব সৃষ্টির শুরুতে বলেছিলেন, “আমি পৃথিবীতে খলিফা প্রেরণ করতে চাই।” (সূরা আল-বাকারাহ: ৩০)
এসব কারণে ইসলামী শিক্ষাবিজ্ঞান সম্পর্কে সাম্যক জ্ঞান থাকা একজন মু’মিন, মুসলিমের জন্য অতীব জরুরি। ইসলামী শিক্ষাবিজ্ঞানে নি¤েœাক্ত বিষয়গুলো অবশ্যাম্ভাবীভাবে থাকবে:
তাওহিদ বা একত্ববাদ। এ শিক্ষা ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হবে তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদ। তার একক ইবাদত সেখানে নিশ্চিত হবে।
মানুষ হলো খলিফা (প্রতিনিধি)। ইসলামী শিক্ষায় এ মূলনীতি আবশ্যকীয়। মানুষ যখন বুঝতে পারবে তাদেরকে প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে তখন তারা তাদের নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হবে তেমনি তা ইহলৌকিক ও পরলৌকিক কল্যাণে নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখবে।
মাকাসিদুশ শরিয়াহ (ইসলামী বিধানের উদ্দেশ্যসমূহ) ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থায় সুস্পষ্টভাবে শিক্ষা দেয়া হবে। উদ্দেশ্য জানলে মানুষ তা পালন করতে উৎসাহী হবে এটাই স্বাভাবিক। শরিয়তের প্রত্যেকটি বিধানের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বিধানদাতা কর্তৃকই নির্ধারিত। এগুলো যেকোনো বিবেচনায় মানবকল্যাণময়।
ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা ইসলামী শিক্ষার অন্য একটি বৈশিষ্ট্য। দুনিয়া এবং আখেরাতের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থায় প্রকৃত সফলতা নিহিত। ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা এটিকে নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে। তখনই কেবল মানুষ আখেরাতের জবাবদিহিতাকে সামনে রেখে দুনিয়ার দায়িত্ব-কর্তব্যকে যথাযথভাবে পালন করবে।
ন্যায়পরায়ণতা শুধু আইন ও বিধানের ক্ষেত্রে নয় বরং জীবনের প্রত্যেকটা স্তরে নিশ্চিত করে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা। সেখানে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ তৈরি হবে না; সাম্যতা সেখানে অবশ্যম্ভাবী হিসেবে উপস্থিত হবে। বঞ্চনা তাই বিতাড়িত হবে প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে।
মানবকল্যাণকে নিশ্চিত করে ইসলামী শিক্ষা। এ শিক্ষার মূল লক্ষ্যই হলো মানবকল্যাণ।
মধ্যপন্থী জীবনব্যবস্থা উত্তম এটি ইসলামী শিক্ষার অনন্য লক্ষ্য। বাড়াবাড়ির যেমন স্থান নেই সেখানে আবার হেলায় ফেলায় গড্ডালিকায় নিজেকে ভাসিয়ে দেয়ার কোনা স্পৃহা তৈরি হবে না এ শিক্ষায় শিক্ষিতরা।
সর্বোপরি এটি একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থা হবে। যেখানে জীবনের প্রয়োজন মেটানো সহজলভ্য এবং সক্ষম হবে। জীবনের কী প্রয়োজন তা পুরণে সক্ষম হবে এ শিক্ষাব্যবস্থা।
কোনো শিক্ষাব্যবস্থা যখন উপরিউক্ত বিষয়গুলোকে নিশ্চিত করবে তখন মানবসভ্যতায় হানাহানি, মারামারি, হিংসা-বিদ্বেষ, হত্যা-রাহাজানি, দুর্নীতি ইত্যাদি বন্ধ হয়ে প্রতিষ্ঠা পাবে অনাবিল শান্তি। এটিই কি আমাদের কাম্য নয়?
লেখক :বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক


আরো সংবাদ



premium cement