২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
‘রি-ডিসকভারিং প্রেয়ার’

নামাজ আদায়ের সর্বোত্তম নির্দেশিকা

-

বাসাম সায়েহ’র লেখা Rediscovering Prayer শীর্ষক গ্রন্থটি অনবদ্য একটি সৃষ্টি। মূল বইটি আরবিতে লেখা হলেও ইংরেজিতে তার অনুবাদ অত্যন্ত উচ্চমানসম্পন্ন হওয়ায় বইটি অধ্যয়ন ও তার নির্যাস বের করে নিতে আমার মতো স্বল্পজ্ঞানের লোকেরও সামান্য কষ্ট হয়নি। সে জন্য লেখক ও অনুবাদক উভয়কেই জানাই সশ্রদ্ধ সালাম।
মোট ১০৮ পৃষ্ঠার বইটি যেকোনো ঈমানদার ব্যক্তির জীবনে একটি মূল্যবান উপহার হিসেবে বিবেচিত পারে; যেমনটি আমার ক্ষেত্রে হয়েছে। জীবনে নামাজ সম্বন্ধে এত সুন্দর, এত বিস্তৃত ও এত মনোমুগ্ধকর আলোচনা কখনো শুনিনি, দেখিওনি।
শাহ আবদুল হান্নান বইটি পড়তে দিয়ে আমাকে ধন্য করেছেন। এ জন্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। লেখক বইটির নাম দিয়েছেন Rediscovering Prayer. সত্যি আমি আমার জীবনের প্রায় ৬০তম বর্ষে এসে নামাজকে পুনর্বার আবিষ্কার করলাম এবং বুঝলাম জীবনে এ পর্যন্ত যত নামাজ পড়েছি তা আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার দূরতম কোনো আশাও দেখছি না। যেন এত কাল নামাজ পড়েও পড়িনি। নামাজের নামে আল্লাহকে ফাঁকি দিয়েছি। অথচ নামাজ হচ্ছে একজন মুমিনের জীবনের সবচেয়ে আরাধ্য জিনিস। একজন মুসলমান ও একজন কাফেরের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করে নামাজ। এই নামাজ মুমিনের জন্য মিরাজ অর্থাৎ আল্লাহর দিদার বা সাক্ষাৎ লাভের সর্বোত্তম উপায়। পার্থিব জীবনে একজন সামান্য ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে আমরা সাক্ষাৎ করতে গেলেও মোটামুটি একটু প্রস্তুতি নিয়ে যাই। কিন্তু বিশ্ব শ্রষ্টা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সাথে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত আমরা যে সাক্ষাৎকার দেই, সে জন্য আমরা আদৌ কি কোনো প্রস্তুতি নেই? এর জবাব আমার কাছে তো নেই। বরং শতকরা কত জনের কাছে আছে তাও আমার জানা নেই। এই হিসাবকে শতকরা হিসাবে নাকি সহশ্র হিসাবে নাকি লাখ হিসাবে ধরব তাও বুঝতে পারছি না। এই হচ্ছে আমরা মুসলমানদের নামাজের অবস্থা।
আল্লাহর রাসূল সা: এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘আসসালাতু মেরাজুল মুমিনিন’Ñ অর্থাৎ নামাজ মুমিনের জন্য মিরাজ। এই মর্যাদাসম্পন্ন ইবাদত নামাজকে সত্যিকারভাবে ও সর্বাঙ্গীন সুন্দরভাবে কিভাবে আদায় করা যায় তার পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করেছেন লেখক এই বইটিতে। লেখক বলেছেন, একজন সত্যিকার ঈমানদার মুসল্লি নামাজকে কখনো বোঝা বা কর্তব্য বলে মনে করেন না। মনে করেন আনন্দের উৎস এবং অধিকার হিসেবে।
লেখক বলেছেন, পার্থিব জীবনে সাফল্য লাভের জন্য আমরা ভালো ব্যবস্থাপনার কথা বলি এবং এ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ডিগ্রি হাসিল করি। লক্ষ্য একটাই, জীবনে সাফল্যের চূড়ায় আরোহণ করা। অনুরূপভাবে পার্থিব জীবনের পাশাপাশি পরকালীন সাফল্য হাসিলের জন্যও আমাদের নামাজের ব্যাপারে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা জানতে হবে।
লেখক বইটিতে বহু মূল্যবান চিন্তা ও দর্শন হাজির করেছেন, যা আমরা সচরাচর ভাবি না বা ভাবার ফুরসত পাই না। তিনি বলেছেনÑ Prayer is the school of Patience, and Patience is the school of civilization. আসলেই তো তাই। যেদিন মুসলমানদের নামাজ সুন্দর ছিল। সেদিন মুসলমানরা এই পৃথিবীতে বাদশাহী করেছেন। মুসলমানরাই আধুনিক সভ্যতার জনক। ইউরোপ যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল, তখন মুসলমানরা দিকে দিকে জ্ঞানের আলোর মশাল জ্বেলেছিল। অনলপ্রবাহের কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজী তার ‘স্পেনে মুসলিম সভ্যতা’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে যথার্থই লিখেছেনÑ ‘মুসলমানরা স্পেনের কর্ডোভা নগরী থেকে যখন সভ্যতার স্বর্গীয় প্লাবন এবং জ্ঞান বিদ্যাশিক্ষার উত্তাল তরঙ্গমালা বক্ষে ধারণ করিয়া কুসংস্কার জঞ্জাল পরিপূর্ণ ইউরোপকে প্লাবিত ও বিধৌত করার জন্য দুর্বার গতিতে ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন বর্তমান জ্ঞানগর্বে গর্বিত ও সভ্যতা প্রদীপ্ত ইংরেজ, জার্মান ও ফরাসি জাতির পূর্বপুরুষেরা পর্বতের গুহায় বা গভীর কাননাবাসে আমমাংশ খাইয়া আপনার বন্য জীবন অতিবাহিত করিত।’
লেখক বাসাম সায়েহ তার গ্রন্থে নামাজ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তার আনুষঙ্গিক সব দিকই চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন, যার মধ্যে চিন্তার অনেক খোরাক রয়েছে। তিনি নামাজের জন্য প্রথমেই পাক-পবিত্রতা অর্জনে অজু-গোছলের গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন। তারপর নামাজের প্রস্তুতির জন্য আজান ও ইকামাতের গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন। প্রত্যেক নামাজের জন্য যে নির্ধারিত সময় রয়েছে সে সম্পর্কে, বিশেষত ফজরের নামাজের সময় নিয়ে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে। তদুপরি তাকবিরে তাহরিমা, নামাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ সূরা ফাতিহার গুরুত্ব ও তা কিভাবে ধীরে ধীরে অর্থ বুঝে বুঝে অন্তরে গেঁথে গেঁথে পড়তে হবে অন্যান্য সুরাসহ তা বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। রুকু সিজদাহ কিভাবে করতে হবে, কিভাবে তাশাহুদ ও দরুদ পড়তে হবে এবং এ জন্য কতটুকু সময় বরাদ্দ রাখতে হবে তারো মনোজ্ঞ বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। প্রসঙ্গত, তিনি এ কথাও বলেছেন, এক মিনিটে এক রাকাত, দুই মিনিটে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলে তা কোনোভাবেই নামাজের পর্যায়ে পড়ে না। মোরগের আধার খাওয়ার মতো রুকু-সিজদার আল্লাহর দরবারে কোনো মূল্য আছে কি না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ প্রসঙ্গে লেখক একটি হাদিসের অবতারণা করেছেন। একদিন নবী করিম সা: এক ব্যক্তিকে নামাজ শেষ করে উঠার পর আবার তাকে নামাজ পড়তে বললেন। দ্বিতীয়বার নামাজ শেষ করার পর তিনি একই নামাজ তৃতীয়বার আদায় করতে বললেন।
আল্লাহর নবী সা: যদি আজ জীবিত থাকতেন ও আমাদের নামাজ পড়া দেখতেন, তাহলে আমাদেরও যে বিশেষ করে এই অধমকে যে নামাজ দুরস্ত করতে বলতেন সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আল্লাহ আমার ও আমার মতো অন্য সব মুসল্লিকে হেফাজত করুন।
এ ধরনের নামাজ থেকে নিজেদের রক্ষার জন্যই মূলত লেখক এত কষ্ট করে গ্রন্থটি রচনা করেছেন। তার গ্রন্থের মূল কথা হচ্ছেÑ একজন মুসল্লি নামাজের আগে ও পরে এবং জামাতে নামাজ পড়লে মসজিদে প্রবেশের আগে ও মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসার পরে নিজের মধ্যে শারীরিক ও মানসিকভাবে কোনো পার্থক্য খুঁজে না পান, তাহলে বুঝতে হবে ওই মুসল্লি নামাজ থেকে আসলে কোনো ফায়দা হাসিল করতে পারেননি। অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন, নামাজের মতো নামাজ পড়লে একজন মুসল্লির শরীর ও মন প্রশান্তিতে ভরে যাবে এবং এটা তিনি তাৎক্ষণিক উপলব্ধি করতে পারবেন।
আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককে নামাজের মতো নামাজ আদায় করার মাধ্যমে মিরাজ তথা আল্লাহর দিদার হাসিল করার তৌফিক দান করুন, আমিন। পরিশেষে আমি Rediscovering Prayer গ্রন্থের বহুল পাঠ কামনা করি আর দোয়া করি আল্লাহ যাতে লেখককে এই গ্রন্থের বদৌলতে নেক হায়াত দেন ও জান্নাতুল ফেরদাউস কবুল করেন, আমিন।
লেখক : সাংবাদিক

 


আরো সংবাদ



premium cement