কাউকে কাফের বলার ব্যাপারে সাবধানতা জরুরি
- মোহাম্মদ হাশিম কামালি
- ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০
শরিয়ত কোনো মুসলমানকে অপর অবিশ্বাসী বা কাফের, ধর্মের প্রতি কটাক্ষকারী অথবা বিভ্রান্ত ব্যক্তি, ইত্যাদি দোষারোপ করতে নিষিদ্ধ করেছে। এটি হচ্ছে সাধারণ নীতি। এমনকি একজন অন্যজনকে অবিশ্বাসী (কাফের) বলে সন্দেহ করার ক্ষেত্রেও এ বিধান প্রযোজ্য হবে। একইভাবে কোনো মুমিন ব্যক্তি যদি দেখতে পান, তার মতোই একজন মুসলমান এমন কথা উচ্চারণ বা কাজ করেছে যাতে মনে হবে যে, সে হয়তো কাফের হয়ে গেছে, তা সত্ত্বেও তাকে অবশ্যই সন্দেহের সুবিধা দিতে হবে এবং সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কোনোক্রমেই তাকে কাফের বলা যাবে না। লোকদের অবিশ্বাসী বা পৌত্তলিক বলা পরিহার করার প্রতি দৃঢ় সমর্থন পাওয়া গেছে উপরিউক্ত ঘটনায়। আমি এখানে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এ ধরনের দোষারোপ দৃঢ় ভাষায় নিষিদ্ধ করা সংক্রান্ত বিপুলসংখ্যক হাদিস থাকা সত্ত্বেও বিষয়টি এতই স্পর্শকাতর ও জটিল যে, কেবল ধর্মতত্ত্ব, বিজ্ঞান সম্পর্কে অত্যন্ত পারদর্শী কোনো বিচারক অথবা ফিকাহ বিশারদই (মুফতি) কোন জিনিসটি সঠিকার্থে অবিশ্বাস করা বোঝায় তা নিরূপণ করার কর্তৃত্বের অধিকারী।
যদি কোনো মুসলমান এমন কথা বলে বা এমন কাজ করে, যার কুফরির পর্যায়ে পড়ার কেবল একটা সম্ভাবনা থাকে, তাহলেও তাকে ধর্মত্যাগী বা অবিশ্বাসী বলা যাবে না। ইমাম আবু হানিফার মতে, কোনো কথার যদি ৯৯ শতাংশই অবিশ্বাসের বোঝায় এবং মাত্র ১ শতাংশ বিশ্বাস (ঈমান) অবশিষ্ট থাকেÑ তাহলে তাকে কাফের বলা যাবে না। একই দৃষ্টিভঙ্গির বিবরণ উল্লেখ করে আবু জাহরাহ আরো ব্যাখ্যা করে বলেন, এমন এক পরিস্থিতিতে কথাটি উচ্চারিত হয়েছে যে; তা অবিশ্বাসের বলে মনে হতে পারে। যেমন যে প্রেক্ষাপটে কথাটি বলা হয়েছে অথবা যে উৎস থেকে দৃষ্টিভঙ্গিটির উৎপত্তি হয়েছে, তাতে যদি সন্দেহজনক ব্যাখ্যার অবকাশ থাকে; তাহলে তার কুফরির পর্যায়ে পড়ার বিষয় বাতিল হয়ে যাবে। এ ধরনের সব ঘটনাকে সন্দেহের সুবিধা প্রদান করা উচিত। এ ধরনের অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চতুর্থ খলিফা আলী ইবনে আবু তালিবের শাসনামলে খারেজিরা বাড়াবাড়ি শুরু করে এবং রাসূল সা:-এর নেতৃস্থানীয় সাহাবিদের বিরুদ্ধে পর্যন্ত ‘কুফরির’ অভিযোগ করে। খারেজিদের সীমালঙ্ঘনকারী হিসেবে গণ্য করা সত্ত্বেও কোনো সময়ই খলিফা তাদের অবিশ্বাসী (কাফের) বলে ঘোষণা করেননি। এর পরিবর্তে তিনি বলেন, যে ব্যক্তি সত্যের অনুসন্ধান করে কিন্তু ভুল করে, সে আর যে ব্যক্তি মিথ্যার সন্ধান করে এবং এরপর তা কার্যকর করতে অগ্রসর হয়, তারা কখনো এক রকম নয়।
ইবনে হাযম নি¤েœ আরো পরিষ্কারভাবে এ মূলনীতির উল্লেখ করেছেন : যে ব্যক্তি ঈমানের (কালেমা আল-শাহাদাত) সাক্ষ্য দেবে এবং নবী মুহাম্মদ সা:-এর নীতি ও আদর্শের প্রতি তার বিশ্বাসের ঘোষণা দেবে; সে একজন মুসলমান এবং অকাট্য সাক্ষ্যপ্রমাণ দ্বারা তাকে অবিশ্বাসী বলে গণ্য না করা পর্যন্ত কোনো ধরনের অভিযোগ আরোপ করে ইসলামের সাথে তার এ সম্পর্কের বন্ধন ছিন্ন করা যাবে না।
একটি স্বীকারোক্তির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছে বলে পরিচিত হলে, সে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য এ মর্যাদার অধিকারী হবে বলে মনে করতে হবে। কোনো ব্যক্তি জন্মসূত্রে মুসলমান অথবা ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান বলে পরিচিত হয়, এতে তার এ মর্যাদার সৃষ্টি হয়, আইনের বিধি অনুযায়ী সন্দেহবশত তার এ মর্যাদা বাতিল করা যাবে না, বরং তা স্থায়ীভাবে বজায় থাকবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়Ñ সন্দেহ, সংশয় পোষণ বা অভিযোগের কারণে কোনো ব্যক্তির ধর্মীয় মর্যাদার বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করা বা তা বাতিল করা যাবে না।
‘আলেমগণ’ ও চার মাজহাবের ইমামগণ একমত যে, নিছক মতপার্থক্যের কারণে কাউকে অবিশ্বাসী বা কাফের বলা জায়েজ বা বৈধ নয়। অনুরূপভাবে কাউকে সুনির্দিষ্টভাবে নাম উল্লেখ করে কাফের ঘোষণা করা যাবে না। আল বাহনাসাবি এ প্রসঙ্গে যথার্থই বলেছেন, ‘কারণ এ বিষয়টি নির্ধারণ করা একান্তভাবে একজন উপযুক্ত বিচারকের কাজ; তাই কাউকে অবিশ্বাসী ঘোষণা করার কোনো অনুমতি কোনো অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে দেয়া হয়নি।’ এ মতের সমর্থনে নি¤েœাক্ত দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয় : দ্বিতীয় খলিফা ‘উমর ইবনে খাত্তাবের শাসনামলে ইবনে মাজউন নামে পরিচিত এক ব্যক্তি ইসলামে মদপানের অনুমতি রয়েছে বলে একটি বিবৃতি দেয়। খলিফা অবশ্য এ জন্য তাকে কাফের ঘোষণা না করে বললেন, এ ব্যাপারে কোনো রায় ঘোষণার আগে প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সাক্ষ্যপ্রমাণসহ যাচাই করা প্রয়োজন।
সাধারণ নিয়ম অনুসারে, কোনো ব্যক্তির বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের বিষয় নির্ধারণের লক্ষ্যে উপস্থাপিত প্রয়োজনীয় সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রকৃতিগতভাবে দ্ব্যর্থহীন, সুস্পষ্ট ও পরিষ্কার প্রমাণের ভিত্তিতে হতে হবে; কোনো গোপন চিন্তা বা অনুভূতির উল্লেখের কারণে নয়। কারণ, তা কেবল আল্লাহই জানেন। এটি হলো কুরআনের আয়াতের মর্মবাণী যাতে মুমিনদের শিক্ষা দেয়া হয়েছেÑ
‘তোমাদেরকে যারা শান্তির (আল সালাম) সম্ভাষণ জানায়, তাদেরকে এ কথা বলো নাÑ তোমরা তো মুমিন নও।’
কেবল সালাম শব্দটি উচ্চারণ যদি কোনো ব্যক্তির মুমিন হওয়ার বিষয় প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে এটি স্পষ্ট যে, কুরআন কোনো ব্যক্তির ইসলামী মর্যাদা নিরূপণের জন্য কোনো ধরনের প্রমাণপঞ্জি সংগ্রহের অনুমতি দেয়নি। কুরআনের এ মূলনীতির আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নি¤েœর এ হাদিসেÑ
যে ব্যক্তি আমাদের মতো নামাজ পড়বে, আমাদের কিবলা যেদিকে তার কিবলাও সেদিকে অথবা আমরা যা জবাই করি সে তা খায়, তাহলে সে একজন মুসলমান। আমাদের যেসব অধিকার ও দায়িত্ব রয়েছে তারও তা থাকবে।
ইসলামী ভ্রাতৃত্বের মূলভিত্তি হলোÑ ঈমানের ঐক্য। এ কারণে রাসূল সা: মুমিনদের পরস্পরকে কাফের বলে অভিযুক্ত না করতে সতর্ক করে দিয়েছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এ বিষয়ে বলা হয়েছে :
যখন কোনো ব্যক্তি তার ভাইকে ‘কাফের’ বলে অভিহিত করে, তখন তাদের যেকোনো একজনের ওপর এ অভিযোগ বর্তাবে। হয় বিষয়টি যেভাবে বলেছে সে রকমই হবে অথবা (অভিযোগ যদি সত্য না হয় তাহলে) উচ্চারণকারীর ওপরই তা বর্তাবে।
আবুজার গিফারি রা: থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদিসে বলা হয়েছে :
‘কোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তিকে কাফের বা আল্লাহর ‘দুশমন’ বলে অভিযুক্ত করল, অথচ এটি সত্য নয়, তাহলে ওই অভিযোগ তার ওপরই বর্তাবে।’
উপরিউক্ত হাদিসগুলোর বার্তা কেবল কোনো ব্যক্তিকে তাকফির বলা নিষিদ্ধের মধ্যেই সীমিত থাকেনি; উপরন্তু তা সীমালঙ্ঘন বা গুনাহ (ফিসক) এবং অপরের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অপরাধ ও গুনাহের অভিযোগ আরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। তাই কোনো মুসলমান কর্তৃক অপর কাউকে ফিসকের অভিযোগ করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আরেকটি হাদিসে ব্যাপকার্থে এ কথা ঘোষণা করা হয়েছে :
‘কোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তিকে সীমালঙ্ঘনকারী (ফিসক) বা অবিশ্বাসী (কাফের) বলে অভিযুক্ত করবে না এবং তার অভিযোগের দাবি অনুযায়ী সে যদি অনুরূপ না হয়, তাহলে তার দায় তাকেই বহন করতে হবে।’
হাদিসবিশারদ আবু জাহরাহ এ প্রসঙ্গে এক মন্তব্যে বলেন, কোনো ব্যক্তি সুস্পষ্ট প্রমাণ ছাড়া অপর কোনো ব্যক্তিকে ধর্ম অবমাননাকারী, মুরতাদ, কাফের ও ফাসিক বলে অভিযুক্ত করতে পারবে না এবং কেউ এরূপ করলে তাকেই অভিযোগের দায়ভার বহন করতে হবে। এর সুস্পষ্ট অর্থ যা আবু জাহরাহ উল্লেখ করেছেন, তা হলো ‘অভিযোগকারী মিথ্যা বললে সে নিজেই কাফের হয়ে যাবে।’
ইসলামে কাউকে কাফের বা তাকাফির বলা হলো মারাত্মক গুনাহের কাজ এবং অপরাধ। তাই কোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তিকে সুস্পষ্ট ভাষায় কাফের বলে অভিযুক্ত করলে অথবা এমন অভিযোগ করল যার অর্থ কাফের বলা বোঝায় : তাহলে তাকে তাজিরের অধীনে প্রতিরোধমূলক দণ্ড ভোগ করতে হবে এবং একজন উপযুক্ত বিচারক সেই শাস্তি নির্ধারণ করবেন।
বিষয়টি জটিলতা হওয়ার প্রেক্ষাপটে এ বিষয়ে ফকিহ ও ধর্মতাত্ত্বিকগণ অস্বাভাবিক ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত ও বিবৃতি দিয়েছেন। আবু জাহরাহ বিষয়টি সুরাহার জন্য নিয়মিত বিচারব্যবস্থার অধীনে একটি পৃথক বিচারসংক্রান্ত পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করেছেন এবং যিনি এ পদে অধিষ্ঠিত হবেন তিনি ধর্মত্যাগ, ধর্মের অবমাননা ও অবিশ্বাসের মতো বিভিন্ন বিষয়ে বিচারকার্য পরিচালনায় বিশেষ কর্তৃত্বের অধিকারী হবেন। কী ধরনের কথা উচ্চারণ ও কাজ করলে তা অবিশ্বাস, ধর্মের অবমাননা বা ধর্মত্যাগ করা বুঝাবে; তা নিরূপণের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হবে এ ধরনের সৃষ্ট আদালতের ওপর। তাই তড়িঘড়ি করে অপর ব্যক্তিকে অবিশ্বাসীর দোষারোপের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা প্রত্যেক ব্যক্তির অবশ্যই পরিহার করা উচিত।
কোনো ব্যক্তি যদি কাউকে অবিশ্বাসী, ধর্মের ক্ষেত্রে নবোদ্ভাবনকারী বা ধর্মত্যাগকারী ইত্যাদি বলে সন্দেহ করে তাহলে তার জন্য প্রধান করণীয় হবে কুরআনের হিসবাহর নীতির সত্যিকার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাকে সদুপদেশ প্রদান করা। কোনো ব্যক্তি নবোদ্ভাবন বা অবিশ্বাসের কোনো ঘটনা সংঘটিত হতে দেখতে পেলে তার কর্তব্য হবে সত্য প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে বিষয়টি কর্তৃপক্ষের হাতে ন্যস্ত করা। আল বাহনাসারি এ ব্যাপারে উপসংহারে লিখেছেন, প্রয়োজনীয় সাক্ষ্যপ্রমাণ এবং উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের বিচার ছাড়া অবিশ্বাস, ধর্মের অবমাননা বা ধর্মত্যাগের ব্যাপারে নিছক সন্দেহ অথবা অভিযোগের ভিত্তিতে কোনো ব্যক্তির ক্ষতি সাধন বা তাকে দুর্দশার শিকারে পরিণত করা যাবে না।
ভাষান্তর : সাজ্জাদুল ইসলাম
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা