২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ইসলামের সার্বজনীন বিধান

-

ইসলাম মানবজীবনের জন্য একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান, একটি পূর্ণাঙ্গ পথ ও পাথেয়। মানবসমাজকে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের দিকে পরিচালিত করার জন্য ইসলামী বিধানের প্রয়োগ ও অনুশীলন অনস্বীকার্য। বর্তমান বিশ্বে মানবসমাজের মধ্যে সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপন, নৈতিকতার উৎকর্ষ সাধন এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথাই সমাজ সচেতন, চিন্তাশীল ও বিবেকবান ব্যক্তিদের মুখে মুখে বেশি করে উচ্চারিত হচ্ছে। ইসলামই হলো সেই প্রত্যাশিত সমাজ ও উন্নত জীবন বোধের পতাকাবাহী বিধিবিধানের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার। প্রেম-প্রীতি, সাম্য-মৈত্রী ও সৌভ্রাতৃত্বের দলিত বাণীর আকর। ইসলামই হলো আধুনিকতার সমুজ্জ্বল, নৈতিকতার স্বর্ণালী পরশমণ্ডিত, মানবাধিকারের শাশ্বত সুন্দর নীতিকে উদ্ভাসিত এক অপূর্ব সুন্দর কল্যাণময়ী সমাজ বিনির্মাণের একমাত্র হাতিয়ার। মহান মাবুদের অফুরন্ত অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টির অমীয় ধারায় সিক্ত বিশ্ববাসীর জন্য একমাত্র পরিপূর্ণ জীবনবিধান আল্লাহর ভাষায় ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের ওপর আমার অনুগ্রহ পূর্ণ করে দিলাম ও ইসলামকে তোমাদের জন্য মনোনীত দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা হিসেবে সন্তুষ্টসহকারে প্রদান করলাম।’ (আল-মায়েদা : ৩)
‘ইলামের বিস্তার তরবারির জোরে ঘটেনি, ঘটেছে ধারাবাহিকভাবে বেশ কিছুসংখ্যক ওলি-আউলিয়া-ফকিরদের আন্তরিক গভীর ভালোবাসার জোরে।’ মি. গান্ধীর এই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি শোনা যায় ১৯৯০ সালে নরম্যান এন্ডারসনের লিখিত গ্রন্থের (ওংষধস রহ ঃযব গড়ফবৎহ ডড়ৎষফ : অ ঈযৎরংঃরধহ চবৎংঢ়ড়পঃরাব) প্রতি লাইনে। তিনি লিখেছেন, মুসলিম আমলের প্রথম শতকে ইসলামের অভাবনীয় বিস্তৃতির মূলে মুসলমানদের সুঠাম দৈহিক গঠন এবং আরব সৈনাবাহিনীর পরাক্রম, বিশেষ করে খালিদ বিন ওয়ালিদ ও অন্যান্য সামরিক প্রতিভার নেতৃত্ব কিছুটা দায়ী ছিল বটে, কিন্তু এর এই বিস্তৃতির মূল কারণ ছিল শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের মনে উন্নত জীবন দর্শনের আবেদন এবং তাদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলাম গ্রহণ। গ্রন্থের ৯৫-৯৬ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন : ‘মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এবং পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকায় মুসলমানদের প্রভাব ব্যাপকভিত্তিক হয়ে ওঠে প্রধানত বাণিজ্য এবং শান্তিপূর্ণ অনুপ্রবেশের ফলে।’
ইসলামী আদর্শমণ্ডিত প্রত্যাশিত সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আরো একটি শক্তিশালী বাধা হলো ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে ইসলামী বিধিবিধান থেকে দূরে সরে থাকার অপকৌশল। এ ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ গোটা মুসলিম মিল্লাত ও মুসিলম দেশগুলোর জন্য একটি চরম আত্মঘাতী মতবাদ। এটি ইসলামী চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত, ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের পরিপন্থী একটি ভ্রান্ত মতবাদ।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘হে ঈমানদারেরা! তোমরা ইসলাম ধর্মে পুরোপুরিভাবে প্রবেশ করো’। (সূরা বাকারা : ২০৮)
সম্প্র্রতি বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত সেকুলার কলামিস্ট অত্যন্ত সুনিপুণভাবে ইসলামী আদর্শ ও চেতনায় সমূলে আঘাত করার অভিপ্রায় ইসলামের শরিয়াহ আইন ও ইসলামী বিধিবিধান সম্পর্কে কিছু মনগড়া ব্যাখ্যা ও মতামত পেশ করেছেন, যা অত্যন্ত হাস্যকর ও স্ববিরোধিতায় পরিপূর্ণ। আদর্শিক দৃষ্টি বিভ্রাটের কারণেই বোধ করি তিনি কালের আয়নায় ইসলামের সঠিক চিত্র অবলোকন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি তার গল্পের নায়ক ফতে মোল্লার বক্তব্যের বরাত দিয়ে বলেনÑ ‘রাসূলুল্লাহ সা:-এর যুগে এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগে ও শরিয়াহ আইন বলে কিছু ছিল না। ইসলাম হচ্ছে রাসূল সা:-এর মারফত প্রেরিত আল্লাহর কিছু আদেশ-নির্দেশ, যা মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণের জন্য নির্দেশিত। তার সাথে তৎকালীন সমাজের জন্য প্রচলিত বিধিবিধানের কোনো সম্পর্ক নেই। এই বিধিবিধান যুগে যুগে সমাজ বদলের সাথে পরিবর্তনযোগ্য। কোনো এক সমাজের শাসনব্যবস্থা বা আইনকানুন ইসলামী ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গ নয়। এ ব্যাপারে মুসলমানদের প্রতি হজরত মুহাম্মদ সা:-এর সুস্পষ্ট নির্দেশ, ধর্মের মৌলিক আদর্শকে ধারণ করে ইজমা ও কিয়াসের (বিচার-বিবেচনা) মাধ্যমে সমাজ ও যুগের উপযোগী স্ন্দুর ও বাস্তব ব্যবস্থা নির্ধারণ করে সেই ব্যবস্থা দ্বারা চালিত হওয়া। (দৈনিক সমকাল : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৮)
এখানে লেখক ইসলামের দরদি সেজে সুকৌশলে ইসলামের গোড়ায় কুঠারাঘাত করেছেন। তিনি বলছেন, ইসলামে নাকি শরিয়াহ আইন বলে কিছু ছিল না। আবার ইসলাম হচ্ছে রাসূল সা:-এর মারফত প্রেরিত আল্লাহর কিছু আদেশ-নিষেধ। ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে যেমন চিকিৎসার ব্যাপারে ফর্মুলা দেয়া যায় না, তেমনি পত্রপত্রিকায় কলমবাজিতে পারদর্শী হয়ে গেলেই মনে হয় ইসলাম সম্পর্কে এ রকম উল্টাপাল্টা ফতোয়া দেয়া উচিত হবে না। ইসলামের আদেশ-নির্দেশ বা বিধিবিধান এক জিনিস এবং শরিয়াহ আইন আরেক জিনিস। এটি একটি উদ্ভট ও অভিনব ধারণা। শরিয়াহ বা শরিয়ত মানে হচ্ছে পদ্ধতি, পন্থা, বিধান ইত্যাদি। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইসলামের যেসব বিধিবিধান রয়েছে সেগুলোকেই শরিয়ত বা ইসলামের শরিয়াহ আইন বলা হয়। আল্লাহর প্রেরিত আদেশ-নিষেধ বা বিধিবিধানই মহানবী সা:-এর শরিয়ত এবং এগুলোই শরিয়াহ আইন। একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কী কী অপরাধ নির্মূলে সুস্পষ্ট দণ্ড বা বিধান রয়েছে, কী কী বিষয় হালাল, কী কী বিষয় হারাম, কী কী বিষয় ফরজ বা আবশ্যক ইত্যাদি ব্যাপারে ইসলামের সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। এগুলোতে ওই সময় মেনে চলা যেমন আবশ্যক ছিল, কিয়ামত পর্যন্তও তা আবশ্যক থাকবে। যেমনÑ লেখক চুরির বিধান বা ব্যাভিচারের শাস্তি বিধানের কথা বলেছেন যে, এগুলো ইসলামের বিধান নয়। এগুলো তৎকালীন সমাজের প্রচলিত কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত। রাসূল সা: এগুলো বাস্তবায়ন করেছেন এবং এসব বিধিবিধান সব ঈমানদারকে মেনে চলার জন্য আল-কুরআনে জোর তাগিদ বা নির্দেশ রয়েছে। অবশ্য ইসলাম নির্দিষ্ট কয়েকটি দণ্ড বা বিধান ছাড়া অন্যান্য অপরাধের ব্যাপারে শাস্তির বিধান হিসেবে যুগের প্রেক্ষাপটে সংশোধনের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচারকদের রায়ের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। তবে দণ্ডবিধি বা অর্থনৈতিক ব্যাপারে যেসব বিধান বা নির্দেশনা ইসলাম দিয়েছে, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক যাই বলা হোক না কেন সেগুলো প্রতিটি ঈমানদার ব্যক্তিকেই মেনে চলতে হবে। যেমনÑ সুদ হারাম, জাকাত দেয়া ফরজ এগুলো ইসলামের অর্থনৈতিক বিধান।
লেখক একই নিবন্ধের অন্যত্র বলেছেন ‘শরিয়াহর নামে চুরি করলে হাতকাটা বা ব্যভিচারের জন্য হত্যা করার বিধানের কথা ধরা যাক। এটা ইসলামের বিধান নয়।’
‘ইসলাম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ও মহানবী বলেননি। কেবল মুসলমানদের দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়ার নির্দেশ তার থাকলে তিনি ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের সমান নাগরিক অধিকার দিয়ে এবং মুসলমানদের সাথে একই উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত করে মদিনা চুক্তি করতেন না।’ (দৈনিক সমকাল : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৮)
মহানবী সা: নিজেই একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সুখী ও সমৃদ্ধ সমাজ উপহার দিয়ে গেলেন। আর আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে ইসলামে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করতে হলে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। সুতরাং জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলামের পূর্ণাঙ্গতাকে নতুন কোনো ফতোয়া দিয়ে আটকানো যাবে না। স্বয়ং আল কুরআন, হাদিসের বিশাল ভাণ্ডার এবং ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য এ কথায় চিরন্তন সাক্ষ্য দেয় যে, ইসলাম মানুষের সমাজ, রাষ্ট্র সবকিছুর পথপ্রদর্শক ও দিকনির্দেশক। ইসলাম যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সেখানে অন্যান্য ধর্মের লোকদের অস্তিত্ব থাকবে না এটি ইসলামের ওপর একটি জঘন্য মিথ্যাচার। বরং বাস্তবতা হলোÑ ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমরা সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে, তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে, তাদের ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় বিধিবিধান পালনের পূর্ণ নিরাপত্তা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেই করা হবে। সুতরাং ইসলামী রাষ্ট্র হলে সেটা গোঁড়ামি ও সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট হয়ে যাবে ইসলামের ওপর এরূপ অপবাদ চাপিয়ে দেয়া মোটেই উচিত হবে না।
আসলে ইসলাম সম্পর্কে চলমান এরূপ অজ্ঞতা ও বিমুখতাই আমাদের সমাজের বিভ্রান্তি ও অধগতির মূল কারণ। আজকে যে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে চিৎকার করা হচ্ছে, ইসলাম চৌদ্দ শ’ বছর আগে সে সব অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। ইসলাম নারীকে সম্মানের আসনে বসিয়ে তার যথাযথ অধিকার প্রাপ্তির বিধান করে দিয়েছে। ইসলাম মানুষের নৈতিক ও আত্মিক উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে তাকে রাষ্ট্র ও সমাজের একজন সৎ, যোগ্য ও বিশ্বস্ত উপাদান হিসেবে প্রস্তুত করতে চেয়েছে। এ লক্ষ্যে দৈহিক ও আর্থিক বিভিন্ন ইবাদত ও বিধিবিধানের ব্যবস্থা রেখেছে। এভাবে ইসলামের আত্মিক ও নৈতিক সংশোধন, পরকালীন জবাবদিহিতামূলক মনোভাব তৈরির পদ্ধতি এবং প্রায়োগিক ও আবশ্যকীয় বিধিবিধান অনুসরণের মাধ্যমেই সমাজ থেকে যাবতীয় অনাচার ও পাপাচার দূরীভূত করা সম্ভব। ইসলামের বিধিবিধানের যথার্থ প্রয়োগের মাধ্যমেই দূরীভূত করা সম্ভব বর্তমান সমাজের সবচেয়ে বড় অভিশাপ সন্ত্রাস ও দুর্নীতির কালো ছায়া। তাই যেকোনো গবেষক বা পর্যালোচক যদি ইসলামের মূল উৎস কুরআন-সুন্নাহর দিকে নজর দেন, ইসলামের তাত্ত্বিক দর্শনের দিকে দৃষ্টি দেন অথবা এর ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, নির্মোহ ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যদি ইসলামের ওপর গভীর অনুসন্ধানে মগ্ন হয়ে যান, তাহলে ইসলাম যে একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান, ইসলাম যে একটি কালজয়ী আদর্শ, সন্ত্রাস, জোরজবরদস্তি, বা সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকার যে ইসলামের অত্যুজ্জ্বল আলোকবর্তিকাকে স্পর্শ করতে পারেনি, ইসলামের মাধ্যমেই যে বর্তমান সমস্যাসঙ্কুুল সমাজের কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আনয়ন করে প্রত্যাশিত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব তা দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। থাকবে না কোনো সন্দেহ-সংশয় ও বিভ্রান্তির অপছায়া।
লেখক : অধ্যক্ষ, শাহজালাল কামিল মাদরাসা, সিলেট


আরো সংবাদ



premium cement