২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

অহঙ্কার পতন ডেকে আনে

-

অহঙ্কার পৃথিবীর প্রথম গুনাহ। আর এটি প্রথম সংঘটিত হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট কীট ইবলিশ কর্তৃক। অহঙ্কারের মাধ্যমেই শয়তান সর্বপ্রথম গুনাহর খাতায় নাম লিখিয়েছিল এবং এটিই সর্বপ্রথম আল্লাহর হুকুমকে মানতে অবাধ্য করেছিল। সূরা বাকারায় আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি ফেরেশতাদের বলেছিলাম : আদমকে সেজদা করো। সবাই সেজদা করল। কেবল ইবলিশ করল না। সে অস্বীকার ও অহঙ্কার করল। সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।’ সূরা আরাফে বলা হয়েছে, ইবলিশ বলল ‘আমি তাঁর চেয়ে উত্তম, আপনি আমাকে আগুন থেকে এবং তাঁকে (আদমকে) মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন।’ অর্থাৎ তার মধ্যে বর্ণবাদের অহঙ্কার ও বিদ্বেষ দানা বেঁধে উঠেছিল। ফলে সে-ই পৃথিবীর প্রথম নিকৃষ্ট কীট, যে আল্লাহর আদেশকে অমান্য করল এবং তার লানত নিয়ে কেয়ামত পর্যন্ত তাকে বেঁচে থাকতে হবে। যুগে যুগে এ তাগুতের অনুসারীরাই অহঙ্কারী ছিল। এদের কেউ কেউ ক্ষমতার দাপটে, কেউ বা আবার ধন-দৌলতের আধিক্যে অহঙ্কারী ছিল। এদের মধ্যে ফিরাউন ও কারুন অন্যতম। আল্লাহ তায়ালা এসব অহঙ্কারীকে ধ্বংস করে দেন। এ ছাড়া আল কুরআনে বর্ণিত বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ধ্বংসের কারণগুলোর মধ্যে অহঙ্কার একটি অন্যতম কারণ ছিল। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কত জনপদ আমি ধ্বংস করে দিয়েছি। তাদের ওপর আমার আজাব অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রাতের বেলায় অথবা দিনের বেলা যখন তারা বিশ্রামরত ছিল। আর যখন আমার আজাব তাদের ওপর আপতিত হয়েছিল, তখন তাদের মুখে এ ছাড়া আর কোনো কথাই ছিল না যে, ‘সত্যিই আমরা জালেম ছিলাম।’ (সূরা আল আরাফ: ৪-৫) এখানে জালেম মানে অহঙ্কারী ছিল।
কুরআন ও হাদিসের অসংখ্য জায়গায় গর্ব-অহঙ্কারের ভয়াবহ পরিণাম ও পরিণতির কথা বিবৃত হয়েছে এবং অত্যন্ত কঠিন ভাষায় হারামও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। ইমাম আযযাহাবি র: তাঁর ‘কিতাবুল কাবায়ির’ এ এটিকে কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অহঙ্কার শুধু একটি কবিরা গুনাহই নয়, বরং এটি আরো অনেক কবিরা গুনাহের জন্মদাতা। কারণ এটি মানুষকে সত্য উপলব্ধিতে বাধা দেয় এবং তাদের অন্ধকারের যাত্রী বানায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এক ইলাহই তোমাদের আল্লাহ। কিন্তু যারা আখিরাত মানে না তাদের অন্তর সত্যবিমুখ এবং তারা অহঙ্কারে ডুবে গেছে।’ (সূরা নাহল : ২২) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘কোনো প্রকার অধিকার ছাড়াই যারা পৃথিবীতে অহঙ্কার করে বেড়ায়, শিগগিরই আমার নিদর্শনগুলো থেকে আমি তাদের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেবো। তারা আমার কোনো নিদর্শন দেখলেও তার প্রতি ঈমান আনবে না। তাদের সামনে যদি সোজা পথ এসে যায়, তাহলেও তারা তা গ্রহণ করবে না। আর যদি বাঁকা পথ দেখতে পায়, তাহলে তার ওপর চলতে শুরু করবে।’(সূরা আ’রাফ : ১৪৬)
অহঙ্কার মানে নিজেকে আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করা, অন্যদেরকে নিজের তুলনায় ক্ষুদ্র ও অধম জ্ঞান করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে তাঁর অবাধ্য হওয়া ও আদেশ অমান্য করাÑ এ সবই অহঙ্কারের লক্ষণ ও তার আওতাভুক্ত। (কবিরা গুনাহ-ইমাম আযযাহাবি র:) অহঙ্কার গোপন ও প্রকাশ্য দুই ধরনের হয়ে থাকে। গোপন অহঙ্কার মনে সৃষ্টি হয় আর প্রকাশ্য অহঙ্কার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা প্রকাশ পায়। গোপন অহঙ্কারী নিজেকে অন্য সব অহঙ্কারীর চেয়েও নিজেকে বড় মনে করে। এটা তার ধারণায় বদ্বমূল হয়, অবশেষে এটি তার বিশ্বাসে পরিণত হয়। ফলে নিজেকে খুব সম্মানিত মনে করে এবং একসময় তা তার বাস্তব চরিত্রে প্রকাশ পেতে শুরু করে। গোপন অহঙ্কার সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, তাদের কাছে আসা যুক্তি প্রমাণ ছাড়া আল্লাহর নিদর্শনগুলোর ব্যাপারে ঝগড়া করছে তাদের অন্তর অহঙ্কারে ভরা। কিন্তু তারা যে বড়ত্বের অহঙ্কার করে তারা তার ধারেও ঘেঁষতে পারবে না।’ (সূরা মুমিন : ৫৬) এদের শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এভাবে আল্লাহ প্রত্যেক অহঙ্কারী ও স্বেচ্ছাচারীর অন্তরে মোহর লাগিয়ে দেন।’ (সূরা মুমিন : ৩৫) প্রকাশ্য অহঙ্কারের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অহঙ্কারবশত তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং জমিনে গর্বসহকারে পদচারণা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না। চাল-চলনে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করো এবং কণ্ঠস্বর নিচু করো।’ (সূরা লোকমান : ১৮-১৯) ‘পৃথিবীতে দাম্ভিকতাসহকারে চলো না। নিশ্চয়ই তুমি পদাঘাতে ভূপৃষ্ঠ বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না। এ সবের মধ্যে যেগুলো মন্দ কাজ, সেগুলো তোমার রবের কাছে অপছন্দনীয়।’ (বনি ইসরাইল : ৩৭-৩৮)
অহঙ্কারীর শাস্তি সম্পর্কে উল্লিখিত আয়াত ছাড়াও আরো একাধিক আয়াতে কঠিন বর্ণনা রয়েছে। অহঙ্কারী সম্পর্কে রাসূল সা:-এর অসংখ্য হাদিসও রয়েছে। রাসূল সা: বলেছেন, অহঙ্কারী স্বৈরাচারীদের কেয়ামতের দিন ক্ষুদ্র কণার আকৃতিতে ওঠানো হবে। লোকেরা তাঁদেরকে পায়ের তলায় পিষ্ট করবে এবং চারদিক থেকে তাদের ওপর কেবল লাঞ্ছনা ও অপমানই আসতে থাকবে। তাদেরকে জাহান্নামের বোলাস নামক কারাগারে নিয়ে যাওয়া হবে। তাদের মাথার ওপর আগুন জ্বলতে থাকবে এবং তাদেরকে জাহান্নামবাসীর মলমূত্র, ঘাম, কাশি ইত্যাদি খেতে দেয়া হবে।’ (সুনানে নাসায়ি, জামে আত তিরমিজি) রাসূল সা: আরো বলেন, ‘যার অন্তরে কণা পরিমাণও অহঙ্কার আছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (সহিহ মুসলিম)
গর্ব-অহঙ্কার মূলত আল্লাহর অধিকার। মানুষ গর্ব-অহঙ্কার করা মানে আল্লাহর অধিকারে ভাগ বসাল। সুতরাং সে শিরক করল। এ অধিকারে মানুষ কিসের জোরে বা বলে অহঙ্কার করবে? যেখানে সামান্য একটি ব্যাঙ লাফ দিলেও সে ভয়ে দৌড়ে পালাতে শুরু করে। আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে মানুষই সবচেয়ে দুর্বল প্রাণী। তার মনে রাখা প্রয়োজন, তাকে তার বাবার পৃষ্ঠদেশ থেকে নেমে আসা সামান্য এক ফোঁটা পানি থেকে বা সামান্য একটি শুক্রকীট থেকে তৈরি করা হয়েছে। সুতরাং তার অহঙ্কার করার কোনো অধিকার নেই। আশরাফুল মাখলুকাত বলে আল্লাহ তায়ালা দয়া করে সমস্ত সৃষ্টিকে তার অধীন করে দিয়েছেন এবং তাকে সৃষ্টির সেরা মর্যাদা দিয়েছেন বটে। তথাপি সব সৃষ্টির কাছে সে সামান্যই একটি দুর্বল প্রাণী। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অহঙ্কার আমার পোশাক। এ পোশাক যে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চেষ্টা করে, তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব।’ (সহিহ মুসলিম)
অথচ এ অহঙ্কারই আজ বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে আমাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতীয় জীবনে প্রবেশ করেছে। যথাÑ বঙ্ক, বর্ণ, ভাষা, দেশ, জাতীয়তা ও সম্পদের প্রাচুর্যের ওপর ভর করে অহঙ্কার আমাদের মাতিয়ে তুলেছে। যদিও এগুলো আল্লাহরই সৃষ্টি। তথাপি এগুলো কোনো মর্যাদার মানদণ্ড বা কোনো মাপকাঠি নয়। বরং এগুলো আল্লাহ দিয়েছেন যাতে মানুষ পরস্পরকে চিনতে পারে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মানব জাতি, আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তার পর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দিয়েছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি অধিক সম্মানিত, তোমাদের মধ্যে যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সব কিছু জানেন ও খবর রাখেন।’ (সূরা আল হুজরাত : ১৩)
অহঙ্কারীর কিছু বৈশিষ্ট্য হলো : সে নিজে যা পছন্দ করে, অন্যকে তা পছন্দ করতে দেয় না। সাধারণত সে হিংসা-বিদ্বেষপরায়ণ হয়। কোনো উপদেশকারীর উপদেশ গ্রহণ করতে পারে না। বরং উল্টো তার ঠাট্টা-বিদ্রুপে স্বীকার হয়। শিক্ষিত ব্যক্তির শিক্ষাও সে গ্রহণ করে না। মানুষের সাথে কথা বলা ও চলার সময় হিংসা-বিদ্বেষ, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও গর্ব-অহঙ্কারের ভাব প্রকাশ করে। নেতৃত্বের কথা বা আদেশের কোনো পরোয়া বা ভ্রুক্ষেপই করে না। মনে হয় এগুলো তার জন্য প্রযোজ্য নয় বা সে তার চেয়েও বেশি বা আরো ভালো জানে। অন্যের কথা শোনার চেয়ে সে-ই শুধু বলতে চায়। প্রথমে কথা বলা, নেতৃত্ব ও মান-সম্মান না পেলে অসন্তুষ্ট হয়।
অহঙ্কারীরা শিক্ষা গ্রহণ করুন : বংশ কোনো মর্যাদার প্রতীক নয়, বরং তাকওয়া সব মর্যাদার প্রতীক। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি অধিক সম্মানিত, তোমাদের মধ্যে যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে।’ (সূরা আল হুজরাত : ১৩) ধনী কারুনের সাথে আল্লাহর আচরণ থেকে শিক্ষা নেবেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি তাকেসহ তার ঘরবাড়ি মাটির নিচে চাপা দিয়ে দিয়েছি। আল্লাহর মোকাবেলায় তাকে সাহায্য করার জন্য আর কেউ এগিয়ে আসেনি এবং সে বিজয়ীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।’ (সূরা কাসাস : ৮১) অহঙ্কারী শাসক, মন্ত্রী ও দলের প্রধানদের উচিত ফিরাউন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। আল্লাহ এ ক্ষমতাধর অহঙ্কারী শাসককে সমুদ্রে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। আলেম, জ্ঞানী ও বুজুর্গদের ইসরাইলের বালআম-বাউরসহ অন্য আলেমদের পরিণতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যাদেরকে তাঁররাত দেয়া হয়েছিল, পরে তারা তাঁর অনুসরণ করেনি, তাদের উদাহরণ হচ্ছে সেই গাধার মতো যে কিতাব বহন করে বেড়ায়।’ (সূরা জুমআ : ৫) অন্যান্য অহঙ্কারীকে দেখা গেছে যে, আল্লাহ তায়ালা তার জীবিতাবস্থায় কোনো না কোনো লজ্জাকর বিষয় চাপিয়ে দিয়ে অপমানিত করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘হে রাসূল! তুমি বলো, হে আল্লাহ তুমি সাম্রাজ্যের মালিক, তুমি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দান করো, যার থেকে ইচ্ছা রাজত্ব ছিনিয়ে নাও, যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করো, যাকে ইচ্ছা অপমানিত করো, তবু তোমরা ক্ষমতার হাতই শ্রেষ্ঠ, নিশ্চয়ই তুমি প্রত্যেকের ওপর শক্তিশালী।’ (সূরা আল ইমরান)
সর্বোপরি অহঙ্কার থেকে বাঁচতে হলে নিয়মিত কুরআন ও হাদিস বুঝে পড়তে হবে। বিশেষ করে অহঙ্কারবিরোধী এবং অহঙ্কারীর শাস্তি সম্পর্কিত আয়াত ও রাসূল সা:-এর হাদিসগুলো বারবার পড়তে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের পৃথিবীর প্রথম গুনাহ ও ইবলিশের প্রথম অপরাধের হোতা অহঙ্কার থেকে রক্ষা করুন।
লেখক : আলেম ও ব্যাংকার

 


আরো সংবাদ



premium cement