জুমার বয়ানের গুরুত্ব
- মুনীরুল ইসলাম
- ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০
জুমার দিন এবং জুমার নামাজ অনেক গুরুত্ব ও তাৎপর্যময়। এ দিনটি মুসলমানদের সাপ্তাহিক সম্মিলনের দিন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পাঞ্জেগানা মসজিদ, বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত কিংবা দোকানপাটে পড়া গেলেও জুমার নামাজ জুমা মসজিদ ছাড়া আদায় করা যায় না। তাই এ দিন মুসলিম বিশ্বের মসজিদে মসজিদে ধনী-গরিব, ছোট-বড় সব শ্রেণীর মুসলমানের সমাবেশ ঘটে।
জুমার নামাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো খুতবা। আরব দেশগুলোতে শুধু আরবি ভাষায় খুতবা দেয়া হয়। আরবিতে খুতবা পড়া ও শোনা ওয়াজিব বা অবশ্য পালনীয়। তাই এটা কখনো পরিত্যাগ করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ সা:, খুলাফায়ে রাশেদিন, তাবেইন, তাবে-তাবেইনের খুতবার ওপর ভিত্তি করে ফুকাহায়ে কেরাম তথা ইসলামী আইনশাস্ত্রবিদেরা বলেন, খুতবায় নিম্নের বিষয়গুলো থাকা সুন্নত। যথা : ১. হামদ বা আল্লাহর প্রশংসা; ২. সানা বা রাসূলের প্রশংসা; ৩. শাহাদাতাইন তথা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ সা: আল্লাহর বান্দা ও রাসূলÑ এ দু’টি বিষয়ের সাক্ষ্য প্রদান; ৪. রাসূলুল্লাহ সা:-এর ওপর দরুদ; ৫. তাকওয়ার আদেশমূলক কুরআনের আয়াত; ৬. আরবি ভাষায় ওয়াজ-নসিহত; ৭. দুই খুতবার মাঝে বসা; ৮. দ্বিতীয় খুতবায় পুনরায় হামদ, সানা, শাহাদাতাইন ও দরুদ পাঠ করা; ৯. বিশ্ব মুসলিমের জন্য দোয়া করা; ১০. উভয় খুতবা নামাজের তুলনায় সংক্ষিপ্ত হওয়া ইত্যাদি। আমাদের বাংলাদেশসহ অন্য অনারব দেশগুলোতে আরবি মূল খুতবার আগে মুসল্লিদের বোঝার জন্য নিজ নিজ মাতৃভাষায়ও বয়ান করা হয়। সাধারণত আরবি খুতবার বিষয়বস্তুর আলোকেই ভাষান্তর বা ভাবান্তর করা হয়।
জুমার নামাজের আগে বয়ান করা সাহাবায়ে কেরাম রা:-এর যুগেও ছিল। এটা তাঁদের আমল দ্বারা প্রমাণিত। তাই এতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। এ বয়ান খতিব বা অন্য কেউ করতে পারেন। আসেম রহ: তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, জুমার দিন হজরত আবু হুরায়রা রা: জুতা খুলে মিম্বরের পাশে দাঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহ সা:-এর বিভিন্ন বাণী পেশ করতেন। (মুসতাদরাকে হাকিম : ১/১৯০)
বয়ান তথা দাওয়াতের গুরুত্ব তুলে ধরে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা মানুষকে কল্যাণের পথে আহ্বান করবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অন্যায় কাজে বাধা দান করবে। তারাই হলো সফলকাম।’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৪) এভাবে দ্বীনের পথে দাওয়াত দানকারীদের অনুপ্রাণিত করে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘ওই ব্যক্তির চেয়ে আর কার কথা উত্তম হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করে এবং নিজেও সৎকাজ করে, আর বলেÑ আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা হা-মিম সিজদাহ : ৩৩) বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে মহানবী সা: বলেন, ‘তোমরা একটি আয়াত হলেও আমার পক্ষ থেকে পৌঁছে দাও।’ (তিরমিজি)
জুমার এই বয়ান হতে পারে অপরাধ ও কুসংস্কারমুক্ত ইসলামী আদর্শ সমাজ গড়ার মাধ্যম। সে জন্য প্রয়োজন খতিব, মুসল্লি বিশেষ করে মহল্লাবাসী ও মসজিদ কমিটির ঐকান্তিক ইচ্ছা, চেষ্টা ও পারস্পরিক সহযোগিতা। কমিটির লোকজন একজন হকপন্থী যোগ্য আলেমকে খতিব নিয়োগ দেবেন, যিনি কুরআন-হাদিসের আলোকে ইসলাম, সমাজ ও মানুষের অসঙ্গতিগুলো প্রতি জুমায় একটি একটি করে তুলে ধরবেন। যেমনÑ সুদ, ঘুষ, যৌতুক প্রথা, ইভটিজিং, নারী নির্যাতন, কুসংস্কার, মাদকাসক্তি, যুবসমাজের অধঃপতন, ইসলাম ও দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমকালীন প্রসঙ্গ ইত্যাদি। মক্কা শরিফের মসজিদে হারাম এবং মদিনা শরিফের মসজিদে নববীর জুমার খুতবায়ও সমকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এ ছাড়া কুরআন-হাদিসের আলোকে দুনিয়ার জীবন, পরকালের জীবন, জান্নাতের শান্তি, জাহান্নামের শাস্তি ইত্যাদি বিষয় তো আলোচনা করবেনই। মোট কথা, খতিব প্রচলিত নিয়মে আলোচনার নির্দিষ্ট বিষয়ে না থেকে ইসলামের সার্বিক বিষয় পর্যায়ক্রমে মুসল্লিদের মাঝে তুলে ধরবেন। এ ক্ষেত্রে মুসল্লিরাও আগেভাগে মসজিদে গিয়ে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এভাবে প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা শুনতে শুনতে মুসল্লিদের ইসলাম সম্পর্কে জানার পরিধি বাড়বে। ইসলাম ও সমাজের অসঙ্গতিগুলো দূর হতে থাকবে।
জুমার আজানের পর জুমার নামাজ ছাড়া অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আর জুমার দিন জুমার নামাজে আগেভাগে হাজির হওয়া এবং মনোযোগ সহকারে জুমার বয়ান ও খুতবা শোনার বিশেষ গুরুত্ব ও ফজিলতের কথা বলা হয়েছে। হাদিসের বর্ণনায় আছে, জুমার জামাতের সময় মসজিদের দ্বারদেশে রহমতের ফেরেশতারা অবস্থান গ্রহণ করে কে কখন হাজির হচ্ছে তা লক্ষ করেন। যারা নিতান্ত বিনয়, নম্রতা ও বিশেষ মনোযোগের সাথে জুমায় হাজিরা দেন, তাদের নাম রহমতপ্রাপ্ত বান্দাদের তালিকায় লিখে রাখেন। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে শান্তির একটি আবহ সৃষ্টি হয়। এতে ইবাদতে মনোনিবেশ বৃদ্ধি পায়।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ইউসুফ রা: ও আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন ফরজ গোসলের মতো গোসল করে নামাজের জন্য আসে, সে যেন একটি উট কুরবানি করল। যে ব্যক্তি দ্বিতীয় পর্যায়ে এলো, সে যেন একটি গাভী কুরবানি করল। যে ব্যক্তি তৃতীয় পর্যায়ে এলো, সে যেন একটি শিংবিশিষ্ট দুম্বা কুরবানি করল। যে ব্যক্তি চতুর্থ পর্যায়ে এলো, সে যেন একটি মুরগি কুরবানি করল। যে ব্যক্তি পঞ্চম পর্যায়ে এলো, সে যেন একটি ডিম কুরবানি করল। পরে ইমাম যখন খুতবা দেয়ার জন্য বের হয়, তখন ফেরেশতারা জিকির শোনার জন্য হাজির হয়ে থাকেন।’ (বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি)
কিন্তু অনেক মসজিদে মুসল্লিরা সময়ক্ষেপণ করে মসজিদে এসে থাকেন, ফলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও খতিব যথাসময়ে বয়ান শুরু করতে পারেন না, কিংবা মোটেও বয়ান করা হয়ে ওঠে না।
পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, দেশের বেশির ভাগ মসজিদেই খতিব স্বাধীনভাবে কুরআন-হাদিসের কথা বলতে পারেন না। সে জন্য তাদের ওপর বাধা ও চাপ আসে। সব মতাদর্শের ওপর ইসলামী মতাদর্শকে প্রাধান্য দিয়ে স্বাধীন আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করা এলাকাবাসীর ঈমানি দায়িত্ব।
আবার কোনো কোনো মসজিদে বিশেষ করে মফস্বলের মসজিদে বলতে গেলে বয়ানই হয় না। হয়তো খতিব সেভাবে কথা বলতে অভ্যস্ত নন, অথবা খতিব-মুসল্লি কেউই এ ব্যাপারে গুরুত্ব দেন না। মুসল্লিরা অযথা বসে থেকে গল্প-গুজব করে সময় নষ্ট করেন। আর এভাবেই বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে। এমনটি করা মোটেও উচিত হচ্ছে না। অথচ দেখা গেছে, ওই মসজিদগুলোতেই মাহফিলের নামে প্রতি বছর লাখ টাকা খরচ করা হয়ে থাকে। একেকজন বক্তাকে ৩০-৩৫ হাজার টাকা করে হাদিয়া দিয়ে এনে ওয়াজ করাতে পারলে, ভালো সম্মানী দিয়ে একজন ইমাম-খতিব কেন নিয়োগ দেয়া যাবে না? মাহফিলে তো শুধু একদিন ওয়াজ শোনা যায়, আর খতিবের মাধ্যমে শোনা যাবে প্রতি সপ্তাহে। বাস্তবতা হলো, মাহফিল থেকে জুমার নামাজপূর্ব বয়ান অনেক ফলপ্রসূ। কারণ মাহফিলে সাধারণত এক শ্রেণীর ধার্মিক মুসলমানÑ যারা ইসলাম সম্পর্কে মোটামুটি অবগত তারাই গিয়ে থাকেন। আর জুমার নামাজ আদায় করতে সমাজের উঁচু-নীচু, ধনী-গরিব, বৃদ্ধ-যুবক, শিশু-কিশোর সর্বস্তরের মুসলমান হাজির হন। এ জন্য তাদের কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছানো আরো বেশি জরুরি এবং সহজ।
আলহামদুলিল্লাহ, দেশের কিছু মসজিদে বিশেষ করে রাজধানী, জেলা ও থানা শহরের বিভিন্ন মসজিদে একদল যোগ্য তরুণ আলেম-খতিব বয়ানের এই উপকারী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা বিভিন্ন প্রতিকূলতা এড়িয়ে এই ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। সমাজের সাধারণ মানুষ এর মাধ্যমে অনেক উপকৃত হচ্ছেন। মুসল্লিদেরও তারা সেভাবে গড়ে তুলেছেন।
আমরাও যদি সমাজ বদলের এই মিছিলে শামিল হতে চাই, তা হলে মুসল্লিদের সাথে পরামর্শ করে বয়ানের সময় ঠিক করে নেয়া যায়। সহজ পদ্ধতি হলো, প্রথম আজানের পর বয়ান শুরু করবেন, মুসল্লিরা এসে নীরবতার সাথে বয়ান শুনবেন। খুতবার ১০ মিনিট আগে তা শেষ করে মুসল্লিদের সুন্নত পড়ার সুযোগ দেবেন। এরপর খতিব আজানের পর আরবি ভাষায় দু’টি খুতবা দিয়ে সাথে সাথে নামাজ পড়াবেন। (ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ১২/৩৮৬-৩৯২)
ইসলামের আলোকে আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে দেশের প্রতিটি জুমা মসজিদে ইলম ও আমলদার সহি আকিদার যোগ্য আলোচক খতিব নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন এবং খতিবদেরও সমাজের চাহিদা অনুযায়ী যুগোপযোগী বয়ান করা কর্তব্য।
লেখক : তরুণ আলেম
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা