বিচারকের মানসিকতার দিক
- মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
- ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০
ইসলাম এমন একটি জীবন দর্শন যে, এর সব কর্মকাণ্ডে মানবিক মূল্যবোধ প্রাধান্য পায়। ইসলামে সব কিছুর ওপর মানবিক মূল্যবোধের স্থান। ইসলামী আইন এবং বিচারের ক্ষেত্রেও তা সমানভাবে প্রযোজ্য। মানবতা ও মনুষত্ব ভূলুণ্ঠিত হয় এমন কোনো আইন ইসলামে নেই। বরং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণ বিবেচনা করে মহান আল্লাহ আইনগুলো প্রণয়ন করেছেন। ইসলামে এমন কোনো আইন নেই, যার মধ্যে মানবিকতার দিক উপেক্ষিত। এমনিভাবে ইসলামে বিচারব্যবস্থায়ও মানবতাকে সবার ওপর স্থান দেয়া হয়েছে। ইসলামে বিচার-ফয়সালার ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সমাজে সুবিচার না থাকলে বিভিন্ন ধরনের অনাচার, দুরাচার, বাড়াবাড়ি, অসন্তোষ, আইন অমান্যের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে। সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলাম মানুষকে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করে। বর্তমানে বিচারের ক্ষেত্রে যেসব দুরাচার ও অনাচার সংঘটিত হচ্ছে এর প্রত্যেকটির ব্যাপারে আগেই ইসলাম মানুষকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। বিচারে ভালো ব্যক্তিকেই ইসলাম সত্যিকারের ভালো লোক বলে আখ্যায়িত করেছে। বাংলাদেশে আইন এবং বিচার কার্যকর করার ক্ষেত্রে অনেক সময় অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জন্ম দেয়া হয়। এতে বিচারের মাধ্যমে মানুষের প্রতি তথা মানবতার প্রতি চরম অবিচার করা হয়। বাংলাদেশে প্রচারমাধ্যমের বদৌলতে জনগণ মাঝে মধ্যে এসব জানতে পারে। যেমনÑ মিথ্যা মামলা, সাজানো মামলা, সংশ্লিষ্ট লোককে অভিযুক্ত না করে নিরপরাধ ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা, মিথ্যা সাক্ষী বানানো, আইন ও বিচারকে রাজনীতি দিয়ে প্রভাবিত করা, দলীয় বিবেচনায় বিচারপতি নিয়োগ, বিচারপতিদের অবমাননা করা, জামিন প্রদানে নিরপেক্ষতা বিসর্জন, ঘুষ গ্রহণ, লঘু দণ্ডে বড় শাস্তি এবং গুরু দণ্ডে ছোট শাস্তি, রিমান্ডের নামে অমানবিক নির্যাতন ইত্যাদি। এ প্রবন্ধে বিচারকের জন্য পালনীয় দিকগুলো আলোচনা করা হয়েছে।
ইসলামী আইন ও বিচারের মতো বিচারককেও এখানে কিছু মানবিক দিকের প্রতি নজর রাখতে হয়। ইসলামী আইন ও বিচার বাস্তবায়নে কোনো ধরনের প্রভাবে প্রভাবিত হওয়া থেকে মহান আল্লাহ মানুষকে সতর্ক করে দিয়েছেন। আল-কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর বিধান কার্যকরকরণে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদের প্রভাবান্বিত না করে, যদি তোমরা আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাসী হও।’ আল-কুরআনের ভাষ্য মতে, প্রভাবান্বিত না হওয়া শুধু মানবিক দায়িত্বই নয়, বরং এটি ঈমানি দায়িত্ব।
ইসলামী মূল্যবোধে বিচারককে কিছু নিয়ম মানতে হয়। রায় দেয়ার সময় তাকে মানসিক ভারসাম্য হারালে চলবে না। বিশেষত ক্ষুব্ধ অবস্থায় করা যাবে না। তা হলে অনাকাক্সিক্ষত ও অপ্রত্যাশিত রায় হয়ে যেতে পারে। মানুষ সুবিচার নাও পেতে পারে। রাসূলুল্লাহ সা: এ প্রসঙ্গটিও বাদ দেননি। তিনি বলেন, ‘এমতাবস্থায় তুমি দু’পক্ষের মধ্যে রায় দিও না যে, তখন তুমি ক্রোধান্বিত।’ বিচার-ফায়সালা একটি স্পর্শকাতর বিষয়। বিচারকের সামান্য অমনোযোগের ফলে যথাযথ রায় নাও হতে পারে। এ জন্য বিচারকদের ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হয়। বিচারকালীন মেজাজের ভারসাম্য রক্ষার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ক্রোধাবস্থায় দু’পক্ষের মধ্যে বিচার করা বিচারক বা কাজির জন্য শোভনীয় নয়।’ আল্লাহভীতি মানুষের মধ্যে বিভিন্নভাবে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে থাকে। বিচার-ফায়সালায় মহান আল্লাহকে ভয় করে সিদ্ধান্ত দিতে হয়। তা হলে অবিচারের সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত কম থাকে।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তুমি যখন তোমার বিচারের সময় রায় দেবে, তখন আল্লাহকে ভয় করবে।’ সমাজে যেসব কারণে রক্তপাত সংঘটিত হয়; তার মধ্যে একটি হলো সুবিচারের অনুপস্থিতি। কেউ সুবিচার না পেলে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যেকোনো অঘটন ঘটিয়ে দিতে পারে। এ জন্য যেকোনো মূল্যে সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য রাসূলুল্লাহ সা: উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘কোনো জাতির মধ্যে যদি সুবিচার করা না হয়; তা হলে তাদের মধ্যে রক্তারক্তি ছড়িয়ে পড়ে।’ আজকাল অর্থের বিনিময়ে রায় পাল্টানোর কথা শোনা যায়, যা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। বিচারের ক্ষেত্রে তা ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনে। রাসূলুল্লাহ সা: এ ব্যাপারেও সাবধান বাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘বিচারে ঘুষখোর ও ঘুষদাতাকে আল্লাহ লানত করেছেন।’ স্বজনপ্রীতি ও দলপ্রীতির কারণে অনেক সময় বিচারক নিয়োগে অন্যায়ের আশ্রয় নেয়া হয়। অপেক্ষাকৃত যোগ্য ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে অযোগ্য ব্যক্তিকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়। বিচারালয়ে নৈরাজ্য দেখা যায়। বিচারক নিয়োগে সততা ও অভিজ্ঞতা বিবেচনা করা উচিত। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘অভিজ্ঞতা ছাড়া কেউ বিচারক হতে পারে না।’
ইসলামে বিচার-ফায়সালার ব্যাপারটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, রাসূল সা:-এর মতো মহান ব্যক্তিত্বও দোয়ার মধ্যে ভুল বিচার করা থেকে পানাহ চাইতেন। জনৈক সাহাবি রা: বলেন, ‘মহানবী সা: ভুল বিচার করা থেকে পানাহ চাইতেন।’ বাংলাদেশে প্রায়ই পত্রিকায় দেখা যায়, ভুল রায়ে নিরপরাধ লোক বহু বছর জেল খাটছে। ক্রোধ ও রাগের বলগাহীন অপব্যবহার বহু অনিষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক নির্দয় ও অত্যাচারমূলক কর্মকাণ্ড মানুষ ক্রোধ ও রাগের কারণে করে ফেলে। কিন্তু পরবর্তীতে এর কারণে অনেক ক্ষেত্রে লজ্জিত ও অবজ্ঞার পাত্রে পরিণত হতে হয়। সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটি হয় তা হলোÑ যার বিরুদ্ধে রায় যায়, তার মানবিক অধিকার ক্ষুণœ হয় চরমভাবে, যা তাকে কখনো ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। তাই বিচারকের জন্য উচিত ক্রোধের সময় নিজেকে সংবরণ করা এবং অকারণে রাগ ও ক্রোধ প্রকাশ না করা। ক্রোধের মতো ক্ষতিকর ও অমানবিক বৈশিষ্ট্য থেকে মানুষকে বিরত রাখার জন্য মহানবী সা: সুন্দর একটি হাদিস বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তি বীর নয়, যে অন্যকে ধরাশায়ী করতে পারে। বরং সেই প্রকৃত বীর, যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।’ রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেছেন, ‘গোস্বা শয়তানের তরফ থেকে আসে। শয়তান আগুনের তৈরি। আর আগুনকে পানি ঠাণ্ডা করে। যদি কেউ গোস্বা হয়, তবে তার উচিত অজু করে নেয়া।’
শয়তানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তাড়াহুড়া করা। তাড়াহুড়ার মাধ্যমে অনেক সময় এমন রায় হয়ে যায় যে, সত্যিকারের ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হয় না। এ জন্য বিচারকদের ঠাণ্ডা মাথায় রায় দিতে হবে। অন্যথায় মানবতা ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়বে। মহানবী সা: এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ধীরস্থিরতা আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর তড়িঘড়ি (অস্থিরতা) হলো শয়তানের পক্ষ থেকে।’
পরিশেষে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ইসলামী আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে মানবিক দিক প্রাধান্যযোগ্য। যেহেতু ইসলাম, নবী, আসমানি কিতাব, হাদিসসহ সব কিছু মানুষের কল্যাণের জন্য, তাই এতে মানুষের অধিকার ও সহজাত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ইসলামী আইন ও বিচারব্যবস্থা যেমনিভাবে অতিমাত্রায় মানবিক, তেমনি সাধারণ আইনের প্রয়োগেও মানবিক দিকটিকে ইসলাম সমান গুরুত্ব দিয়েছে। অতএব বিচারব্যবস্থায় প্রচলিত অনিয়ম, অবিচার, অনাচার, হয়রানি, স্বজনপ্রীতি, নিয়মবহির্র্ভূত ব্যাপারগুলো দূরীকরণে ইসলামের শিক্ষা প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই। আইন প্রয়োগে এবং বিচার কার্যকরণে মানুষের সর্বোচ্চ স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হবে। অন্যথায় বিচারালয় শেষ আশ্রয়স্থল হওয়ার পরিবর্তে নিপীড়নের কেন্দ্রে পরিণত হবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা