২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মানবজীবনে সিরাতে রাসূলুল্লাহ সা:

-

আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে তাঁর বান্দা ও খলিফা হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। এ জন্য মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা। এখানেই মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টির পার্থক্য, আর এই পার্থক্য কার্যকর করার জন্য রাব্বুল আলামিন অসংখ্য নবী-রাসূল এবং আসমানি কিতাব ও সহিফা নাজিল করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহমদ মুস্তফা সা:কে বিশ্বমানবতার একমাত্র মুক্তিসনদ, মানব জাতির হিদায়াতের জন্য সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ আসমানি কিতাব আল কুরআন দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। এরপর কোনো নবী-রাসূল এবং আসমানি কিতাব বা সহিফা আসার কোনোরকম অবকাশ নেই। এটি আমাদের ঈমানের অঙ্গ। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে ঘোষণা করেন : ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করেছিলাম, আর ইসলামকে তোমাদের দ্বীন বা জীবনবিধানরূপে মনোনীত করে সন্তুষ্ট হলাম।’ (৫:৩)
এই আয়াত থেকে প্রমাণিত হয়, আল-কুরআনের মাধ্যমে প্রদত্ত আল্লাহ তায়ালার বিধান এবং তার যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে গঠিত রাসূলে করিম সা:-এর সিরাত তথা জীবনচরিতÑ এ দুটোর সমন্বিত নামই হচ্ছে ‘দ্বীন ইসলাম বা ইসলামী জীবনব্যবস্থা’। প্রতিটি মানবজীবনে এর যথাযথ বাস্তবায়নই হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার প্রকৃত বান্দা ও তাঁর খলিফা হওয়ার একমাত্র পথ।
রাসূলে করিম সা:-এর সিরাত হচ্ছে আল কুরআনের সব বিধিনিষেধের সফল বাস্তবায়ন। তাই উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা:-কে যখন নবীজীর আখলাক তথা সিরাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা কি কুরআন পড়নি? সেই কুরআনই তো তার আখলাক বা সিরাত।’ নবী করিম সা:-এর সিরাত বা জীবনচরিত হচ্ছে একটি জীবন্ত কুরআন।
রাসূলুল্লাহ সা:-এর সিরাত বা জীবনাদর্শের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণÑ তিনি আজীবন আল্লাহ তায়ালার হুকুম-আহকাম পালনে ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তাঁর প্রতি আল্লাহর নির্দেশ ছিল : ‘হে নবী বলুন, আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ সব কিছুই রাব্বুল আলামিনের উদ্দেশে নিবেদিত।’ (৬:১৬২) আল্লাহ তায়ালার হুকুম-আহকাম পালনে তাঁর বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি তা প্রথমে নিজে আমল করতেন; এরপরই অন্যকে তা আমল করার নির্দেশ দিতেন। তাঁর গোটা জীবনে এমন কোনো ঘটনা পাওয়া যায় না, তিনি নিজে আমল না করে অন্যকে তা আমল করতে বলেছেন। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালার দুটো বাণী তাঁর সিরাতে পাকের মূল চালিকাশক্তি ছিল। তার একটি হলো : ‘ওহে যারা ঈমান এনেছ, তোমরা যা করো না, তা কেন বলো?’ অন্য একটি আয়াতে বলা হয়েছে : ‘তোমরা কি মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করো, আর নিজের ব্যাপারে বেমালুম ভুলে থাকো?’ (২:৪৪)
নবী করিম সা:-এর জীবনচরিত ছিল খুবই ভারসাম্যপূর্ণ। তাঁর জীবনে ধর্মীয় বিষয়ে অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা সত্ত্বেও তিনি ‘রাহবানিয়্যাত’ বা বৈরাগ্যবাদের সম্পূর্ণ ঊর্ধ্বে ছিলেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘ইসলামে বৈরাগ্য বা সন্ন্যাসবাদের কেনো স্থান নেই।’ প্রতিটি মানুষ আল্লাহর দেয়া বিধান মোতাবেক ঐকান্তিকতার সাথে ইবাদত-বন্দেগি তথাÑ নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি আদায় করবে। আল্লাহর দেয়া বিধিনিষেধ পালনের মাধ্যমেও তার ওপর অর্পিত সাংসারিক যাবতীয় দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে। ল্য রাখতে হবে, এতে যেন কোনোভাবে ভারসাম্য নষ্ট না হয়। যেমনÑ কোনো ব্যক্তি নফল ইবাদতে এত বেশি মশগুল হয়ে যান যে, সংসার জীবনের কোনো দায়দায়িত্বই পালন করেন না। ফলে তার পরিবারের সদস্যদের ইসলামের প্রতি এমন বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয় যে, তারা নফল ইবাদত দূরে থাক, ফরজ ইবাদতের প্রতিও তাদের অনীহা দেখা দিতে শুরু করে। এ বিষয়ে নবী করিম সা: তাঁর নিজের সুন্নাহ বা পদ্ধতি সম্পর্কে বলেন, ‘আমি আল্লাহকে তোমাদের চেয়ে বেশি ভয় করি, নফল রোজা পালন করি, আবার বর্জনও করি, নফল নামাজ আদায় করি, আবার বর্জনও করি। এমনিভাবে, আমি বিয়ে-শাদি করেছি।’ এরপর বলেন, ‘এটাই আমার সুন্নাত। যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত ছেড়ে দেবে সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয় (সহিহ বুখারি)।
নবী করিম সা:-এর জীবন ছিল কঠোর সঙ্কল্প ও দৃঢ়চিত্ততার উজ্জ্বল নিদর্শন। এ কারণেই আল কুরআনে তাঁকে ‘উলুল আজম’ বা স্থির প্রতিজ্ঞ বলা হয়েছে (৪৬:৩৫)। কেননা নবুয়তের দায়িত্ব গ্রহণ করার প্রাক্কালে তাঁর তেমন কোনো সহযোগী ছিলেন না। তা সত্ত্বেও তিনি দৃঢ়চিত্তে স্বীয় গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হতে বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ বা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েননি। একবার মক্কার কাফির মুশরিকদের প্রবল বিরোধিতার মুখে তার চাচা আবু তালিব কিছু দিন ইসলাম প্রচার থেকে তাকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন। উত্তরে তিনি তাঁর দৃঢ়চিত্তের পরিচয় দিয়ে বললেন, আল্লাহর শপথ! এরা যদি আমার এক হাতে চন্দ্র এবং অন্য হাতে সূর্যও এনে দেয়, তবুও এ মহান দায়িত্ব থেকে বিরত থাকতে পারব না।’ একবার কোনো এক বেদুইন নবী করিম সা:কে একাকী একটি গাছের নিচে বিশ্রাম করতে দেখে তার তলোয়ার দেখিয়ে বলল, ওহে মুহাম্মদ! এখন তোমাকে আমার হাত থেকে কে রা করবে? তিনি দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিলেন, ‘আমার আল্লাহ’। এ কথা শুনে লোকটি এত ভয় পেল যে, তার হাত থেকে তলোয়ারটি মাটিতে পড়ে গেল। এমন অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সা: প্রতিশোধ না নিয়ে লোকটিকে মা করে দিলেন (সহিহ বুখারি)।
নবী করিম সা:-এর সিরাতে তাইয়্যেবার একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, আড়ম্বরহীনতা। তিনি পানাহার, পোশাক-পরিচ্ছদসহ কোনো কিছুতেই আড়ম্বর করা কখনো পছন্দ করতেন না। তিনি সহজ-সরল জীবনযাপনেই অভ্যস্ত ছিলেন। যখন যে খাদ্য মিলত, তিনি তাই খেতেন; যখন যা পেতেন তাই পরিধান করতেন। তবে তিনি খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুরুচিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। সদাসর্বদা অনাড়ম্বর ও সহজ-সরল জীবনযাপন করার জন্য তিনি তাঁর কন্যা হজরত ফাতিমা রা:-এর ঘরের দরজা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসেন। এর কারণ হজরত আলী রা: জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোনো সুসজ্জিত ঘরে প্রবেশ করা নবী-রাসূলের জন্য শোভনীয় নয়’ (সুনানে আবু দাউদ)। ঘটনা হলোÑ হজরত ফাতিমা রা: ঘরের দরজায় একটি দামি রঙিন পর্দা ঝুলিয়েছিলেন, যা নবী করিম সা:-এর দৃষ্টিতে ‘আড়ম্বরপূর্ণ’ মনে হয়েছিল। একবার উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা:-এর ঘরে চাঁদোয়া শোভিত দেখে তিনি তা বিদীর্ণ করে বললেন, বস্ত্র মানুষের পরিধানের জন্য, ইটের পরিধানের জন্য নয়। (সুনানে আবু দাউদ)
‘জুহদ ও কানা‘আত’ তথা ‘দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি ও অল্পে তুষ্টি’ ছিল নবী করিম সা:-এর সিরাতের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। হজরত আবদুল্লাহ রা: বর্ণনা করেন, একদিন তিনি খেজুরপাতার চাটাইয়ে শুয়েছিলেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যদি অনুমতি দেন, তবে একটু নরম বিছানা করে দিই।’ তিনি বললেন, ওহে! এই ণস্থায়ী পৃথিবীতে ণিকের আরামের কী মূল্য? আমার উদাহরণ তো ওই মুসাফিরের মতো, যে দুপুরের খরতাপে একটি গাছের নিচে কিছুণ বিশ্রাম করে পরণেই তার গন্তব্যে চলে যায় (ইবনুল জাওজি, আল-ওয়াফা) উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা: রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাথে ১০ বছর অতিবাহিত করেছিলেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ কোনো দিন পেট ভরে আহার করেননি।
নিজের কাজ নিজের হাতে করা নবী করিম সা:-এর সিরাত তথা জীবনচরিতের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। তাঁর অসংখ্য সাহাবি সদাসর্বদা তাঁর একটু খেদমত করার সুযোগ লাভে ধন্য হওয়ার ল্েয অধীর আগ্রহে অপো করতেন। কিন্তু তিনি বিনাওজরে ব্যক্তিগত কাজে সাধারণত কারো সাহায্য নিতেন না। তিনি পবিত্র কাবাঘর পুনর্নির্মাণ মসজিদে নববী ও মসজিদে কুবার নির্মাণ এবং খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খননে সাহাবিদের সাথে মিলে সমানভাবে কাজ করেছেন। (আল-ওয়াকিদি, আল-মাগাজি) তিনি গৃহস্থালি কাজে উন্মুল মুমিনিনদের সাহায্য করতেন, কাপড়ে তালি লাগাতেন, ঝাড়– দিতেন, দুধ দোহন করতেন, বাজার থেকে সওদা বহন করে আনতেন, বালতি মেরামত করতেন, নিজে উট বাঁধতেন, খাদিমদের সাথে আটার খামির তৈরি করতেন। (সহিহ বুখারি)
বিনয় ও নম্র স্বভাব ছিল নবী করিম সা:-এর সিরাতে পাকের অন্যতম ভূষণ। তাঁর কথায় ও কাজে কখনো এমন কিছু প্রকাশ পায়নি, যা দ্বারা অহঙ্কার বা আত্মম্ভরিতার লেশমাত্র অনুভূত হয়। একবার তাঁর ও মূসা আ:-এর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে জনৈক মুসলিম ও ইহুদির মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। বিষয়টি তাঁর কর্ণগোচর হলে তিনি বললেন, তোমরা হজরত মূসা আ:-এর ওপর আমাকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ো না। কেননা কিয়ামতের দিন মানুষ যখন সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়বে, তখন সর্বপ্রথম আমিই সংজ্ঞা ফিরে পাবো এবং দেখব, হজরত মূসা আ: আরশের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি জানি না, তিনি কি আমার আগে সংজ্ঞাপ্রাপ্ত হবেন, না কি তিনি আদৌ সংজ্ঞা হারাবেন না? (সহিহ বুখারি) একবার একটি প্রতিনিধিদল নবী করিম সা:কে বলল, ‘আপনি আমাদের নেতা।’ জবাবে তিনি বললেন, ‘তোমাদের প্রকৃত নেতা আল্লাহ তায়ালাই।’ প্রতিনিধিদল তখন বলল, ‘আপনি আমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, সর্বাপো সম্মানী।’ তিনি বললেন, ‘সংযত হয়ে কথা বলো। শয়তান তোমাদের যেন পথভ্রষ্ট করে না বসে।’ (সুনানে আবু দাউদ) অন্য এক রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে, তিনি আরো বললেন, ‘আমি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল মুহাম্মদ ইবন আবদুল্লাহ। আল্লাহ তায়ালা আমাকে যে মর্যাদা দিয়েছেন, তা থেকে আমাকে কেউ আরো ওপরে তুলুক, তা আমি পছন্দ করি না।’ (মুসনাদে আহমাদ)
ওপরে বর্ণিত আলোচনা থেকে এ কথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, নবী করিম সা:-এর সিরাত তথা তিনি তাঁর জন্ম থেকে নিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত যা কিছু করেছেন, বলেছেন এবং প্রত্য বা পরোভাবে অনুমোদন দিয়েছেন, তা সুন্নাহ হিসেবে আমাদের মানবজীবনে অনুসরণ, অনুকরণ ও বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য কর্তব্য। এর মাধ্যমেই আমাদের হতে হবে আল্লাহ তায়ালার প্রকৃত বান্দা ও খলিফা বা প্রতিনিধি এবং সফলকাম হতে হবে ইহকালে আর নাজাত বা মুক্তি লাভ করতে হবে পরকালে।
লেখক : সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

 


আরো সংবাদ



premium cement