২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

শিক্ষার মূল লক্ষ্য

-

গণতন্ত্র, মুক্তবাজার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং ‘সার্বজনীন মানবাধিকার’-এর মতোই শিক্ষা অনেকটা এখন একটি বিষয়, যার উৎকর্ষ ও মূল্যমান স্বতঃপ্রমাণিত। আর এ জন্যই শিল্পোন্নত দেশগুলোর আজ এ প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব। এহেতুই, এ ধরনের কোনো ঐন্দ্রজালিক পরিচয়চিহ্ন নিয়ে যখন কোনো প্যাকেজ-প্রোগ্রাম আবির্ভূত হয়, খুব স্বাভাবিকভাবেই কোনো প্রশ্ন ওঠে না। এই নিঃশর্ত গ্রহণযোগ্যতার কারণেই উল্লেখযোগ্য কোনো বিষয় বা কার্যক্রমকেই যেকোনো মুসলিম দেশের প্রবেশ পথে ‘সবুজ সঙ্কেত’ দ্বারা তাকে স্বাগত জানোন হয়; কোনোরকম, কোনোরূপ বা কোনো বাস্তব ও অপরিহার্য আলোচনার সম্মুখীন হতে হয় না। উদাহরণস্বরূপ শিক্ষাসংক্রান্ত আলোচনার প্রায় সবটুকু অংশই পূর্ণ থাকে সাক্ষরতার পরিসংখ্যান, কী পরিমাণ গ্র্যাজুয়েট, মাস্টার্স ও পিএইচডি প্রয়োজন, কত বেশি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি পেশাজীবী তৈরি করা সম্ভব এসব বিষয় নিয়ে। আর এসবই গৃহীত ও পাঠ্যক্রমের যে মূল বিষয়বস্তু এবং আরো বিশেষ করে, শিক্ষার যে মৌলিক ও প্রকৃত উদ্দেশ্যÑ সাধারণত সে দিকে কারো কোনো মনোযোগ থাকে না। ‘উন্নত’ দেশগুলোর পদাঙ্ক অনুসরণকরত সবারই একমাত্র কাজ ও লক্ষ্য হলো উন্নত দেশসমূহের যে অগ্রগতি, সেই স্তরে উত্তরণ।
‘প্রথম’ বিশ্বে শিক্ষা হলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনারই একটি সম্প্রসারিত রূপ; যা উৎপাদন-প্রক্রিয়া গতিশীল রাখার জন্য যোগ্য ও দক্ষ শ্রমশক্তি এবং তৎসহ উৎপাদিত দ্রব্যের আগ্রহী ভোক্তার সংখ্যা ক্রমাগত বাড়িয়ে তুলতে পারে। খুব মসৃণ ও সুন্দরভাবে বলতে হয়, শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ একটি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে নিশ্চিত করা এবং একইভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়েও শিক্ষার লক্ষ্য আজ যথাসম্ভব আকর্ষণীয় জীবিকা অর্জন। বৈধ জীবিকা এবং দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ইসলামও নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে; কিন্তু শিক্ষাকে শুধুই আর্থিক সাফল্যের সাথে যুক্ত করা অবশ্যই চরম দুর্ভাগ্যজনক। এতে শিক্ষাকেন্দ্রগুলোকে চিন্তা-চৈতন্যে ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নে নিতান্তই বৃত্তিমূলক কর্মশালায় পরিণত করে; বা আদৌ কাম্য ও কাক্সিত নয়। এতে শিক্ষার মারাত্মক অবমূল্যায়ন ঘটে, এবং সেই সাথে ব্যক্তি ও সমাজেরও।
মানুষ এবং পশু-প্রাণীর মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। শুধু সহজাত প্রবৃত্তি এবং দৈহিক প্রয়োজনেই পিপীলিকা অথবা মৌমাছি অথবা পশুপালকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটা প্রাণীসমাজ গঠনে কার্যকর ভূমিকা রখে। কিন্তু মানুষের জীবন ঠিক এই নিয়মে কাজ করে না। মানুষ স্বভাবগতভাবেই এমন যে, সে কোনো বাধ্যবাধকতার মধ্যে অন্তরীণ থাকে না এবং সে শুধু পূর্বাপর অনুসরণ-অনুগমনকে আশ্রয় করেই চলে না। অথচ এটাই সুসংবদ্ধ সমাজগঠনের একটি প্রয়োজনীয় শর্ত। অতএব, তাকে যদি একটি গতিশীল ও সমৃদ্ধিশালী সমাজ নির্মাণ করতে হয়, তাহলে অবশ্যই কোনো পথ ও উপায় খুঁজে নিতে হবে। আর সেই পথ বা উপায়ই হচ্ছেÑ সবারই একটি সাধারণ লক্ষ্যের প্রতি ঐক্যবদ্ধতা, বিশ্বাস ও মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির একাত্মকতা। একটি সর্বসম্মত গঠন-কাঠামো ব্যতীত সবাইকে একইসূত্রে বেঁধে রাখা যেমন অসম্ভব, মানবসমাজের অস্তিত্ব ধরে রাখাও অসম্ভব। আর এ অবস্থায় পরস্পর-বিচ্ছিন্নতাই অনিবার্য হয়ে ওঠে; এবং ফলস্বরূপ অন্য কোনো সমাজের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। অধিকন্তু, এটাই সত্য ও বাস্তব যে, সমাজের মধ্যে সবার জন্য এমন একটা সর্বসম্মত সাধারণ ভূমির নিশ্চয়তা থাকতে হবে; যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ক্রমাগত অব্যাহত থাকে। আসলে এটাই শিক্ষার ‘প্রকৃত’ উদ্দেশ্য।
কোনো সমাজের শিক্ষাব্যবস্থা এমন নাগরিক ও পরিচালক তৈরি করবে, যাতে সেই সমাজ সক্রিয়ভাবে তার অগ্রযাত্রা বর্তমানে ও ভবিষ্যতে একই রকম অবাধ ও অপ্রতিহত রাখতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে যে সুস্থতা বা ব্যাধি, তা সমাজদেহে সরাসরি সুস্থতা বা ব্যাধিরূপে সংক্রমিত হয়।
বর্তমানে আমরা বহু অভ্যন্তরীণ সমস্যার সম্মুখীন-দুর্নীতি, অবিচার, দারিদ্র্য, নিগ্রহ-নির্যাতন ইত্যাদি আজ মুসলিম-বিশ্বের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। আমরা যদি এসব নিয়ে চিন্তা করি, আমরা উপলব্ধি করতে পারবÑ এসবই মনুষ্যসৃষ্ট। অন্যভাবে বলা যায়, সমস্যাগুলো সবই বহুল পরিমাণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য থেকে আগত যে শিক্ষা এমন মানুষ তৈরি করছে, যারা সমস্যাগুলো স্থায়ী ও অনড় করে রাখছে। শাসক যারা বিদেশী শক্তির কাছে পণ্যের মতো বিক্রীত এবং যারা তাদের জনগণকে এক রকম দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রেখেছে। আমলা, যারা আইন প্রয়োগ করছে, অবিচারের ওপর ভিত্তি করে সেনাধ্যক্ষ, যারা আপন জনগণের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত; ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, যারা শোষণ ও প্রতারণায় লিপ্ত; সাংবাদিক, যারা মিথ্যা বলে, আবেগ ছড়ায় এবং কুৎসা ও কুৎসিতকে উৎসাহিত করে তারা সবাই শিক্ষিত মানুষ এবং বহু ক্ষেত্রে 'Highly educated' খুবই উচ্চশিক্ষিত। তাদের সবারই শিক্ষা ছিল তাদেরকে এমনভাবে প্রস্তুত করে তোলা, যাতে তারা তাদের বাস্তব-কর্মজীবনে গৃহীত শিক্ষানুযায়ী সমুচিত ভূমিকা পালন করতে পারে কিন্তু দেখুন, শিক্ষা তাদেরকে কিভাবেই না তৈরি করে তুলেছে।
‘সমস্যা আজ সমাজের সর্বস্তরে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায় কী কারণে আজ এত বেশি বস্তুবাদের হাতে বন্দী? আমরা কী আর এমন আশা করতে পারি, কী আর এমন ভালো কিছু ভাবতে পারি, যেখানে আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই বস্তুবাদের ‘সুসমাচার’ বা ধর্মবাণী প্রচার করে চলেছে? কিন্তু কেন আমরা ইসলামকে জনজীবনের সাথে প্রায় সম্পর্কচ্যুত এক প্রভাবহীন দূরবর্তী প্রান্তে নির্বাসন দিয়ে রাখলাম? কারণ এটাই যে, আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা স্পষ্ট ও নির্দিষ্টভাবে এ ব্যবস্থাই নিরঙ্কুশ করে রেখেছে। আমাদের পরস্পরের প্রতি ব্যবহারে কেন আমরা ইসলামসম্মত আচরণ ও নৈতিকতা এত বেশি পরিত্যক্ত ও উপেক্ষিত হতে দেখি? এখনেও একই কারণ, আমাদের আমদানিকৃত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে নৈতিক-প্রশিক্ষণ বলে কিছু নেই। কেন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা রুগ্ণ ও ব্যাধিগ্রস্ত।
শিক্ষার প্রকৃত সমস্যা ও সঙ্কট এখানেই নিহত। আমদানিকৃত ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা চালু হওয়ার আগে আমাদের নিজস্ব সমাজে শিক্ষা ছিল সর্বদায়ই মানুষের জন্য হিতকর ও নৈতিক আত্মিক পুষ্টিবর্ধনের উপায়। নৈতিক-প্রশিক্ষণ (তারবিয়া) ছিল সবসময়ই শিক্ষার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। উস্তাদ (শিক্ষক) শুধু একজন আলোচক বা প্রভাষক ছিলেন না এবং ছিলেন না নিতান্তই একজন পেশাজীবী; ছিলেন পথপ্রদর্শক ও নৈতিক শিক্ষাদাতা। এই হাদিসটি তখন আমাদের স্মৃতিপটে জাগরুক ছিল।
‘কোনো পিতা তার সন্তানদের জন্য সুন্দর নৈতিক শিক্ষার চেয়ে অধিকতর উৎকৃষ্ট কোনো উপহার দিতে পারে না’ (তিরমিযি-হাদিস : ১৮৭৫)।
আমাদের শিক্ষা ছিল এই হাদিসের বিশ্বস্ত প্রতিফলন। আমাদের দারুল-উলুমগুলো এখনো সেই একই ঐতিহ্য রক্ষা করে চলেছে কিন্তু এখানে শিক্ষার্থীর যে সংখ্যা, তা ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ছাত্রের তুলনায় একেবারেই নগণ্য।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ এই ইউরোপে বিদ্যালয় চালু হয়েছিল চার্চ কর্তৃক ও চার্চের অধীনে। কিন্তু পরে যখন সব কিছুকে পরাভূত করে পুঁজিবাদী শক্তি একক প্রাধান্য লাভ করল, তখন পুঁজিবাদ নিজস্বরূপে ও প্রয়োজনে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুললো আর এই নব্য-পুঁজিবাদ ও তার আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থাধীনে কাজ করার মতো অনেক প্রশিক্ষিত লোকের প্রয়োজন। সুতরাং নাগরিকত্ব-বোধের প্রশিক্ষণসূচি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে যদিও ধরে রাখা হলো, কিন্তু ধর্মের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির প্রত্যাশার নৈতিক-প্রশিক্ষণের স্থানচ্যুতি ঘটল। আর এ ব্যবস্থাই, সামান্য পরিবর্জন-পরিশোধনকরত মুসলিম দেশগুলো আমদানি করা হলো। এবং এর যে কী ফলাফল, সেটা আমাদের চোখের সামনেই এখন বর্তমান।
বস্তুত, আমরা আমাদের সমস্যার সমাধান করতে পারি, যদি আমাদের ভুলগুলো অনুধাবন করতে সক্ষম হই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সর্বপ্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত ইসলামি সমাজের উপযোগী সৎ ও যোগ্য নাগরিক এবং যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি করা। ‘তারবিয়া’ অর্থাৎ ইসলামি নৈতিকতার প্রশিক্ষণ এ ক্ষেত্রে অবশ্যই শিক্ষাব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে হবে। কারণ এটা কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটাই আমাদের শিক্ষা অপরিহার্য ও প্রাণবন্ত। আর এ মূল কথাটি যদি বুঝতে না পারি অথবা ভুলে যাই, তাহলে শিক্ষার উন্নতিকল্পে আমাদের সব প্রচেষ্টা ও পরিকল্পনা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। আর এ জন্য যা-প্রয়োজন তাহলো, আমাদের পাঠ্যসূচিকে নতুনভাবে প্রণয়ন, পাঠ্যপুস্তকের পুনর্লিখন, এবং শিক্ষকদের জন্য পুনঃপ্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং অবশ্যই বুঝতে হবে, এ কাজগুলো আমাদের নিজস্ব; অর্থাৎ সব বহিঃপরামর্শ ও বহিঃপ্রভাবকে পরিহার করে এ কাজ আমাদের নিজেদেরকেই সম্পাদন করতে হবে। উল্লেখ্য, আলোচ্য ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে সঠিক-দিকনির্দেশক সমৃদ্ধ ইতিহাস। এখন প্রশ্ন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যেভাবে পুনর্গঠিত হওয়া উচিত, সেই পরিবর্তন সাধনে আমরা কি চূড়ান্তভাবে আগ্রহী।
অনুবাদ : অধ্যাপক আবু জাফর


আরো সংবাদ



premium cement
গণমাধ্যমের ওপর হামলা সহ্য করা হবে না : প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জাপানে রকেট পরীক্ষাস্থলে ভয়াবহ আগুন সিলেটে ইউপি চেয়ারম্যানসহ আটক ৩ আদানির সাথে বিদ্যুৎ চুক্তি : হাইকোর্টের লিখিত আদেশ প্রকাশ কুমিল্লা সীমান্তে মাদকসহ ভারতীয় নাগরিক আটক এশিয়ায় মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন নিয়ে রাশিয়ার পাল্টা হুমকি ফিলিস্তিনের প্রতি বাংলাদেশের দৃঢ় সমর্থন পুনর্ব্যক্ত বিক্ষোভে উত্তাল পাকিস্তানে নিহত আরো ৬, সেনা মোতায়েন রাষ্ট্রদ্রোহের ঘটনায় যুক্ত থাকলে ছাড় দেয়া হবে না : আসিফ মাহমুদ বিয়ের প্রলোভনে আ’লীগ নেতার বিরুদ্ধে নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ ট্রাম্প দায়িত্ব নেয়ার প্রথম দিনই চীন-মেক্সিকো-কানাডার ওপর শুল্ক আরোপ করবেন

সকল