ইসলামে সাম্যের বাণী
- আফতাব চৌধুরী
- ১২ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০
সাম্য, সমতা এমন একটি বিষয় যার মধ্যে নিহিত রয়েছে প্রত্যেক মানুষের জন্মগত, রাষ্ট্রীয় ও মানবিক অধিকার। ভিক্ষাবৃত্তি আর অনাহার, অর্ধাহার ও অর্থনৈতিক শোষণের করাল গ্রাস থেকে রেহাই পাওয়ার একটি সুন্দর ব্যবস্থা এ অধিকারগুলো। তবে সাম্য অনেক ধরনের থাকতে পারে। আর্থিক সাম্য, সামাজিক সাম্য, ধর্মীয় সাম্য, সামরিক সাম্য, আইনি সাম্য। এগুলোর মধ্যে যদিও পারস্পরিক সম্পর্ক ও মিল বিদ্যমান তবে তা অত্যন্ত ক্ষীণ, ক্ষয়িষ্ণু ও ভঙ্গুর। যেমনÑ সংবিধানে বলা হয়েছে, আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান কিন্তু আমরা বাস্তব ক্ষেত্রে তা দেখতে পাই না। অথচ মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা উমর খুতবা দিতে উদ্যত হলে একজন সাধারণ শ্রোতা সন্দেহজনক একটি প্রশ্ন করে তাঁকে খুতবাদান থেকে সাময়িক স্তব্ধ করে দিতে পেরেছিলেন। আল কুরআনের আদেশÑ নামাজের জামায়াতের উদ্দেশ্য আর ইসলামী ইবাদতগুলোরও উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল মানব সমাজে সাম্য, ন্যায়, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা যা হাতে-কলমে প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়ে গেলেন আরবের পাথরময় মাটিতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:। খেজুরপাতার মসজিদের একটি কাষ্ঠখণ্ড থেকে সমাজের উঁচু স্তর পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন নামে সাম্যই প্রতিষ্ঠা করে গেলেন, যার সুশীতল চায়া থেকে আরবের মরু প্রান্তের প্রত্যন্ত অঞ্চলের টিলাঘেরা একটি ছোট ঝুপড়ির মালিক পর্যন্ত বাদ যাননি। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, যুবা-বৃদ্ধ সবাই সাম্যের আলোয় উদ্ভাসিত ছিলেন। ইসলাম ধর্মে দীক্ষা না নেয়া এক ইহুদি বিধবা মহিলার ঘরোয়া নিমন্ত্রণে পর্যন্ত হাজির হয়েছিলেন সাম্যের প্রতীক মহানবী মুহাম্মদ সা:। তিনি তো এক ইহুদি শবদেহের জানাজায় (মৃতের সৎকার) পর্যন্ত শরিক হওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছিলেন।
মহানবী শুধু মসজিদের জামাতে নারীদের আগমনের অধিকার দিয়ে ক্ষান্ত থাকেননি বরং তিনি তাদের যুদ্ধের ময়দানে, আরাফাত ময়দানে, ঈদের জামাতে পর্যন্ত যাওয়ার অধিকার দিয়ে গেছেন। শিক্ষা আর জ্ঞানার্জন তথা দরছ তফরিসেও তাদের দিয়ে গেছেন সম্পূর্ণ অধিকার। তাই তো দেখা যায় আম্মাজান আয়েশা নবীপরবর্তী সময়ে অনেক সাহাবার মধ্যে মানবিক কারণে ঘটে যাওয়া অনেক বিরোধ আর দ্বন্দ্বের সমাধান দিয়েছেন। বিখ্যাত উষ্ট্রের ঐতিহাসিক যুদ্ধ জঙ্গে জামালের আলীবিরোধী পক্ষের সেনাপতি ছিলেন মা আয়েশা। ধার্মিক-অধার্মিক, দেশী-বিদেশী, ধনী-দরিদ্র সবার জন্য মহানবীর সাক্ষাৎকার আর আলোচনার দুয়ার খোলা ছিল সব সময়। একবার এক গোষ্ঠী ধনী ক্ষমতাসীন লোকের ধর্মীয় আলোচনাকালে একজন অন্ধ মুসলিম সাহাবি উম্মে মাকতুম মহানবীকে কোনো বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে চাইলে তিনি একটু মন ভারী করেছিলেন। তাঁর এ অস্বাভাবিক ও শ্রেণীভেদ ব্যবহারের দরুন আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে রীতিমতো শাসিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং এ সংক্রান্ত বিষয়ে কুরআনের একটি সূরা যার নাম আবাছা নাজিল করা হয়েছিল। এতসবের পরও মুসলমানদের সমাজে ধনী তথা প্রতিষ্ঠিত জনের মর্যাদা কায়েম রয়েছে। ইসলাম এসেছিল সব ধরনের শ্রেণীভেদ ভেঙে দিয়ে সব মানুষ যেমন জন্মগত হিসেবে আদম সন্তান ঠিক তদ্রƒপ কার্যক্ষেত্রেও সবাইকে সমান মর্যাদা আর সম্মানের আসনে বসাতে। তাই তো মহানবী বিধান দিয়েছিলেন নামাজের জামাতের কাতারে রাষ্ট্রপ্রধানের গা-ঘেঁষে একজন ভিখারি, মজদুরও দাঁড়াতে কোনো বাধা নেই? কিন্তু তা এ পর্যন্তই থেকে গেছে। ইসলামের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থল মসজিদগুলোও আজ ধনী আর ক্ষমতাশালীদের করায়ত্ত।
খেজুরপাতার ওই মসজিদের সার্বক্ষণিক কর্মধারা এত শক্তিশালী আর ক্ষমতাবান ছিল যে তখনকার সমাজ থেকে আশরাফ আর আতরাফের তফাত সম্পূর্ণরূপে ঘুচিয়ে দিয়েছিল। মর্যাদা ছিল ন্যায়বান, কর্মঠ, সত্যানুসারীদের; যাদের মাপা হতো না বাহ্যিক চালচলন আর বেশভূষা দিয়ে। মহানবী বলেই দিলেনÑ আল্লাহ কারো বাহ্যিক আচরণ দেখেন না, বরং তিনি লক্ষ করেন মানুষের অন্তরের আন্তরিকতা, নিষ্কলুষ নিষ্ঠা আর ত্যাগ-তিতিক্ষা। (মহানবীর মহাবাণী)।
এতসব দিবালোকের মতো পরিষ্কার বাণী বিদ্যমান থাকার পরও একশ্রেণীর বেশভূষাধারী বেশভূষার মাধ্যমে ধর্মের নামে নিজ পকেট গরম করে চলেছেন। সৃষ্টি হচ্ছে সমাজে উঁচু-নীচু শ্রেণীভেদ, যা নির্মূল করাই ছিল ইসলামের লক্ষ্য। যেসব মোকাম আর খানকাহ তথা সকল্পিত খতম আর ইবাদত পদ্ধতি আজকের মুসলমান সমাজকে শোষণ, শাসন ও কলুষিত করেছে তা সবাই অনৈসলামিক তথা নবীর দেশ আরব মুল্লুকে যার সামান্যতমও অস্তিত্ব নেই। মহানবী মুহাম্মদ সা:-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলÑ সর্বাপেক্ষা খারাপ ও নিন্দনীয় কাজ কী? উত্তরে তিনি বলেছিলেনÑ আমাকে মন্দ কাজের কথা জিজ্ঞেস করো না; বরং উত্তম কাজের কথা জিজ্ঞেস করো। তারপর বলেছিলেন, সর্বাপেক্ষা মন্দ ও নিন্দনীয় কাজ হলো জ্ঞানী লোকের মন্দ কাজ। (বর্ণনায় আবু হুরায়রা)।
এসব সমস্যা আর জটিলতা, উঁচু-নীচু শ্রেণীভেদ মানুষেরই সৃষ্ট। আল কুরআনও তাই বলেÑ পানি ও স্থলে সৃষ্ট বিপর্যয় মানুষের হাতেরই কামাই। ( আল কুরআন)। জীবন বিধান আল কুরআন তথা মহানবীর জীবনকথা এসব অন্যায়কে দূরীকরণ, এসব অন্যায়ের মূলোৎপাটনকে ইসলাম ঈমান তথা মানবজীবনের একমাত্র লক্ষ্য বলে বিধান দিয়েছে। আরো অগ্রসর হয়ে এটিও বলে দিয়েছে যে এসব জোর-জুলুমকে মেনে নেয়া অন্যায়। এমনকি ন্যায়ের আদেশ পালন ও অন্যায়ের প্রতিরোধ না করলে নামাজ-রোজা, দোয়া কোনো কিছুই কবুল হবে না। আজ আমরা একা একা দোয়া, ইবাদত, প্রার্থনা করে কেউ ভাগ্যবান, কেউ স্বর্গ লাভ, নামাজ এসব কুড়িয়ে নিতে চাইছি অথচ আল কুরআন ঘোষণা করে এসব বিষয় জাতীয় জীবনের সিদ্ধান্তেই সম্ভব। কুরআনের ঘোষণাÑ আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ সে জাতি নিজের থেকে কোনো প্রস্তাব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে। ( আল কুরআন)। জাতীয় সিদ্ধান্তই জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনে সাম্য-সমতা স্থাপনে সম্ভব হতে পারে, হয়েছেও আগে এবং তাই আল কুরআনের ভাষায় ‘আন আকিমুদ্বীনে’র চূড়ান্ত রূপ।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা