২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

দিনে কর্মবীর রাতে দরবেশ

-

ইসলাম বৈরাগ্যবাদে বিশ্বাসী নয়, কর্মবাদে বিশ্বাসী। কর্মেই নিহিত রয়েছে সফলতা। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দিয়েছেন কর্মের যোগ্যতা। মানুষ কর্মের মাধ্যমে সফল হোক, এটিই আমাদের অভিপ্রায়। ইসলাম ইবাদতের পাশাপাশি রাতে বিশ্রাম নিতে এবং দিনে জীবিকা অর্জনের কথা বলে। আল্লাহপাক বলেন, ‘আমিই তোমাদের নিদ্রাকে করেছি আরামদায়ক এবং রাত্রিকে করেছি আবরণ। আর আমি করে দিয়েছি দিবসকে জীবিকা অর্জনের সময়। (সূরা নাবা : ৯, ১০ ও ১১) ‘নামাজ সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করো ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সূরা জুমা : ১০)
পার্থিব উন্নতি ও পরকালীন কল্যাণ : ইসলাম শুধু আখেরাতের কথাই ভাবতে বলেনি। পার্থিব উন্নতি ও পরকালীন কল্যাণ, উভয়ের জন্যই আল্লাহপাকের নির্দেশকে পালন করতে বলেছেন। দুনিয়ার প্রতিটি মুহূর্ত নেক আমল ও সৎ কর্ম করে আখেরাতের মুক্তির পথ রচনা করতে বলেছেন। ‘হে আমাদের রব! আমাদেরকে এই দুনিয়ায় কল্যাণ দান করো এবং পরকালেও আমাদেরকে কল্যাণে দান করো, আর আগুনের আজাব থেকে আমাদের রক্ষা করো।’ (সূরা বাকারা : ২০১)
আজকের কাজ কালকের জন্য ফেলে না রাখা : ইসলাম সৎকর্মে উদ্যোগী হতে, সক্রিয় হতে শিক্ষা দেয়, অলস ও অকর্মণ্য ও পরনির্ভরশীল হতে নয়। আজকের কাজ কালকের জন্য ফেলে রাখার নীতিও ইসলামে নেই। ‘তোমরা সৎকাজের আদেশ করো, অসৎ কাজে নিষেধ করো এবং আল্লাহর ওপর ঈমান আনো।’ (সূরা আলে ইমরান : ১১০) ‘আর মনে রাখবে, কোনো জিনিস সম্পর্কে কখনো এ কথা বললে না, আমি কাল এ কাজ করব।’ (সূরা কাহফ : ২৩) ‘তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে/খোদার মদদ ছাড়া,/তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে/নিজের পায়ে দাঁড়া।’ (কবি ফররুখ আহমদ)
ইসলাম স্বনির্ভর হতে বলে : আল্লাহ আমাদেরকে আমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন। (সূরা ইব্রাহিম : ১২) আল্লাহর দায়িত্ব পথ প্রদর্শন করা, কাজ করার দায়িত্ব আমাদের। কৃষক ক্ষেতে ফসল না লাগালে আল্লাহ ফসল দেবেন না। ‘আর আল্লাহ নিশ্চয় তাকে সাহায্য করেন, যে তাঁকে সাহায্য করে। আল্লাহ মহাশক্তিধর, প্রবল পরাক্রান্ত।’ (সূরা হজ : ৪০) নিশ্চয় আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন না করে।’ (সূরা রাদ : ১১)
‘মানুষ শুধু তাই পায়, যা সে অর্জন করে।’ (সূরা নাজম : ৩৯, বাকারা : ২০২) ‘যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করে তারাই সৃষ্টির সেরা।’ (সূরা বাইয়্যিনাহ : ৭) চেষ্টা সাধনা ও সৎ কর্মই মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষ বানায়।
ইসলামে ইহজগতকে অবহেলা করতে বলা হয়নি, বরং কর্ম করে নিজেরে অবস্থা পরিবর্তন করার জন্য কর্মচঞ্চল, প্রাণবন্তু হতে বলেছে। পরনির্ভর নয়, স্বনির্ভর হতে বলেছে। ধর্মে বিমুখ হওয়ার শিক্ষা যেমন ইসলামে নেই, তেমনি কর্মে বিমুখ হওয়ার শিক্ষাও ইসলামে নেই। কর্মে সক্রিয় হলে, আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করলে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে বেহিসাব রিজিক দান করেন।
(সূরা আলে ইমরান : ২৭)
‘তোমরা ন্যায় ও কল্যাণের কাজে একে অপরকে সহযোগিতা করো। অন্যায় ও বদ কাজে সহযোগিতা করো না।’ (সূরা মায়িদা : ২)
আল্লাহ কর্মবিমুখ দেখতে অপছন্দ করেন : ইসলামের দৃষ্টিতে একজন সৎ ও দক্ষ মুচি একজন অসৎ ও অদক্ষ সুলতান থেকেও উত্তম। ‘আল্লাহ তাঁর বান্দাকে দেখতে অপছন্দ করেন, যে ইহকাল ও পরকালের কর্ম থেকে বিুমখ।’ ‘জালেমদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আল্লাহকে কখনো উদাসীন মনে করো না।’ (সূরা ইবরাহিম) ‘নিশ্চয়ই তিনি স্ত্রীর বান্দাদের সম্পর্কে সব খবরাখবর রাখেন এবং সব কিছু দেখেন।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৩০) যে জীবিকার জন্য চেষ্টা তদবির ও কাজ করে আর কে করে না তিনি সবই দেখেন। ইসলামের শিক্ষা, সমাজের প্রতিটি সক্ষম মানুষ কাজ করবে, অলস জীবনযাপন ও বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেবে না। ‘নিজেদের উত্তরাধিকারীদের মানুষের করুণার মুখাপেক্ষী রেখে যাবে না।’
রাসূল সা: বলেছেন, আমি কয়েক কিরাত মজুরিতে মক্কাবাসীদের বকরি চরাতাম। হজরত আদম আ: কৃষিকাজ করেছেন। হজরত দাউদ আ: লৌহের কাজ করেছেন। হজরত ইদ্রিস আ: দর্জির কাজ করেছেন। হজরত মুসা আ: ছাগল চরিয়েছেন। সব নবী-রাসূল এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দারা নিজ হাতে কাজ করতেন। তারা কখনো কর্মবিমুখ ছিলেন না। কর্মবিমুখ হওয়ার শিক্ষা ইসলামে নেই। ভিুকের হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করাই ইসলামের শিক্ষা।
দিনে কর্মবীর রাতে দরবেশ : ইসলাম ইহলোকিক উন্নতির পথে অন্তরায় নয়। আল্লাহ বান্দাকে উভয় জগতেই (ইহকাল-পরকাল) সফলকাম দেখতে চান। এই সূত্র ধরেই একসময় মুসলমানদের দ্বারা প্রায় পুরো বিশ্ব শাসিত হয়েছে। মুসলমানদের তখন যেমন ঈমানি শক্তি ছিলÑ তেমনি তারা ধর্মনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি এবং যাবতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধশালী ছিল। অঙ্ক, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা, প্রকৌশল, নির্মাণশৈলী যুদ্ধবিদ্যা, সৎশাসন, সব দিক দিয়েই ছিল অত্যন্ত পারদর্শী। তারা দিনে ছিলেন কর্মবীর, আর রাতে ছিলেন দরবেশ। আল্লাহ তাদের কর্মে সন্তুষ্ট ছিলেন বলেই তাদের ওপর রহমতের বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে।
হে আল্লাহ! আমাদের অজ্ঞাত, ধর্মান্ধতা, অলসতা, উদাসীনতা, বিলাসিতা ওপর নির্ভরশীলতা দর করে কর্মবীর হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমরাও যাতে দিনে কর্মবীর রাতে দরবেশ হতে পারি, তেমন ঈমানি শক্তি সঞ্চয়ের যোগ্য করুন।
লেখক : গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement