২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ইনসাফ এক মহৎ গুণ

-

বাংলাদেশে মানবিক মূল্যবোধের অবনতি ও অবক্ষয়ের আরেকটি দিক হলো ইনসাফের দেউলিয়াত্ব। এ অবস্থা যেন সর্বত্র বিরাজ করছে। ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্র এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কোথাও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত নেই বললে অত্যুক্তি হবে না। অথচ ইসলামে এ ব্যাপারে খুব গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা: এ দিকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘পূর্ববর্তী জাতিগুলোর বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ, তারা ইনসাফ করত না।’ ‘আম্মার ইবনে ইয়াসার রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তিনটি কাজ একসাথে সম্পন্ন করল, সে যেন ঈমানকে সুসংবদ্ধ করে নিলো। তা হচ্ছেÑ নিজের নফসের সাথে ইনসাফ করা, সবাইকে সালাম করা ও দরিদ্র অবস্থায় অর্থ ব্যয় করা।’ বিচারের মাধ্যমে যদি পরকালীন কল্যাণ ও মুক্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়, তাহলে ইসলামী আইন ও বিচারের মাধ্যমেই তা সম্ভব। ইসলামী পরিভাষায় সুবিচারের জন্য যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, তার কোনো বিকল্প শব্দ হতে পারে না। ‘আদল’ শব্দটিকে বাছাই করে মহান আল্লাহ যে সবচেয়ে বড় বিচারক, তা আবারো প্রমাণ করেছেন। মানবিক মূল্যবোধের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো ন্যায়বিচার, সাম্য ও ইনসাফ।
আরবি ‘আদল’ শব্দটির অর্থÑ সমান করা, ন্যায়বিচার, সুবিচার, ইনসাফ, কোনো কিছুকে দাবিদারদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেয়া, যাতে কেউ কম-বেশি না পায়। আদল মানে মানুষকে সমানভাবে দেখা, সবাইকে সমান সুযোগ দেয়া। যে যেখানে যতটুকু পাবে তাকে ততটুকু দেয়াই আদল। ইসলামের আদল শুধু কাঠগড়ায়ই সীমিত নয়, বরং জীবনের সর্বত্র আদল প্রতিষ্ঠা করতে হয়। জীবনযাত্রায়ও আদল প্রতিষ্ঠা করতে হয়। সব কিছু বাদ দিয়ে শুধু নামাজ পড়লে যেমন আদল হবে না, আবার নামাজ বাদ দিয়ে অন্য সব কিছু করলেও জীবনে ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হবে না। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের মধ্যে আদলের সমন্বয় সাধন করতে হবে। কুরআন-সুন্নাহর দেয়া আইন সবার জন্য সমান। সামান্যতম ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপ্রধান পর্যন্ত সবার ওপর তা সমভাবে প্রয়োগ করা উচিত। আল কুরআনে মহান আল্লাহ তাঁর নবীকে নিম্নোক্ত ঘোষণা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, ‘আমি আদিষ্ট হয়েছি তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করতে।’ মহানবী সা: নিজে এ মূলনীতি বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘তোমাদের আগে যেসব উম্মত অতিক্রান্ত হয়েছে, তারা এ জন্য ধ্বংস হয়েছে যে, নীচু শ্রেণীর অপরাধীদের আইন অনুযায়ী শাস্তি দান করত, আর উঁচু পর্যায়ের অপরাধীদের ছেড়ে দিত। সেই সত্তার শপথ! যাঁর হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমাও যদি চুরি করত, তবে আমি অবশ্যই তার হাত কেটে ফেলতাম।’
আল্লাহর নির্দেশের মধ্যে আদলের স্থান সবার উপরে। আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসৎ কাজ ও সীমালঙ্ঘন।’ সর্বত্র ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা ঐচ্ছিক ধরনের কর্মসূচি নয়, এটি অপরিহার্য একটি বিধান। বিভিন্ন কারণে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। তার মধ্যে একটি হলোÑ স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতমূলক নীতি দর্শন। এ অবস্থায় অনেকেই নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্য দানে তোমরা অবিচল থাকবে; কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের যেন কখনো সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। সুবিচার করো, এটি তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করো।’ কুরআনের বহু স্থানে আদল প্রতিষ্ঠা করতে বলা হয়েছে। আর ন্যায় প্রতিষ্ঠাকারীরা আল্লাহর পছন্দের লোক। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সুবিচার করবে। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিচাকারীদের ভালোবাসেন।’ মানবিক মূল্যবোধের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে, সব মানুষের প্রতি সুবিচার। এ প্রসঙ্গে ‘আয়িশা রা: থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, ‘মাখজুমি সম্প্রদায়ের জনৈক মহিলা চুরির অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ায় তা কুরাইশ বংশের লোকদের খুব দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়। সাহাবিরা বলাবলি করছিলেন, এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাথে কে কথা বলতে পারবে? তারা বললেন, রাসূলুল্লাহ সা:-এর প্রিয় পাত্র উসামা রা: ছাড়া কেউ এ সাহস পাবে না। তখন উসামা ইবনে জায়দ রা: রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাথে এ বিষয়ে কথা বললে তিনি বললেন, ‘তুমি কি আল্লাহর দণ্ডবিধির ব্যাপারে সুপারিশ করছো?’ তারপর তিনি দাঁড়িয়ে খুতবা দিলেন এবং বললেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয় তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা পথভ্রষ্ট হয়েছিল। কেননা, যখন তাদের কোনো সম্ভ্রান্ত লোক চুরি করত, তখন তারা তাকে রেহাই দিয়ে দিত। আর যখন কোনো দুর্বল লোক চুরি করত, তখন তারা তার ওপর শরিয়তের শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম! মুহাম্মদ সা:-এর কন্যা ফাতিমাও যদি চুরি করত তবে অবশ্যই মুহাম্মদ সা: তার হাত কেটে দিতেন।’ বনি ইসরাইলের ধ্বংসের কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘বনি ইসরাইলের ধ্বংসের অন্যতম কারণ ছিল, যখন তাদের উঁচু শ্রেণীর লোকেরা অপরাধ করত, তখন ছাড়া পেয়ে যেত; আর নীচু শ্রেণীর লোকেরা যখন অপরাধ করত, তখন শাস্তি কার্যকর করা হতো।’ বর্তমানে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যাবে, এখানেও অনেক ক্ষেত্রে ওপর মহলের লোকেরা অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে, আবার যাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি নেই তাদের ওপরই আইন কার্যকর করা হচ্ছে। অথচ ন্যায়বিচারের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে।’ ন্যায়পরায়ণ খলিফা আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। পক্ষান্তরে জালিম রাষ্ট্রপ্রধান আল্লাহর কাছে খুবই ঘৃণিত। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘ন্যায়পরায়ণ খলিফা কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট সর্বাধিক নৈকট্যপ্রাপ্ত হবেন। আর জালিম রাষ্ট্রপ্রধান কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট সর্বাধিক ঘৃণিত ও সর্বাধিক শাস্তি প্রাপ্ত হবে। অধিকন্তু সে আল্লাহর দরবার থেকেও বহু দূরে অবস্থান করবে।’ অন্য এক হাদিস থেকে জানা যায়, কিয়ামতের ভয়াবহ ও লোমহর্ষক দিবসেও সে সব লোক মহান আল্লাহর ছায়া পাবে, যারা ন্যায়পরায়ণ শাসক। যেদিন মহান আল্লাহর ছায়া ছাড়া কোনো ছায়া থাকবে না। মহানবী সা: নিম্নোক্ত হাদিসে সৌভাগ্যবান সাত শ্রেণীর লোকের কথা উল্লেখ করেছেন, যাদের প্রথম শ্রেণী হলো ন্যায়বিচারক শাসক। তিনি বলেছেন, ‘সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ সেদিন ছায়া দেবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। তারা হলোÑ ন্যায়পরায়ণ শাসক। অন্য একটি হাদিস থেকে জানা যায়, ন্যায়পরায়ণ লোকদের আল্লাহ তায়ালা তাঁর পাশে স্থান দেবেন। মহানবী সা: বলেছেন, ‘ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিরা আল্লাহর ডান পার্শ্বে নূরের তৈরি একটি মিম্বরের ওপর অবস্থান করবে। তারা যখন দায়িত্বে ছিল তাদের শাসনে এবং পরিবারে ইনসাফ কায়েম করেছিল।’
ইনসাফ ও ন্যায়পরায়ণতার ফলে সৎকর্মশীল সব লোকের পক্ষে সুষ্ঠু জীবনযাপন অত্যন্ত সহজ হয় এবং আল্লাহর আইন লঙ্ঘন, আল্লাহর নিষিদ্ধ ও ঘৃণিত কাজ প্রভৃতি পরিহার করার পথে কোনো বাধা প্রতিবন্ধকতা থাকে না, বস্তুত মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের সাথে সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন না করে, ততক্ষণ অন্য লোকের প্রতি কোনো সুবিচার করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। নিজের যাচাই-পরীক্ষা নেয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় সে অন্যের সঠিক ও নির্ভুল যাচাই কী করে করতে পারে? সুতরাং সর্বপ্রথম নিজেকে দেখা, যাচাই-পরীক্ষা করা ও নিজের প্রতি সুবিচার ও ইনসাফ কায়েম করা প্রত্যেকেরই কর্তব্য। এটি করলে অন্যের অন্যায়ের যাচাই ও পরীক্ষা করা তার পক্ষে সহজ হতে পারে। উপরোক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় আল্লামা বদরুদ্দীন আইনি লিখেছেন : ‘হজরত আম্মার বর্ণিত এই হাদিসে সমস্ত কল্যাণ একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা, তুমি যখন তোমার নিজের প্রতি ইনসাফ করবে, তখন তুমি তোমার স্রষ্টার এবং তোমার ও অন্যান্য মানুষের প্রতি পারস্পরিক চূড়ান্ত কল্যাণই লাভ করতে পারবে। সব মানুষকে যখন তুমি সালাম দেবে, তখন তোমার চরিত্রও উন্নত হবে, মানুষের মন জয় করতে পারবে।’
ন্যায়বিচারের জায়গা শুধু আদালত বা কোর্ট নয়। ইসলামে আদল বা ন্যায়বিচার একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। এর দ্বারা সর্বত্র ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠা বুঝায়। ন্যায়বিচারের অন্তর্ভুক্ত হলোÑ সময়কে যথাযথ কাজে লাগানো, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সঠিকভাবে ব্যবহার, একাধিক স্ত্রী ও সন্তানের প্রতি সমান আচরণ করা, ছাত্রছাত্রীদের সমান চোখে দেখা প্রভৃতি। এমন একটি ব্যাপার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছেড়ে দিয়েছে বা অবহেলা করছে; যা আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন।’
ন্যায়বিচারের অভাবে অবিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্ববর্তী জাতিগুলোর বিশেষত বনি ইসরাইলের পতনের অন্যতম একটি কারণ ছিল এটি। তারা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য এক ধরনের বিচার করত, আবার অসহায় ও নিম্ন শ্রেণীর লোকদের জন্য আরেক রকম বিচার করত। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘বনি ইসরাইলের ধ্বংসের কারণ এই, তাদের সম্ভ্রান্ত লোকের চুরি করলে মাফ পেয়ে যেত...।’ কোনো সমাজে সুবিচার প্রতিষ্ঠিত না থাকলে সেখানে বিভিন্ন ধরনের অরাজকতা দেখা দেয়। বাংলাদেশ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ন্যায়বিচারের অভাবে অপরাধ ও অপরাধীর সংখ্যা বেড়ে যায়। অপরাধীরা তাদের অন্যায়-অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং বেপরোয়া হয়ে ওঠে। মহানবী সা: সেদিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘যদি কোনো জাতির মধ্যে সুবিচার প্রতিষ্ঠিত না থাকে, তখন তাদের মধ্যে রক্তপাত ছড়িয়ে পড়ে।’ সর্বোপরি যেকোনো বিবেচনায় সর্বত্র আদল প্রতিষ্ঠা করা দরকার। তাহলে অনেকাংশে মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সবাই তার ন্যায্য অধিকার লাভ করবে।
ইসলামের বক্তব্য হলোÑ বিচার করলে আদলের সাথেই করতে হবে। মহান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে।’ সামাজিক ন্যায়বিচার ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ। এর মাধ্যমেই মানব সমাজে ন্যায়বোধ পালিত হয় এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলাম সমাজে সবল, দুর্বল, ধনী-গরিব এবং শাসক-শাসিতের মধ্যে উত্তম সম্পর্ক বজায় রাখে। ফলে সামাজিক সংহতি ও কল্যাণ বৃদ্ধি পায়। যেমনÑ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়বিচারে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকবে, আল্লাহর সাক্ষীস্বরূপ; যদিও এটি তোমাদের নিজেদের অথবা বাবা-মা এবং আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে হয়; সে বিত্তবান হোক অথবা বিত্তহীন হোক আল্লাহ উভয়েরই ঘনিষ্ঠতর।’
লেখক : প্রবন্ধকার


আরো সংবাদ



premium cement